আন্দোলনে নতুন করে আবিষ্কৃত হয়েছে স্ট্রিট আর্টের প্রাসঙ্গিকতা

প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২৪

কাশিফ ফকির

জুলাই অভ্যুত্থানের আগে ও পরে সারা দেশ হয়ে উঠেছিল ক্যানভাস। উত্তাল দিনগুলোয় ‘হিট অ্যান্ড রান’ কায়দায় আঁকা হয়েছে প্রতিবাদী ভাষা। সফল হওয়ার পর আঁকা হয়েছে ধীরলয়ে নন্দনতত্ত্বের নীতিমালা মেনে। যে যেভাবে পেরেছে গ্রাফিতি ও স্ট্রিট আর্টের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছে নিজেদের বক্তব্য। রাঙিয়ে তুলেছে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়াল। রাস্তা বা দেয়ালে আঁকা অধিকাংশ চিত্রকর্ম আনাড়ি ও অপেশাদার হাতে তৈরি। সে ছাপ ব্যাপ্তিতে কম হলেও পড়েছিল পেশাদার চিত্রশিল্পীদের মননে। ফলে বিপ্লবের দিনগুলোয় শিল্প হয়ে ওঠে ভিন্ন ধারার দলিল। জুলাইয়ে চিত্রশিল্পীদের ভূমিকা ছিল সেদিক থেকে পৃথকভাবে আলোচিত হওয়ার মতো।

অভ্যুত্থানকে সবচেয়ে বেশি যারা অনুপ্রাণিত করেছেন, তাদের একজন দেবাশিস চক্রবর্তী। ঢাকায় বেড়ে ওঠা দেবাশিস ক্ষমতাকাঠামোর সঙ্গে জন-মনস্তত্ত্বের সম্পর্ককে পাঠ করেন গভীরভাবে। শিল্পে ব্যবহার করেন ফটোগ্রাফিক ও অপটিক্যাল টেকনিক। দীর্ঘ সময় ধরে তার কাজে মানুষের মৌলিক অধিকার প্রসঙ্গ বিম্বিত হলেও গত জুলাইয়ে অন্য মাত্রা পেয়েছিল। ‘জুলাই গণহত্যা’, ‘রাষ্ট্র সংস্কার লাগবে’, ‘হুকুমের আসামি’ ও ‘উই রিভোল্ট’-এর মতো সৃষ্টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে ছড়িয়ে পড়েছে দেয়ালে। এদিকে উত্তাল জুলাইয়ের বাংলাদেশকে ক্যানভাসে রঙ-তুলিতে ফুটিয়ে তুলেছেন তরুণ চিত্রশিল্পী সুলতান ইসতিয়াক। জ্যেষ্ঠ শিল্পীদের নিশ্চুপ থাকা তাকে ব্যথিত করেছে, ফলে তরুণ হাতেই তুলে নিয়েছেন জনতার স্বরকে তুলে ধরতে। গণভবনের দিকে ধেয়ে চলা মিছিল, রাজুর পাদদেশে জনসমুদ্র উঠে এসেছে তার রঙে। গণ আন্দোলনে মেহেদী হক ও অপুর মতো অসংখ্য কার্টুনিস্ট অবদান রেখেছেন নিজেদের মতো করে। প্রাসঙ্গিক ভূমিকা রেখেছেন তরুণ চিত্রশিল্পী ডেরিল অদ্রি রায়। তিনি আঁকতে ও ছবি তুলতে ভালোবাসেন। তার ভাষ্য, ‘চিত্রকর্মের ব্যাকরণ আমি বুঝি না, বুঝি না পারসপেকটিভ, আলো-ছায়ার চরম বিশ্লেষণ, এনাটমির চুলচেরা বিশ্লেষণ। আমি শুধু জানি নিজস্ব অনুভূতি একজন শিল্পীর প্রধান শক্তি। শিল্প জনমানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, শুধু ধনীদের ঘরের শোপিস হয়ে না যাক।’

দেশের স্বনামধন্য চিত্রশিল্পী ওয়াকিলুর রহমান। জুলাই অভ্যুত্থানে চিত্রশিল্পীদের ভূমিকাকে তিনি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখেন। তিনি বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ছাত্র-ছাত্রীদের বড় অংশই সক্রিয়ভাবে পক্ষে ছিল। তারা তাদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। পরে আন্দোলন যেভাবে বাঁক নেয় ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে সাধারণ শিল্পীদের সমর্থন ছিল, যা বিভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়েছে। পূর্ববর্তী সরকারের আচরণ ও রাজনৈতিক কার্যক্রম নিয়ে সাধারণ মানুষ ও শিল্পীদের অবস্থান অনেকটা একই ধরনের। কেউ হয়তো রাস্তায় নেমেছেন, কেউ হয়তো নামেননি কিন্তু সমর্থন ছিল।’

এক্ষেত্রে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন এ সময়ের গুরুত্বপূর্ণ শিল্প বিশ্লেষক ও চিত্রশিল্পী মোস্তফা জামান। তার মতে, স্বাধীনতা আন্দোলনে শিল্পীদের অনেক ভূমিকা থাকলেও সে অনুপাতে গত ১৫ বছর শিল্পীরা ভূমিকা রাখতে পারেননি। দার্শনিক জায়গা থেকেও চিত্রশিল্পীদের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় বন্দি হয়ে যাওয়ার প্রবণতা আছে বলে তিনি মনে করেন। আন্দোলনে শিল্পীদের যতটুকু পাওয়ার কথা ছিল, ততটুকু পাওয়া যায়নি। মোস্তফা জামানের কাছে এমনটা হওয়ার কারণও স্পষ্ট। দীর্ঘদিন ধরেই চিত্রশিল্প ছিল গ্যালারিকেন্দ্রিক আর চিত্রশিল্পীদের চর্চা রোজগারকেন্দ্রিক। এজন্য সৃষ্টিশীল চিন্তার জায়গা সংকুচিত হয়ে পড়ে। তিনি বলেন, ‘আমরা যারা ১৫ জুলাইয়ের পর সিদ্ধান্ত নিলাম কিছু করার, তাদের শিল্পচর্চার সঙ্গে কিন্তু রোজগারের সম্পর্ক নেই। তারা আঁকে সৃষ্টিশীলতার তাগিদ নিয়ে। রাজনৈতিক সচেতনতা ছিল। তাদের চরিত্র ইনস্টিটিউটে কাজ করা শিল্পীদের থেকে ভিন্ন।’

এ আন্দোলনে স্ট্রিট আর্টের গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা নতুন করে আবিষ্কৃত হয়েছে সমাজে। সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা মাধ্যমটাকে যেভাবে ব্যবহার করেছে, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যারা সাংস্কৃতিক নীতিমালা তৈরি করে, তারা বুঝতে পারবে কতটুকু শক্তিশালী একটা মাধ্যম। জনগণের সঙ্গে ভাবনা ও চিন্তাধারার যোগাযোগ করার। এর মধ্য দিয়ে নতুন করে প্রাসঙ্গিকতা তৈরি হলো শিল্পীদের। প্রত্যেকটা আর্টিস্টই নির্দিষ্ট পর্যায়ে প্রাসঙ্গিকতা চান। তবে রাজনীতিক নেতারা বিষয়টি পছন্দ করেন না। ফলে শিল্পীদের চর্চা প্রভাবিত হয়। দিনশেষে স্ট্রিট আর্ট একটা বড় ধরনের রাজনীতি। শিল্প নিয়ে রাজনীতি। এখানে বোঝাপড়ার অনেক কিছুই থাকে।

সাধারণত যেকোনো অভ্যুত্থান ও বিপ্লবের পর শিল্পাঙ্গনে নয়া প্রবণতা দেখা দেয়। আন্দোলনকে সমর্থন দিয়ে এর মধ্যেই এক ধরনের শিল্পচর্চা আছে। শিল্পগুলো খুব সরাসরি যোগাযোগ তৈরি করেছে মানুষের সঙ্গে। দেয়াল লিখন, দেয়াল চিত্রন ও কার্টুন নিয়ে সরাসরি চিত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ তৈরি করা যায়। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানেও সমাজে দেয়াল লিখনের চর্চা ছিল। রাজনীতিক দলগুলো এগুলো করতেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও নানা বিষয় নিয়ে স্ট্রিট আর্টের নতুন নতুন ধারা তৈরি হয়েছে। নিউইয়র্কভিত্তিক গ্রাফিতি আর্ট কিংবা মেক্সিকোর ম্যুরাল চিত্রমালা। তবে বাংলাদেশে বিষয়টি আবার নতুন করে সামনে এল। ওয়াকিলুর রহমান মনে করেন, সার্বিক অর্থে তেমন অভিমুখের জন্য কিছু সময় লাগবে। এখনকার যে অভিজ্ঞতা ও চেতনা, এর মধ্য দিয়ে নতুন কোনো শিল্প ভাবনা এ অঞ্চলে উঠে আসবে। হয়তো শিল্পীরা ভাবছেন, সে ভাবনাগুলো তাদের নতুন করে ভাবার সুযোগ করবে।

অভ্যুত্থানের আগে থেকেই নয়া ধারার শিল্পকলার যাত্রা শুরু হয়ে গেছে বলে মনে করেন মোস্তফা জামান। তার দাবি অনুসারে, ‘নতুনত্ব আগেই চলে এসেছে। যারা আমরা চলে এসেছি, তারা কিন্তু মিশ্রভাবে ছবি আঁকি। মিশ্র ডিসিপ্লিনে ছবি আঁকি। আমরা কিন্তু ডিসিপ্লিন ভেঙে ফেলেছি। যারা শিল্পী না, কিন্তু দেয়ালে ছবি আঁকে, তাদের মধ্যে কিন্তু মিশ্রতা দেখা দেবে। দেশ-বিদেশ, বাঙালি-চাকমা, হিন্দু-মুসলিম বাইনারি ভেঙে ফেলে শিল্প যে অবিমিশ্র না, সেটা তারা প্রমাণ করে দিল। একদিকে ব্যাটম্যান আছে, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ। তারা কিন্তু বাতিলকরণের দিকে পা না দিয়ে এক ধরনের মেলবন্ধন তৈরি করেছে। বাইনারিকে ভেঙে ফেলার প্রবণতা আমাদের মধ্যে ছিল, সেটা নতুন সুযোগ পেল। আমরা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা শুনেছি; এখন জাতিনিরপেক্ষ ও মাধ্যম নিরপেক্ষের কথাও দেখছি। আসলে এটাই নতুন শিল্প কোন দিকে যাবে, সেই ভবিষ্যতের নিশানা দেবে।’


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫