উফিৎজি আগলে রেখেছে ইতালি রেনেসাঁর সব চিহ্ন

প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২৪

রুহিনা ফেরদৌস

ফ্লোরেন্সের কেন্দ্রীয় চত্বর পিয়াজ্জা দেলা সিগনোরিয়ায় দাঁড়িয়ে বেশ খানিকটা দ্বিধায় পড়তে হয়। গোটা চত্বরটিই যেন উন্মুক্ত জাদুঘর। মাইকেলেঞ্জেলোর ডেভিডের প্রতিলিপি, পার্সিয়াস কর্তৃক মেদুসার শিরশ্ছেদের মুহূর্ত, রোমান যোদ্ধাদের সাবিনে নারীদের অপহরণের ভাস্কর্য, সমুদ্রের দেবতা নেপচুনের ঝরনা, হারকিউলিসের দানব কাকাসকে পরাস্ত করার পৌরাণিক কাহিনী আর ফ্লোরেন্সের প্রথম গ্র্যান্ড ডিউক কসিমো দি’মেদিচির ঘোড়ার পিঠে বসা ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য দেখতে দেখতে চোখে পড়বে পালাজ্জো ভেক্কিও, উফিৎজি গ্যালারি, লোজিও দেই ল্যানসি আর গুচি মিউজিয়াম।

 এত এত ঐতিহাসিক নিদর্শনের ভিড়ে নতুন দর্শনার্থী হিসেবে খানিকটা খেই হারিয়ে ফেলাটা নিশ্চয়ই দোষের কিছু নয়। এ ফ্লোরেন্সই ইতালি রেনেসাঁর আঁতুড়ঘর। তাসকানির কেন্দ্রস্থলে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো এ শহর তাই সাজানো ইতিহাস, ঐতিহ্য, আর শিল্প দিয়ে। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, মাইকেলেঞ্জেলো, রাফায়েল, কারাভাজ্জো ও বোতিচেল্লির মতো শিল্পীদের জীবনের কোনো না কোনো সময় কেটেছে এখানে। উফিৎজি আগলে রেখেছে ইতালি রেনেসাঁর সেসব চিহ্ন। গ্যালারির দেয়াল, মেঝে আর ছাদজুড়ে ছড়ানো ইতিহাসের সেসব স্বাক্ষর। 

তাই উফিৎজি দেখতে দেখতে মনে হবে ফ্লোরেন্সের শিল্প ইতিহাসের পথ ধরে হাঁটছি। এতসব বিখ্যাত পেইন্টিং, ভাস্কর্য, স্থাপত্য, ড্রয়িং আর বইয়ের সংগ্রহ, যা একদিনে দেখে শেষ করা অসম্ভব। যত্ন করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে হলে কমপক্ষে সপ্তাহ খানেক সময় হাতে নিয়ে যেতে হবে।

উফিৎজির নির্মাণকাল ১৫৬০-৮০ দশকের মধ্যে। নকশা করেন ইতালির রেনেসাঁ যুগের খ্যাতনামা শিল্পী, স্থপতি ও শিল্প ইতিহাসবিদ জর্জিও ভাসারি। চিত্রকলা, স্থাপত্য ও শিল্পবিষয়ক লেখালেখির জন্য বিখ্যাত ছিলেন ভাসারি। রেনেসাঁর নামকরা শিল্পীদের জীবন ও কাজ নিয়ে লেখা তার বই দ্য লাইভস অব আর্টিস্টস আজও বহুল পঠিত। শিল্প ইতিহাসের জনক হিসেবেও ধরা হয় তাকে। ১৫৬০ সালে প্রথম কসিমো দি’মেদিচি তাকে উফিৎজির নকশার দায়িত্ব দেন। মূলত ফ্লোরেন্সের সরকারি অফিস হিসেবেই নির্মাণ হয়েছিল এটি। ইতালির ভাষায় উফিৎজি মানে অফিস।

প্রাচীন ভাস্কর্য ও চিত্রকলার সমৃদ্ধ সংগ্রহের জন্য সুপরিচিত এ গ্যালারিতে আছে মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগের বিখ্যাত সব শিল্পকর্ম। বিশেষ করে ১৪ শতক এবং রেনেসাঁ সময়ের কাজ। এর মধ্যে যেমন উল্লেখযোগ্য জিওত্তো, সিমোনে মার্তিনি, পিয়েরো দেলা ফ্রান্সেস্কা, বেওটো অ্যাঞ্জেলিকো, ফিলিপ্পো লিপ্পি, বোতিচেল্লি, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, রাফায়েল, মাইকেলেঞ্জেলো ও কারাভাজ্জো। জার্মান, ডাচ আর ফ্লেমিশ শিল্পীদের মূল্যবান শিল্পকর্মেরও দেখা মেলে এখানে। 

গ্যালারিতে ঢুকেই চোখে পড়বে ক্ষতিগ্রস্ত কিছু শিল্পকর্মের। ১৯৯৩ সালের ২৭ মে সিসিলিয়ান মাফিয়া ভিয়া দেই জর্জোফিলি রাস্তায় গাড়িবোমা বিস্ফোরণ ঘটালে ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রাসাদের কিছু অংশ। ওই বিস্ফোরণের ফলে পুরোপুরি নষ্ট হয় পাঁচটি শিল্পকর্ম। ক্ষতিগ্রস্ত হয় আরো ৩০টি। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় নায়ওবি কক্ষের। ওখানের ভাস্কর্যগুলোকে পরে পুনরায় স্থাপন করা হলেও ফ্রেস্কোগুলো আর পুনরুদ্ধার করা যায়নি। ঢোকার শুরুতেই আগুনে পোড়া সে ছবিগুলো দেখা যায়।

গোটা গ্যালারিকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়—চিত্রকলা, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, প্রিন্ট ও ড্রয়িং এবং বই ও আর্কাইভ; যেখানে ১ লাখ ৭৭ হাজারেরও বেশি ড্রয়িং ও প্রিন্ট, ১ হাজার ৮০০টির মতো চিত্রকলা এবং ৩০০টি ভাস্কর্য রয়েছে। লেখকের প্রধান আগ্রহ ছিল বোতিচেল্লির বার্থ অব ভেনাস এবং স্প্রিং; লিওনার্দো দা ভিঞ্চির দি অ্যাডোরেশন অব দ্য মেজাই ও দি অ্যানানসিয়েশন আর কারাভাজ্জোর মেদুসা ঘিরে। আলাদা করে অবশ্যই বলতে হয় মাইকেলেঞ্জেলোর ডোনি টন্ডোর কথা। ফ্লোরেন্সে এটি মাইকেলেঞ্জেলোর একমাত্র পেইন্টিং। ১৫০৪ সালে অ্যানলো দোনির বিয়ে উপলক্ষে আঁকা। টেম্পরা মাধ্যমে গোলাকার কাঠের প্যানেলে আঁকা এ শিল্পকর্মে মাইকেলেঞ্জেলোর নিজস্ব শৈলী স্পষ্ট। রঙের ব্যবহার, দেহভঙ্গি আর মানবিক আবেগের চমৎকার সংমিশ্রণ এ ছবি।

লিওনার্দো দা ভিঞ্চির বয়স যখন ১২ বছর তখন ফ্লোরেন্সে এসে বাবার সঙ্গে থাকতে শুরু করেন। ছবি আঁকা শিখতে শুরু করেন আন্দ্রেয়া ভেরোচ্চিওর স্টুডিওতে। ভেরোচ্চিও তখন ফ্লোরেন্সের নামকরা শিক্ষক ও চিত্রকর। ছাত্রদের মধ্যে সব সময় তুমুল প্রতিযোগিতা চলত কে হবেন ভেরোচ্চিওর ফার্স্ট অ্যাপরেন্টিস। লিওনার্দোর কাজ দেখে ভেরোচ্চিও আর দ্বিতীয় কারো কথা ভাবেননি। সে সময় তিনি কমিশনপ্রাপ্ত হন দ্য ব্যাপ্টিজম অব ক্রাইস্ট ছবিটি আঁকার জন্য। সহযোগী করেন লিওনার্দোকে। এ ছবিতে যে দুজন দেবদূত আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বামেরটা লিওনার্দোর আঁকা। শিষ্য যে কখনো কখনো গুরুকেও ছাড়িয়ে যেতে পারেন, তা দেখিয়ে দিয়েছেন লিওনার্দো। এ চিত্রকর্ম যখন সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয় তখন হালকা নীল পোশাকের ঘাড় বাঁকানো ভঙ্গিমার দেবদূতকে দেখে সবাই মুগ্ধ হয়েছিলেন। রয়েছে রাফায়েলের আঁকা আত্মপ্রতিকৃতি, ম্যাডোনা দেল কার্ডিলিনো ও পোর্ট্রেট অব লিও। বিশেষ আকর্ষণ কারাভাজ্জোর মেদুসা। একটি কাঠের ঢালের ওপর করা তৈলচিত্র। এখানে কারাভাজ্জোর আঁকা মেদুসার দুটি সংস্করণ আছে। প্রথমটি ১৫৯৬ এবং অন্যটি আনুমানিক ১৫৯৭ সালে আঁকা। উভয় চিত্রেই পার্সিয়াস কর্তৃক মেদুসাকে হত্যার ওই মুহূর্তটি ধরা হয়েছে। উল্লেখ্য, মেদুসার প্রতিকৃতিকে অনেকে কারাভাজ্জোর আত্মপ্রতিকৃতি বলে থাকেন।

তবে উফিৎজির অন্যতম সেরা সংগ্রহ সান্দ্রো বোতিচেল্লির বার্থ অব ভেনাস। এ মাস্টারপিস ধারণ করে আছে প্রেম ও সৌন্দর্যের দেবী ভেনাসকে। ছবিতে দেখা যায়, সমুদ্রের ফেনা থেকে জন্ম নিয়ে সাইপ্রাস দ্বীপে এসে পৌঁছেছেন ভেনাস। তাকে বয়ে নিয়ে আসছেন বাতাসের দেবতা জেফির, সঙ্গে আছেন আউরা। মসৃণ ও উজ্জ্বল মুক্তার মতো নিখুঁত ভেনাসকে স্বাগত জানাচ্ছেন এক তরুণী। এ তরুণীকেই আমরা বোতিচেল্লির স্প্রিংয়ে দেখতে পাই। এ ছবিটিও এ কক্ষেই রয়েছে। তথ্যমতে, ১৪৮২-৮৫ সালের দিকে মেদিচি পরিবার ছবিটি কমিশন করে। বোতিচেল্লির এ দুটি ছবির সামনে দাঁড়ানো এক অনন্য অভিজ্ঞতাই বটে।

এসব মাস্টারপিস দেখা শেষ করে হাতে কিছু সময় থাকলে যাওয়া যেতে পারে প্রিমিটিভি রুম, নায়ওবি রুম আর উফিৎজি লাইব্রেরিতে। আলাদা করে বলতে হয় গ্যালারির করিডোরের কথা, যেখানে অসংখ্য ভাস্কর্য, স্থাপত্য আর মেদিচি পরিবারের সদস্যদের আত্মপ্রতিকৃতি ইতিহাসের গভীরে নিয়ে যাবে। তবে করিডোরে ঘুরতে গিয়ে অবশ্যই ট্রিবিউনে (এমন একটি স্থান বা কক্ষকে বোঝায়, যা মাস্টারপিস বা বিখ্যাত কোনো শিল্পকর্ম প্রদর্শনের জন্য নকশা করা হয়) উঁকি দিতে হবে একবার। ১৫৮১-৮৩ সালের মধ্যে উফিৎজি গ্যালারির এ ট্রিবিউন নির্মাণ হয়। অষ্টভুজাকৃতির কক্ষটির নকশা করা হয় খ্রিস্ট ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে। এখানে মেদিচি পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহ, শিল্পকর্ম ও রেনেসাঁর সময়ে দুর্লভ শিল্পকর্ম দেখা যাবে। শিল্পের পৃষ্ঠপোষক বলে খ্যাত মেদিচি পরিবারের সংগ্রহ করা প্রাচীন ভাস্কর্য ও মূর্তির দুর্লভ অনেক সংগ্রহ রাখা হয়েছে ভবনটির করিডোরগুলোয়। এখানে পাওয়া যাবে প্রাচীন রোমান ভাস্কর্যের হারিয়ে যাওয়া গ্রিক শিল্পকর্মগুলোও।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫