সোভিয়েত ইউনিয়নের ভুলেই কি তৈরি হয়েছিল ‘নরকের দরজা’?

প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৪

বণিক বার্তা অনলাইন

শিল্পক্ষেত্রে দুর্ঘটনা থেকে দেশের অন্যতম প্রধান দর্শনীয় স্থান সৃষ্টি হয়ে যাওয়ার ঘটনা সচরাচর শোনা যায় না। কিন্তু এমনটিই ঘটেছে মধ্য এশিয়ার দেশ তুর্কমেনিস্তানে। ৫০ বছরেরও বেশি সময় আগে একটি সোভিয়েত অনুসন্ধানকারী দল তুর্কমেনিস্তানে প্রাকৃতিক গ্যাসের খোঁজ পেতে শুরু করেছিল খনন কাজ। তারা এমন এক চেইন রিয়্যাকশন শুরু করেছিল যাতে সৃষ্টি হয় এক বিশাল আগুনে গহ্বর। অঞ্চল অনুসারে এর নাম দারভাজা গ্যাস গহ্বর। আর রূপ বা প্রকৃতির কারণে এর নাম দেয়া হয়েছে ‘গেটস অব হেল’ বা নরকের দরজা। কারাকুম মরুভূমির এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে বালিয়াড়ি ও পাথুরে প্রস্তরভূমির মাঝখানে অবস্থিত এই বিশাল অগ্নিময় গহ্বরটি পরিণত হয়েছে তুর্কমেনিস্তানের সবচেয়ে কাঙ্খিত দর্শনীয় স্থানে।

বিস্ময়কর গহ্বরটিতে আগুন জ্বলার কারণ এর তলা এবং দেয়ালের অসংখ্য ছিদ্র থেকে বেরিয়ে আসা মিথেন গ্যাস। গর্তের কিনারায় গিয়ে দাঁড়ালেই অনুভূত হবে আগুনের তীব্র উত্তাপ। গর্তটি প্রায় ২৩০ ফুট (৭০ মিটার) প্রশস্ত এবং ১০০ ফুট (৩০ মিটার) গভীর। খাড়া দেয়ালগুলো সরাসরি নিচে ছড়িয়ে থাকা পাথুরে ধ্বংসাবশেষের দিকে নেমে গেছে। ২০১৮ সালে গর্তের প্রান্তে দেয়া হয় একটি নিরাপত্তা বেড়া, যাতে দর্শনার্থীরা জ্বলন্ত গহ্বরের খুব কাছে না যায়।

লেখক গেড গিলমোর এই জ্বলন্ত গহ্বর নিয়ে লিখেছেন ‘স্ট্যানস বাই মি: আ হোয়ার্লউইন্ড ট্যুর থ্রু সেন্ট্রাল এশিয়া’ নামক বই। সেখানে তিনি লিখেছেন, এটি একটি ধসে পড়া গ্যাস গুহা, যা শুনতে অনেকটা পুরনো কোনো গ্যাস চুল্লির মতো মনে হয়। কিন্তু এতে একটা ভৌতিক ব্যাপার আছে, এবং আসলেই এটা আমার কাছে বেশ ভয়ঙ্কর।

যারা বছরের পর বছর ধরে দারভাজা পরিদর্শন করছেন তাদের মতে, সেখানকার আগুন অনেক ছোট হয়ে এসেছে। তবে মানবসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক উপায়ে অনেকটা সংকর এই গহ্বরের বিস্ময়কর আকর্ষণ কমেনি। বালুঝড় আঘাত হানলে অন্ধকার গর্ত থেকে ওপরে ওঠে আসা জ্বলন্ত শিখাগুলো চোখে পড়ে।

কেউই নিশ্চিত নয় কখন এই গ্যাসপূর্ণ গর্তটি তৈরি হয়েছিল। কারণ সোভিয়েত আমলের প্রতিবেদনগুলো খুঁজে পাওয়া ছিল কঠিন। যা পাওয়া গেছে সেগুলোও ছিল অসম্পূর্ণ এবং অনেকটাই গোপনীয়।


কানাডীয় অভিযাত্রী এবং টেলিভিশন উপস্থাপক জর্জ কাউরুনিস হলেন এই নরকের দরজা দিয়ে অর্থাৎ, গর্তের ভেতর প্রবেশ করা বিশ্বের কাছে একমাত্র পরিচিত ব্যক্তি। তিনি বলেন, এর উৎপত্তি কীভাবে হয়েছিল তা নিয়ে অনেক বিতর্ক, অনেক মতবিরোধ রয়েছে। আমি নিজেও জানি না কী বিশ্বাস করা উচিত। এই জায়গা জড়িয়ে অনেক গল্প এবং মিথ রয়েছে।

কাউরুনিসের মতে, সবচেয়ে প্রচলিত তত্ত্ব হলো— গর্তটি ১৯৭১ সালে তৈরি হয়েছিল এবং তার কিছু সময় পর এটি জ্বালানো হয়। তবে এই তত্ত্বের সঙ্গে একমত হতে না পেরে তিনি বলেন, কিন্তু আমি যখন তুর্কমেনিস্তানে ছিলাম, তখন সরকার থেকে আসা দুজন বয়স্ক ভূতাত্ত্বিক আমাদের সঙ্গে দারভাজায় এসেছিলেন। তারা আমাকে বলেন, গর্তটি আসলে ১৯৬০-এর দশকের কোনো এক সময় তৈরি হয়েছিল এবং বেশ কিছুদিন ধরে কাদা ও গ্যাসের কারণে ফুটছিল। ১৯৮০-এর দশকের আগে জ্বলে ওঠেনি এই গহ্বর।

গ্যাস প্রথম কীভাবে জ্বলে ওঠেছিল সেটাও আরেক রহস্য। কাউরুনিস বলেন, কেউ বলে হ্যান্ড গ্রেনেড। কেউ বলে, সোভিয়েতরা শুধু একটা ম্যাচের কাঠি ফেলেছিল। আমি এমন একটা গল্পও শুনেছি যে, এক মাতাল কৃষক তার ট্রাক্টর নিয়ে সেখানে পড়ে গিয়েছিল।

স্থানীয় গাইড দেন আরেক তত্ত্ব। তিনি বলেন, সে সময় কাছাকাছি একটি গ্রাম ছিল। আমি শুনেছি তারা দুর্গন্ধ দূর করতে গর্তটিতে আগুন লাগিয়েছিল। তারা ভেবেছিল, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আগুন নিভে যাবে।

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের অর্থায়নে একটি বৈজ্ঞানিক মিশনের অংশ হিসেবে ২০১৩ সালে ১৭ মিনিটের জন্য গহ্বরটিতে নামেন কাউরুনিস। মিশনটির লক্ষ্য ছিল এমন কোনো জীবের সন্ধান করা যারা ওই কঠিন পরিবেশে টিকে থাকতে পারে। মিশন থেকে হইচই ফেলে দেয়ার মতো কিছুর সন্ধান পাওয়া যায়নি। সেখানে উচ্চ তাপমাত্রায় বেঁচে থাকতে সক্ষম ব্যাকটেরিয়া এবং থার্মোফাইলের মতো সরল জীবের সন্ধান পাওয়া গেছে।

বছরের পর বছর ধরে কথাবার্তা চলছে যে, তুর্কমেনিস্তান সরকার দারভাজাকে একটি প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদন কেন্দ্রে রূপান্তরিত করবে এবং আগুন নিভিয়ে ফেলবে। তবে স্থানীয় গাইড এটিকে গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।

তবে এখন পর্যন্ত তুর্কমেনিস্তানের এক প্রাকৃতিক বিস্ময় হিসেবে দর্শনার্থীদের একইসঙ্গে মুগ্ধ এবং ভীত করে যাচ্ছে দারভাজার এই দানবীয় গর্ত। কারাকুম মরুভূমি পেরিয়ে এক দীর্ঘ ও কষ্টসাধ্য যাত্রা করে মানুষ দেখতে আসে এই নরকের দরজা।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫