ডিসি পদ না পেয়ে উপসচিবদের হট্টগোল

পদায়নের ক্ষেত্রে হঠকারী সিদ্ধান্ত নয়, যোগ্যতা অগ্রাধিকার পাক

প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ১২, ২০২৪

জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে গত সোম ও মঙ্গলবার দুইদিনে ৫৯ কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সে তালিকায় নাম না থাকায় ১০ সেপ্টেম্বর দিনভর সচিবালয়ে হট্টগোল করেছেন বিভিন্ন ব্যাচের উপসচিবদের একাংশ। বিক্ষুব্ধ উপসচিবদের মতে, বিগত সরকারের আমলে পদ ও পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তারা। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সম্প্রতি তাদের উপসচিব পদে পদোন্নতি দিয়েছে। যদিও তাদের আশা ছিল, দীর্ঘদিন পদোন্নতি ও পদবঞ্চিত থাকার কারণে তাদের জেলা প্রশাসক হিসেবে বিভিন্ন জেলায় নিয়োগ করা হবে। কিন্তু তাদের নাম ওই দুদিনে পদায়নকৃত জেলা প্রশাসকদের তালিকার প্রজ্ঞাপনে না থাকায় তারা সচিবালয়ে এক ধরনের বিক্ষোভ প্রকাশ করেন। 

জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়নে ২৪, ২৫ ও ২৭তম বিসিএস ব্যাচের কাউকে নিয়োগ দেয়া হয়নি বলে জানা গেছে। তাদের সবারই যুগ্ম সচিব হওয়ার সময় প্রায় চলে এসেছে। ফলে তারা যদি বর্তমানে ডিসি হিসেবে নিয়োগ না পান, তাহলে আবারো বঞ্চিত হবেন বলে আশঙ্কা করছেন। 

এদিকে গতকাল সদ্য নিয়োগ পাওয়া ৫৯ জেলা প্রশাসকদের মধ্যে আটজনের নিয়োগ বাতিল ও চারজনকে বদলি করা হয়েছে। এর আগে গত সোমবার নিয়োগ দিয়ে একদিনের ব্যবধানে মঙ্গলবার সিলেটের ডিসি নিয়োগের সিদ্ধান্তও পরিবর্তন করা হয় এবং নিয়োগকৃত ডিসির স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে আরেক উপসচিবকে।

নিয়োগ বাতিল প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, সাংবাদিকদের বিভিন্ন গঠনমূলক প্রতিবেদন ও বিভিন্ন অভিযোগ এবং অনেক দিনের পুরনো তথ্যের ভিত্তিতে যেসব পদায়নকৃত জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে যৌক্তিক অভিযোগ পাওয়া গেছে তাদের নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে।

উদ্ভূত পরিস্থিতি ও এ মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য থেকে দুটি প্রশ্নের উদ্রেক ঘটে। এক. ওই দুই দফায় কিসের ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল এবং দুই. নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকার কি যোগ্যতাকে উপেক্ষা করে হঠকারী কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে? 

যাচাই-বাছাই করে নিয়োগ দেয়া সবসময়ই সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আওয়ামী লীগ সরকার পতন-পরবর্তী সময় থেকে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়ে ওঠেনি। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণেরও এক মাস সময় পূর্ণ হয়েছে। বিচার-বিবেচনার জন্য এক মাস স্বল্প সময় হলেও জনপ্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নের বিষয়ে কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত কাম্য নয়। সরকারের উচিত সময় নিয়ে পর্যালোচনার মাধ্যমে যোগ্য কর্মকর্তাকে জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়া। যেন নিয়োগের একদিনের ব্যবধানে নিয়োগ বাতিল কিংবা কাউকে বদলি করতে না হয়। পাশাপাশি নিয়োগ যেন যোগ্যতার ভিত্তিতে হয় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। জোরজবরদস্তি, দাবি-দাওয়া উঠিয়ে সৃষ্ট বিক্ষোভের মুখে কোনো সিদ্ধান্ত যদি নেয়া হয় তা আওয়ামী সরকারের আমলে নিয়োগ বা পদোন্নতির ক্ষেত্রে মেধার মূল্যায়ন না করে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগেরই শামিল হবে। এতেও প্রকৃত প্রস্তাবে যোগ্য ব্যক্তি বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েই যায়। গত ১৫ বছরে যেভাবে জনপ্রশাসন দলীয়করণ হয়েছে তা রাতারাতি দূর করা সম্ভব নয়। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সময় লাগবে এবং সরকারের ততটুকু সময় নিয়ে নিয়োগ দেয়া অতীব জরুরি। নয়তো দেখা যাবে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের মধ্যে সুবিধাভোগী, বিতর্কিত ও দুর্নীতিগ্রস্তরাও নিয়োগ পেয়ে যাবে। এরই মধ্যে এ বিষয়ে অভিযোগ উঠেছে।

দীর্ঘদিন ধরেই দেশে মাঠ প্রশাসনে এক ধরনের অস্থিরতা রয়েছে। একাধিক পদ শূন্য পড়ে আছে। যে কারণে প্রশাসনিক বিভিন্ন কাজে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, কারো চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল এবং কাউকে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করায় এখন সাতটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে সচিব পদ খালি। এসব মন্ত্রণালয়ের কাজেও স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। কাজের গতি বাড়াতে এসব শূন্য পদে দ্রুত নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন হলেও যদি তা যথাযথভাবে না করা হয় এতে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না।

বণিক বার্তার এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিগত সরকারের প্রশাসনে সচিব ও সিনিয়র সচিব পদে নিয়োজিতদের প্রায় ৯৫ শতাংশই ছিল অ্যাডমিন বা প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারেও এখন পর্যন্ত যারা সিনিয়র সচিব ও সচিব পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন, তাদেরও সবাই অ্যাডমিন ক্যাডারের। উপরন্তু বর্তমান সরকারের সিনিয়র সচিব ও সচিবদের মধ্যে ৯০ শতাংশেরও বেশি নিয়োগ হয়েছিল বিগত সরকারের আমলে। আবার তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সংঘটিত অপরাধগুলোর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। একই সঙ্গে সরকারকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার ক্ষেত্রেও দায়ী করা হয় তাদের। বিতর্কিত নির্বাচন থেকে শুরু করে যেসব কর্মকাণ্ড গত সরকারকে স্বৈরতান্ত্রিক রূপ দিয়েছিল, সেগুলোর ক্ষেত্রেও অ্যাডমিন ক্যাডাররাই সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। 

এ পরিস্থিতিতে কেবল ডিসি নয়, যেকোনো পদে পদায়নের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা জরুরি। নয়তো জনপ্রশাসন ও দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে শৃঙ্খলা ফেরানো আরো কঠিন হয়ে পড়বে। এরই মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারের বাইরে পেট্রোবাংলা, এলজিইডি, মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়সহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ-আন্দোলন করছেন। ফলে ওইসব দপ্তরের স্বাভাবিক কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে। কেবল প্রশাসন ক্যাডারদেরই পদোন্নতি হওয়ায় শিক্ষা, তথ্য, কৃষিসহ অন্যান্য ক্যাডারদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।

নিয়োগ বা পদোন্নতির এ বৈষম্য দূর না হলে জন-আকাঙ্ক্ষার গণ-অভ্যুত্থান বিফল হয়ে যাবে। এছাড়া নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্য ব্যক্তিকে অগ্রাধিকার দেয়ার অন্যতম একটি প্রয়োজন হলো অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন। কেননা কেবল বঞ্চিত বিচারে পদায়ন করলে তা কোনো সুফল বয়ে আনবে না। উল্টো কার্যক্রম ব্যাহত হবে। সুতরাং যাদের পদায়ন হবে ও পদোন্নতি হয়েছে এবং হবে তাদেরও নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করাটা আবশ্যক।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫