দেশের বিদ্যুৎ চাহিদার এক-পঞ্চমাংশ ভারতের ওপর নির্ভরশীল

জ্বালানির অভাব, সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটলে তাৎক্ষণিক বিকল্প নেই বিপিডিবির

প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ১০, ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিদ্যুৎ বিক্রি বাবদ বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) কাছে বিপুল পরিমাণ পাওনা বকেয়া পড়েছে ভারতীয় কোম্পানি আদানি গ্রুপের। এ বিল পরিশোধে এরই মধ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে সতর্কবার্তা দিয়েছে আদানি। আদানি ছাড়াও ভারত থেকে দেশটির সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশে দ্বিপক্ষীয় বিদ্যুৎ বাণিজ্য চুক্তির আওতায় আনা হচ্ছে আরো ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। সেখানেও বকেয়া পড়ছে। এ বিপুল পরিমাণ বকেয়ার কারণে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় বিঘ্ন এমনকি বন্ধ হয়ে পড়ারও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। 

বিপিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, দেশটি থেকে সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে জরুরি ভিত্তিতে তাৎক্ষণিকভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলার মতো সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাংলাদেশে আছে। যদিও আশঙ্কা রয়েছে এগুলো চালানোর জন্য পর্যাপ্ত জ্বালানির সংস্থান করা নিয়ে। এ ধরনের সমস্যা দেখা দিলে জ্বালানি সংকটের কারণে বিপিডিবি তা তাৎক্ষণিকভাবে মোকাবেলা করতে পারবে কিনা সে বিষয়ে বড় ধরনের সংশয় রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

বাংলাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা গড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াটের আশপাশে। ভারতের সঙ্গে আমদানি চুক্তি রয়েছে ২ হাজার ৭৬০ মেগাওয়াটের (আদানি ও জিটুজি মিলিয়ে), যা চাহিদার ২০ শতাংশের কাছাকাছি। এর মধ্যে আদানি গ্রুপে ও ভারত সরকারের সঙ্গে জিটুজি চুক্তির আওতায় প্রতিবেশী দেশটি মোট ২ হাজার ৭৬০ মেগাওয়াট আসার কথা। বিপিডিবির তথ্য অনুযায়ী, দেশে বিদ্যুতের গড় সরবরাহ প্রায় ১৩ হাজার মেগাওয়াট। এর মধ্যে ভারত থেকে এ সরবরাহ সর্বনিম্ন ২ হাজার থেকে সর্বোচ্চ আড়াই হাজার মেগাওয়াটের মধ্যে ওঠানামা করে। কিন্তু এরই মধ্যে আদানি গ্রুপের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বিক্রি বাবদ কোম্পানিটির পাওনা বেড়েই চলেছে। এ পরিস্থিতিকে ব্যবসা চালানোর জন্য ‘টেকসই নয়’ বলে মনে করছে আদানি গ্রুপ। বকেয়া বেড়ে যাওয়ায় বিপিডিবিকে জিটুজির আওতায় আনা বিদ্যুতের সরবরাহও কমিয়ে দিয়েছে দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলো। বকেয়া পরিশোধ নিয়ে সংকট আরো বাড়লে একপর্যায়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুতের সরবরাহ বন্ধও হয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

এ ধরনের পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক সংকট মোকাবেলায় পর্যাপ্ত জ্বালানির সংস্থান রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল হাসিব চৌধুরী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আকস্মিকভাবে গ্রিড বিপর্যয় ঘটলে কিংবা গ্রিড থেকে বড় কোনো সক্ষমতা আউট হয়ে গেলে তা মোকাবেলার জন্য মোটা দাগে দুটি বিষয় প্রস্তুতি ও পর্যবেক্ষণ থাকতে হয়। এর একটি হলো যে সক্ষমতার সরবরাহ গ্রিডে কমছে, তা পুষিয়ে নেয়ার জন্য অন্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা। এবং সে প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পর্যাপ্ত জ্বালানির সংস্থান রাখা। দ্বিতীয়ত, পাওয়ার প্লান্ট নির্দিষ্ট একটি সময়ে রক্ষণাবেক্ষণে নিতে হয়। ফলে গ্রিড ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সবসময়ই হিসাবটাও রাখতে হয়।’

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ বিপুল পরিমাণ বকেয়া অর্থ এখন অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে ভারতের ঝাড়খন্ডের ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট সক্ষমতা গড্ডা কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ শুধু আদানি গ্রুপের কাছে বাংলাদেশের বকেয়া বেড়ে ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। 

এ-সংক্রান্ত এক বিবৃতিতে আদানি পাওয়ার বলেছে, ‘আর্থিক চাপ সত্ত্বেও আমরা বাংলাদেশে বিদ্যুতের নির্ভরযোগ্য সরবরাহ বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা দেশটির সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি এবং তাদের জানিয়েছি যে পরিস্থিতি আর টেকসই পর্যায়ে নেই। কারণ আমরা একদিকে যেমন বিদ্যুৎ সরবরাহের বিষয়ে প্রতিশ্রুতি বজায় রাখছি, অন্যদিকে তেমনই আমাদের ঋণদাতা ও সরবরাহকারীদের কাছে দেয়া অঙ্গীকারও রয়েছে।’

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সংক্রান্ত মোট দায়ের পরিমাণ এখন ৩৭০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়ে জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেছেন, আদানি বাংলাদেশের কাছে ৮০ কোটি ডলার পায়, তার মধ্যে ৪৯ কোটি ২০ লাখ ডলার পরিশোধ বিলম্বিত হয়েছে।

আদানি পাওয়ারের বাইরে বাংলাদেশ জিটুজি চুক্তির আওতায় ভারত থেকে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট আমদানি চুক্তি রয়েছে। এই বিদ্যুৎ আমদানিতেও বিপুল পরিমাণ বকেয়া রয়েছে। এমনকি ত্রিপুরা দিয়ে আসা ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির বিল পরিশোধ করতে না পারায় এরই মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে ত্রিপুরার বিদ্যুৎ সরবরাহকারী কোম্পানি ত্রিপুরা স্টেট ইলেকট্রিসিটি করপোরেশন লিমিটেড (টিএসইসিএল)।

ভারত থেকে আদানির মাধ্যমে আমদানীকৃত বিদ্যুতের বেশির ভাগ দেশের উত্তরাঞ্চলে সরবরাহ করা হচ্ছে। ওই অঞ্চলে এ মুহূর্তে বড় সক্ষমতার তেমন কোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্র নেই। ফলে কোনো কারণে আমদানি বিদ্যুতের সরবরাহ কমে গেলে সেখানে সরবরাহ করতে হবে জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালিয়ে। কিন্তু এজন্য পর্যাপ্ত জ্বালানির সংস্থান নেই বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও পাওয়ার সেলের সাবেক ডিজি বিডি রহমত উল্লাহ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গ্রিডে বড় কোনো সক্ষমতা ট্রিপ করলে বা অন্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুতের সরবরাহ নিতে হলে সেগুলোর জন্য যে প্রয়োজনীয় জ্বালানি দরকার, সেটি নেই। একই সঙ্গে ভারত থেকে আমদানি বা বিদ্যুৎ সরবরাহ কমে গেলে অথবা বন্ধ হলে তার প্রস্তুতি বিপিডিবির এ মুহূর্তে আছে কিনা, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। বিপিডিবির প্রস্তুতি নেয়া উচিত। কারণ আদানি যেদিন থেকে ভারতীয় গ্রিডে তাদের বিদ্যুৎ সরবরাহ দেয়ার সুযোগ পেয়েছে, তখন থেকেই বিকল্প একটা পরিকল্পনা নেয়ার প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়েছে।’

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বিপিডিবির এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশে জ্বালানি সংকট থাকায় আমদানি বিদ্যুতে নির্ভরতা বেড়েছে। কারণ সেই আমদানির পরিমাণটাও কম নয়। তবে কোনো কারণে সংকট তৈরি হলে জ্বালানি সংকটের যে চিত্র তার তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা বা বিকল্প সরবরাহ সক্ষমতা এ মুহূর্তে তৈরি করা নেই।’

দেশের বিদ্যুতের প্রতিদিন যে চাহিদা তৈরি হচ্ছে তা উৎপাদন করতে গিয়ে দৈনিক গড়ে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং করতে হচ্ছে। বিদ্যুতের সক্ষমতা সাড়ে ২৭ হাজার মেগাওয়াট থাকলেও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা অর্ধেক বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। উচ্চ খরচের কারণে চালানো যাচ্ছে না জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। অন্যদিকে গ্যাসভিত্তিক বৃহৎ সক্ষমতার চারটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রস্তুত হলেও জ্বালানি সংকটের কারণে তা ঠিকমতো চালানো যাচ্ছে না। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মোট সক্ষমতা ২ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। এমনকি বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানো না গেলে কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যাওয়ার মতো ঝুঁকির কথাও উঠে এসেছে।

দেশে বিদ্যুতের ইনস্টল ক্যাপাসিটি ২৭ হাজার ৮০০ মেগাওয়াটের কিছু বেশি। এর মধ্যে শুধু গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা ১২ হাজার ৩০০ মেগাওয়াটের কিছু বেশি। তবে গ্যাস সংকটের কারণে চালানো যায় সবোচ্চ ৫ থেকে সাড়ে ৫ হাজার মেগাওয়াট, বাকি সক্ষমতা ব্যবহার করা যায় না।

অন্যদিকে জ্বালানি তেলভিত্তিক ৬ হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ কেন্দ্র থাকলেও উচ্চমূল্য ও জ্বালানি সংকটে সেগুলোও দেড় থেকে দুই হাজার মেগাওয়াটের বেশি ব্যবহার করা হয় না।

দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের ভূমিকা অন্যতম। গত তিন মাসের বেশি সময় ধরে অপারেশনে নেই সামিটের এলএনজি টার্মিনাল। গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ কমে গেছে দৈনিক ৬০ কোটি ঘনফুট। অন্যদিকে কয়লাভিত্তিক বড় কেন্দ্রগুলো রয়েছে বড় আকারের জ্বালানি সংকটে। বিপুল পরিমাণ বকেয়া থাকায় জ্বালানি তেলও আমদানি করা যাচ্ছে না। এ পরিস্থিতি চলতে থাকায় এরইমধ্যে দিনাজপুরের একমাত্র কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে।  ৫২৫ মেগাওয়াট সক্ষমতার এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে তীব্র প্রেশার ফেলছে সরবরাহ কাযক্রমে। জ্বালানি সংকটে সার উৎপাদনে গ্যাসের সরবরাহ সীমিত হচ্ছে।



সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫