আলোকপাত

কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থান

প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ০৬, ২০২৪

কৌশিক বসু

যে কারোর কল্পনার চেয়ে দ্রুততম সময়ে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতন ঘটেছে। জুলাইয়ের শুরুর দিকে শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরিতে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের যোদ্ধা এবং তাদের সন্তানদের জন্য সংরক্ষিত ৩০ শতাংশ কোটা সংস্কারের প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু করেছিল। বিক্ষোভ দমন করার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেয়া হয় এবং প্রয়োজনে গুলি চালানোর অনুমতিও দেয়া হয়েছিল। ৫ আগস্টের মধ্যে প্রায় ৩০০ জন নিহত হয় এবং সেনাবাহিনীর চাপের মুখে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান। 

ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকট, তরুণদের বেকারত্ব বৃদ্ধি এবং মুদ্রাস্ফীতির মধ্যে বিতর্কিত চাকরির কোটা ব্যবস্থা বিদ্রোহের কারণ হয়ে ওঠে। যদিও বিক্ষোভের কারণ হিসেবে এটি ছাইচাপা আগুনে সামান্য বাতাসের মতো ছিল। বিদ্রোহের পেছনে গুরুতর কারণ ছিল হাসিনার ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদ, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটকে বিপর্যস্ত করেছিল এবং ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতাকে কুক্ষিগত করেছিল। 

গত বছর বাংলাদেশ সফরকালীন আমি এ পরিবর্তন লক্ষ করেছিলাম। সে সময় আমি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের সমর্থকসহ আরো অনেকের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। দলটি শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল। আমি যাদের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা প্রায় সবাই হাসিনার বাড়তে থাকা কর্তৃত্ববাদ, ভিন্নমত সহ্য না করার মনোভাব এবং গণমাধ্যমের প্রতি তার দমনমূলক আচরণের সমালোচনা করেছিলেন। তাদের অনেকেই নিম্নস্বরে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাকালীন নীতি—গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা ধ্বংসের কথা বলে আক্ষেপ করেছিলেন।

এটি দুর্ভাগ্যজনক যে শেখ হাসিনার পতন এভাবে হয়েছে। তিনি একজন সাহসী, ধর্মনিরপেক্ষ নেতা ছিলেন। বাংলাদেশকে ধর্মীয় মৌলবাদ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন যা অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারত। তার শাসনামলে তিনি দেশের অর্থনীতির উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি নিশ্চিতের দায়িত্ব নিয়েছেন। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল, যা ৫-১০ বছর আগেও অসম্ভব মনে হতো। অবশ্য ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ২০১৬ সালে নোট বাতিলের ‍সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী পাঁচ বছরে শ্লথ হয়ে পড়েছিল। কালো টাকা এবং দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের একটি ব্যর্থ প্রচেষ্টা ছিল ওই সিদ্ধান্ত। তবে বাংলাদেশের শক্তিশালী রফতানি ও উন্নয়ন লক্ষ্যও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে দেশটির প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে। 

এ অপ্রত্যাশিত গণ-অভ্যুত্থানের ফলে সৃষ্ট ক্ষমতাশূন্যতা বাংলাদেশের স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করতে পারে। ইতিহাস বারবার দেখিয়েছে যে একটি গণ-অভ্যুত্থান যতই ন্যায়সংগত হোক না কেন, তা ঘটার পর দেশগুলো প্রায়ই অপ্রত্যাশিত দিকে মোড় নেয়। উগ্রপন্থী ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো অবশ্যই ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করবে। যদি এটা ঘটে, তাহলে বাংলাদেশের সফলতার গতিপথ অবরুদ্ধ হতে পারে। 

তবু আশা করার মতো কারণ রয়েছে। যারা গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছে সেই শিক্ষার্থীরা এবং দেশের সামরিক বাহিনী দায়িত্বশীল আচরণ করেছে। সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করার পরিবর্তে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেছে। একটি অন্তর্বর্তী সরকার কতদিন বাংলাদেশের শাসনক্ষমতায় থাকতে পারবে সে সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট নির্দেশনা দেশটির সংবিধানে উল্লেখ নেই। কিছু লোক দ্রুত নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছেন, তবে আমার মনে হয় যে তা আগামী গ্রীষ্ম পর্যন্ত বিলম্বিত করা উচিত। জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার প্রয়োজন। 

বিশ্বে অর্থনৈতিক সাফল্যের গল্পগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন উল্লেখযোগ্য। তা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশটির অর্থনীতি ধুঁকে ধুঁকে চলেছে। দেশের দুটি বড় অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ উচ্চ যুব বেকারত্ব ও মুদ্রাস্ফীতি। এসব সংকট কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সমাধান করা যাবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন স্পষ্টতই গত কয়েক বছরে খর্ব করা হয়েছে যা পুনরুদ্ধার করা জরুরি। পাশাপাশি সরকারকে কর্মসংস্থান বাড়ানোর জন্য কিছু রাজস্ব ব্যবস্থার সংশোধন করতে হবে। 

রাজনৈতিক দিক থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষ হওয়া এবং নির্দলীয় হিসেবে গণ্য হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। কিছু গোষ্ঠী আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু এটি করা ঠিক হবে না। বরং যারা অপরাধ করেছে তাদের নির্বাচনে দাঁড়ানোর অনুমতি দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ একটি প্রগতিশীল শক্তি এবং উগ্রবাদের বিরুদ্ধে সেফগার্ড হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। দলটির অনেক সদস্য সাম্প্রতিক বছরগুলোয় শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী অবস্থানের বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু আক্রোশের শিকার হওয়ার ভয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করতে পারেননি। 

শেখ হাসিনার সঙ্গে আমার শেষবার সাক্ষাৎ হয়েছিল বিশ্বব্যাংকে, ২০২৩ সালের ১ মে। সে সময় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডেভিড মালপাস তাকে বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশের মধ্যে ৫০ বছরের অংশীদারত্ব উদযাপন করতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ওয়াশিংটনে ব্যাংকের প্রধান ভবনে যাওয়ার সময় আমাকে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী বাংলাদেশীদের ভিড়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল। বৈঠকে হাসিনা তার চারপাশে এমন একটি দল দ্বারা বেষ্টিত ছিলেন যে দলের কর্মী এবং উপদেষ্টারা তিনি যা কিছু বলেছিলেন তাতে সম্মতি জানিয়েছিলেন। তারা কি সত্যিই হাসিনার সঙ্গে একমত ছিলেন, নাকি দ্বিমত পোষণ করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল?

[স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট-২০২৪]

কৌশিক বসু: বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ; ভারত সরকারের সাবেক প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের অনাবাসিক জ্যেষ্ঠ ফেলো

ভাষান্তর: সাবরিনা স্বর্ণা


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫