এক ডজন কারখানায় ভাংচুর ও আগুন

উদ্বেগে শিল্প মালিকরা

প্রকাশ: আগস্ট ২৭, ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদক

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে টায়ার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গাজী টায়ারের কারখানা। প্রায় ৪৫ একর জমির ওপর স্থাপিত এ কারখানার মালিকানায় রয়েছেন গোলাম দস্তগীর গাজী, যিনি আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী ও স্থানীয় আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। রাজধানীর শান্তিনগর এলাকা থেকে শনিবার রাতে একটি হত্যা মামলায় তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সে খবর প্রচার হতেই পরদিন অর্থাৎ রোববার গাজী টায়ারের কারখানায় লুটপাট শেষে অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। চলমান পরিস্থিতিতে এক ডজন কারখানায় এভাবে ভাংচুর চালানো ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় চরম উদ্বিগ্ন দেশের শিল্প মালিকরা। 

শিল্প অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকার আশুলিয়ায় ৪ আগস্ট পোশাক কারখানাসহ স্থানীয় কয়েকটি ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। এছাড়া আশুলিয়ার জিরানী এলাকায় সিনহা টেক্সটাইল, টঙ্গী-আশুলিয়া-ইপিজেড সড়কের নরসিংহপুর এলাকায় হা-মীম গ্রুপ, বেঙ্গলসহ একাধিক পোশাক কারখানায়ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। আশুলিয়ার চারাবাগ অঞ্চলে ৭ আগস্ট একটি পোশাক কারখানায় হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। রোববার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে আশুলিয়ার এনায়েতপুরের ১৬টি ঝুট গুদামে। 

নারায়ণগঞ্জের জালকুঁড়িতে স্থাপিত এসবি স্টাইলিস্ট গার্মেন্টসের কারখানায় গত ১৯ জুলাই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী মো. শাহজাহানের অভিযোগ, কারখানার ফটক ভেঙে দুর্বৃত্তরা ওইদিন ভেতরে প্রবেশ করে চেয়ার-টেবিল, দরজা-জানালা ভাংচুর চালায়। ল্যাপটপ, কম্পিউটারসহ বিভিন্ন মালপত্র লুট করে। আগুন ধরিয়ে দেয় গার্মেন্টসের ফিনিশড গুডসসহ বিভিন্ন কক্ষে। এরপর বন্ধ হয়ে যায় উৎপাদন। এতে প্রতিষ্ঠানটির শতকোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি এ ব্যবসায়ীর। শুধু এসবি গার্মেন্টস নয়, সানারপাড় এলাকায় অবস্থিত আব্দুল কাদের মিয়ার গার্মেন্টসহ বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে বলে অভিযোগ। 

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধির তথ্য অনুযায়ী, গত ১৯ জুলাই থেকে রোববার পর্যন্ত ভাংচুর ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বেশ কয়েকটি কারখানায়। এর মধ্যে অন্যতম ফতুল্লার কায়েমপুরের ফকির গার্মেন্টস, কতুবপুরের ইউরোটেক্স ও ইভটেক্স; শাসনগাঁওয়ের ক্রোনি গার্মেন্ট; বিসিক শিল্পনগরীর এমবি নিট; সোনারগাঁর প্লাস্টিক রিসাইক্লিং ফ্যাক্টরি ও রূপগঞ্জের গাজী ট্যাংক, গাজী পাম্প, গাজী ডোর, গাজী পাইপ, গাজী টায়ারের কারখানা।

শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঘিরে দুর্বৃত্তরা ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। এক্ষেত্রে বেশির ভাগ কারখানা আক্রান্ত হচ্ছে দুর্বল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির সুযোগে। আর কিছু ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছে কারখানার মালিক পক্ষের রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে। 

এ বিষয়ে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমি মনে করি দুর্বৃত্তরাই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটাচ্ছে। সুযোগসন্ধানীরা পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে। এ ঘটনাগুলোকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেয়া ঠিক হবে না। এক্ষেত্রে সরকারের কঠোর ভূমিকা আমরা প্রত্যাশা করি। কারণ শিল্প-কারখানাগুলো রাষ্ট্রের সম্পদ। এর সঙ্গে হাজার মানুষ, অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জড়িত। ফলে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে। কারখানা যারই হোক, তার যদি দোষ থাকে আইন অনুযায়ী বিচার হবে। কিন্তু ওই ব্যক্তির কোনো শিল্পোৎপাদন যেন ব্যাহত না হয় সে পদক্ষেপ নিতে হবে।’ 

বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় কঠোরভাবে শিল্পের ওপর আঘাত ঠেকাতে হবে জানিয়ে এ ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ‘আমরা দুর্বৃত্তদের কঠোর বিচার চাই। এ বিষয়ে সরকারের শক্তিশালী অবস্থান দেখতে চাই। কারখানাগুলো যেন নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে পারে, প্রয়োজনে তৃতীয় পক্ষ দিয়ে হলেও তা সচল রাখতে হবে। দরকার হলে কমিশন গঠন করে কারখানা সক্রিয় রাখার উদ্যোগ নেয়া হোক।’ 

আন্দোলনের মধ্যে ৪ আগস্ট ঢাকার আশুলিয়ায় চারটি কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে একটি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টার মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপের বেক্সিমকো সিনথেটিক। কারখানাটি গ্রুপটির অন্যতম লাভজনক প্রতিষ্ঠান। অর্থনীতি ও কর্মসংস্থান বিবেচনায় অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও রাজনৈতিক পরিচয়ের জেরেই কারখানাটিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে বলে মনে করছেন শিল্প মালিকরা। তাদের দাবি, এখন পর্যন্ত যে কয়টি ঘটনা ঘটেছে সবগুলোর ভয়াবহতা ছাড়িয়ে গেছে রোববারের গাজী টায়ার ফ্যাক্টরির অগ্নিকাণ্ড। 

স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা গেছে, গাজী টায়ার কারখানার ছয়তলা ভবনের নিচতলায় রোববার রাত ১০টায় আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। এর পরও শত শত মানুষ কারখানার ভেতর ঢুকে মেশিন ও আসবাবপত্র, উৎপাদিত পণ্যসহ বিভিন্ন সামগ্রী লুটে নেয়। একপর্যায়ে চার-পাঁচ শতাধিক লোক ছয়তলা ভবনটির বিভিন্ন ফ্লোরে উঠে লুটপাট চালায়। এর মধ্যে আগুন পুরো ছয়তলা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। তখন ভেতরে আটকে পড়া অনেকেই আর বের হতে পারেননি। 

খবর পেয়ে সাড়ে ১১টা থেকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে আগুন নিয়ন্ত্রণ শুরু করেন। পর্যায়ক্রমে ডেমরা, কাঁচপুর, আদমজী, ইপিজেড ও কাঞ্চন ফায়ার স্টেশন থেকে একে একে যোগ দেয় ১২টি ইউনিট। ভবনটির ভেতরে আটকে পড়াদের মধ্য থেকে ১৪ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। গাজী টায়ার কর্তৃপক্ষ অবশ্য জানিয়েছে, তাদের ফ্যাক্টরিটি বন্ধ ছিল। সেখানে তাদের কোনো শ্রমিক ছিল না। 

শিল্প পুলিশের ডিআইজি আসাদুজ্জামান জানান, এখানে যারা ঢুকেছিল তারা সবাই লুটপাটকারী বলে ধারণা করা হচ্ছে। যেহেতু কারখানাটি বন্ধ ছিল, তাই যারা ভেতরে ঢুকেছে তারা লুটপাটের জন্যই ঢুকেছিল। মূলত দুটি গ্রুপ ফ্যাক্টরিতে ঢুকেছিল। একটি লুটপাট করছিল, আরেকটি আগুন লাগিয়ে দেয়। ফলে লুটপাটে ব্যস্ত থাকা লোকজন বিভিন্ন ফ্লোরে আটকে পড়ে।

অবকাঠামোগত ও ভেতরে থাকা টায়ার উৎপাদনের দাহ্য পদার্থের কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার ব্যাপারটি জটিল হয়ে পড়ে। থেমে থেমে বেশ কয়েকটি বিস্ফোরণের ঘটনায় আশপাশ এলাকা কেঁপে ওঠে। তাতে আশপাশ এলাকায় শিল্প-কারখানা ও এলাকার লোকজনের মাঝে চরম আতঙ্ক বিরাজ করে। টানা ২২ ঘণ্টা চেষ্টার পর গতকাল সন্ধ্যা ৭টার দিকে সে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক লে. কর্নেল রেজাউল।

কারখানার গেটে নিখোঁজদের খুঁজতে আসা স্বজনরা জানান, ভবনটিতে আটকে পড়াদের মধ্যে মুড়াপাড়া দরিকান্দী গ্রামের মামুন, জহিরুল, জাকির হেসেন, স্বাধীন, ইব্রাহিম; তারাব পৌরসভার বরপা গ্রামের স্বপন, আসাদ, সোহাগ, আবু সাঈদ, মানিক, রতন, বকুল, জিন্নাত; মৈকুলী গ্রামের রাজ, ছাব্বির, ফয়েজ ও সুজন রয়েছেন। তাদের বয়স ১৫ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। অন্যদের নাম পাওয়া যায়নি।

লে. কর্নেল রেজাউল করিম বলেন, ‘আমরা নিখোঁজদের একটি খসড়া তালিকা করেছি। এ মুহূর্তে তা যাচাইয়ের কোনো সুযোগ নেই। স্বজনরা যারা দাবি করছেন তাদের নাম-ঠিকানা লিখে রাখছি। সন্ধ্যা পৌনে ৭টা পর্যন্ত এ তালিকায় ১৭৬ জনের নাম লেখা হয়েছে। নিখোঁজের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। তবে তারা কেউ কারখানার শ্রমিক নন। সবাই বহিরাগত।’

ব্যবসায়ীরা মনে করেন, কিছু দুষ্কৃতকারী সুযোগ বুঝে এসব তাণ্ডব চালাচ্ছে। তাদের রুখতে না পারলে পরিস্থিতি আরো কঠিন হয়ে যাবে। তাই দেশে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিতের পাশাপাশি উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা সচল রাখার লক্ষ্যে শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা জোরদারে সেনাবাহিনীর সহযোগিতা চেয়েছেন ব্যবসায়ী নেতারা। এ বিষয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে সম্প্রতি দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) প্রতিনিধি দল সৌজন্য সাক্ষাৎ করে। দেশের সব নাগরিকের পাশাপাশি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিতে অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবেন বলে আশ্বস্ত করেন সেনাপ্রধান। সেই সঙ্গে কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান যেকোনো ধরনের হুমকির শিকার হলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, সাপ্লাই চেইন, বন্দরের নিরাপত্তা প্রদানসহ দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীরা যাতে নির্বিঘ্নে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে সে লক্ষ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সর্বদা তৎপর রয়েছে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫