বাংলাদেশ থেকে ৫০০ কোটি ডলার মূল্যের পোশাকের ক্রয়াদেশ স্থানান্তরের আশায় পাকিস্তান

প্রকাশ: আগস্ট ২১, ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদক

চলতি মাসের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে টানা ২১ দিন বিক্ষুব্ধ ছিল দেশের পরিস্থিতি। এ সময় ইন্টারনেট বন্ধ ও পরিবহন সংকটে ব্যাহত হয়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। কারখানার উৎপাদন ও বন্দর কার্যক্রমের স্থবিরতায় বিঘ্নিত হয়েছে রফতানির প্রধান পণ্য বস্ত্র-পোশাক সংশ্লিষ্ট আমদানি-রফতানি। পণ্য জাহাজীকরণ বিলম্বে বিপাকে পড়েছিলেন পোশাক রফতানিকারকরা। বাণিজ্যিক কার্যক্রম এখন স্বাভাবিক হয়ে আসছে। যদিও বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ওই অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে ক্রেতারা এখান থেকে ৫০০ কোটি ডলার মূল্যের পোশাকের ক্রয়াদেশ পাকিস্তানে স্থানান্তর করবেন বলে প্রত্যাশা দেশটির ব্যবসায়ীদের। 

পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম ডন প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশটির বস্ত্র উৎপাদনকারী কারখানাগুলোর মোট উৎপাদন সক্ষমতার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ অলস বসে আছে। বাংলাদেশ থেকে সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ায় আসন্ন শীত মৌসুমে জোগান নিশ্চিতে পোশাক প্রস্তুত ও ক্রয়ের উৎসে বৈচিত্র্য আনার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে পশ্চিমা ব্র্যান্ড ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো। বিকল্প হিসেবে তারা পাকিস্তানের বস্ত্র ও পোশাক উৎপাদনকারীদের কাছে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। এতে এক বছরের মধ্যে ২০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যবসা বৃদ্ধির প্রত্যাশাও করছেন তারা।

পাকিস্তানের সাবেক অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মন্ত্রী ও অল পাকিস্তান টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (এপিটিএমএ) সাবেক চেয়ারম্যান গওহর ইজাজ বলেন, ‘সম্ভাবনা মাত্র দুই সপ্তাহের। সরকার দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে ক্রয়াদেশ চলে যাবে ভারত, ভিয়েতনাম বা কম্বোডিয়ায়। আনুমানিক হিসাবে পশ্চিমা ব্র্যান্ডগুলো ৫ বিলিয়ন মূল্যের পোশাকের ক্রয়াদেশ বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে স্থানান্তরিত করতে পারে।’

সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে গওহর বলেছেন, ‘জ্বালানির ইউনিটপ্রতি দাম ১৬ সেন্ট এবং রফতানিতে বর্তমান করহারের কারণে বৈশ্বিক সরবরাহ চক্রে আমরা প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে নেই। ৫ বিলিয়ন ডলারের অতিরিক্ত রফতানি আয় অর্জন এবং ৫০ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে টেক্সটাইল উৎপাদনকারীদের জ্বালানি ব্যয় ইউনিটপ্রতি ৯ সেন্ট করার পাশাপাশি ক্রয়াদেশ ধরার সুযোগ কাজে লাগাতে স্থানীয় শিল্পোদ্যোক্তাদের জন্য নীতি সুবিধা নিশ্চিতের বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন।’

বাংলাদেশী পোশাক খাতসংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধিরাও বলছেন, কিছু ক্রয়াদেশ স্থানান্তরের আভাস পাওয়া গেছে। তবে এর পরিমাণ ৫০০ কোটি ডলার হওয়া নিয়ে ভিন্ন মত রয়েছে তাদের। 

তারা বলছেন, অনেক ক্রেতারই বাংলাদেশে স্থানীয় কার্যালয় রয়েছে। ফলে ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরাই এখানকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে পারছে। আমদানি-রফতানি কার্যক্রম এখন স্বাভাবিক হওয়ার পথে থাকলেও সার্বিক পরিস্থিতির ওপর সতর্ক নজর রাখছেন তারা। এতে আগামী মৌসুমের ক্রয়াদেশ কিছুটা হলেও কমার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।

বিজিএমইএ সহসভাপতি আবদুল্লাহ হিল রাকিব বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ব্যবসা বিঘ্নিত হওয়ার চেয়ে বড় বিষয় ভবিষ্যৎ ব্যবসার সুরক্ষা। এক সপ্তাহ বা ২০ দিনে যে ব্যাঘাত ঘটেছে, সেটা হয়তো কিছু এয়ারশিপমেন্ট হবে, কিছু ডিসকাউন্ট হবে, কিছু লস হবে। এগুলো এরই মধ্যে হচ্ছে। আমার নিজেরই বেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে শিপমেন্ট আকাশপথে পাঠাতে হচ্ছে। এগুলো ব্যবসার অংশ, কিছু করার নেই।’

তিনি আরো বলেন, ‘কিন্তু বর্তমানে যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে এ অবস্থায় ক্রেতারা অনিশ্চিত বোধ করলে একটা মৌসুম ক্রয়াদেশ দেয়া থেকে বিরত থাকতে পারে। এ অস্থিরতার মধ্যে উৎপাদন করা যাবে কি যাবে না, বিষয়টি নিয়ে যদি আমরা অতিসত্বর ক্রেতাদের আস্থা না দিতে পারি, সেক্ষেত্রে ক্রেতারা কৌশলী হবেন। কিছু ক্রয়াদেশ বেশি দাম দিয়ে হলেও আমাদের প্রতিযোগী দেশ চীন, ভিয়েতনাম, ভারত, পাকিস্তানে দিতে পারেন তারা। পাকিস্তান যে ক্রয়াদেশ ধরার প্রত্যাশা করছে, সেটা ৫ না হয়ে ২ বিলিয়ন ডলার হলেও লস। কিন্তু পাকিস্তান, ভারত ক্রয়াদেশ প্রাপ্তির এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে চাইছে।’

বিষয়টি অনেকাংশেই কারখানা কর্তৃপক্ষের ক্রয়াদেশ ব্যবস্থাপনা সক্ষমতার ওপর নির্ভর করছে বলে মনে করেন দেশের অন্যতম বৃহৎ পোশাক রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘পরবর্তী মৌসুমের ক্রয়াদেশ ধরে রাখা নির্ভর করবে কারখানা কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা সক্ষমতার ওপর। বিরাজমান পরিস্থিতির মধ্যে সক্ষমতা প্রমাণ করে ভালো এমন কিছু কারখানা হয়তো এ পরিস্থিতির মধ্যে থেকেও আসন্ন মৌসুমে ক্রয়াদেশ বেশি পেতে পারে। আর যে কারখানা কর্তৃপক্ষ সার্বিক পরিস্থিতির প্রভাবে ক্রয়াদেশ অনুযায়ী উৎপাদন ও জাহাজীকরণের অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ক্রেতার আস্থা ধরে রাখতে ব্যর্থ হবে তার ক্রয়াদেশ কমে যাবে। ৫ বিলিয়ন ডলারের ক্রয়াদেশের বিষয়ে বলা হচ্ছে, এতটা না হলেও কিছু ক্ষতি হবে। খুচরা বিক্রয় কেন্দ্র এখন খুব সতর্কতার সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।’ 

আবার বাংলাদেশে স্থানীয় কার্যালয় স্থাপন করা রয়েছে এমন একাধিক পোশাক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরাও ৫ বিলিয়ন ডলারের ক্রয়াদেশ স্থানান্তরের শঙ্কা উড়িয়ে দিতে পারছেন না। তাদের ভাষ্যমতে, এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে অতিরঞ্জিত তথ্য ছড়িয়ে পড়ায়। পাশাপাশি পোশাক শিল্প সংগঠনগুলোর মধ্যকার রাজনৈতিক দ্বন্দ্বও এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। 

বাংলাদেশী পোশাকের বৃহৎ এক ইউরোপভিত্তিক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের কান্ট্রি ম্যানেজার নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের বিরাজমান পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অতিরঞ্জিত তথ্য ছড়াচ্ছে পোশাক পণ্য রফতানিতে প্রতিযোগী দেশগুলো। আর স্থানীয় পর্যায়ে পোশাক খাতের ব্যবসায়ীদের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সে অতিরঞ্জিত তথ্যকে জোরালো করে তুলছে। তবে এটা ঠিক যে ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান ও তাদের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের পরিস্থিতি এখন কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। তারা নতুন ক্রয়াদেশ নিয়ে আলোচনায় ধীরে চলো নীতি গ্রহণ করেছেন। এ সতর্কতার প্রভাব পড়বে আসন্ন মৌসুমের ক্রয়াদেশে, যার জেরে ৫ বিলিয়ন ক্রয়াদেশ স্থানান্তর হওয়া একেবারে অস্বাভাবিকও না।’

ডনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘এইচঅ্যান্ডএম, ডিক্যাথলন, ইউনিক্লোসহ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ক্রেতারা আসন্ন শীতকালীন পোশাক ক্রয়ের উৎস নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে। এতে পাকিস্তানের বস্ত্র ও পোশাকসংশ্লিষ্টরা আশাবাদী হয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে শুরু করেছেন। তারা মনে করছেন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক সরবরাহকারী দেশ বাংলাদেশ থেকে ক্রয়াদেশ স্থানান্তরের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে পাকিস্তান সরকার। অতিরিক্ত ক্রয়াদেশের সুযোগ কাজে লাগাতে মরিয়া উদ্যোক্তারা মনে করছেন বাংলাদেশের পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত স্থিতিশীল হলেও এতে সময় লাগবে।’ 

জানতে চাইলে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কিছু ক্ষতি এরই মধ্যে হয়ে গেছে। গত এক মাসে যে অস্থিরতা ছিল, এতে ক্রেতারা অস্বস্তিতে পড়বেন। কিন্তু বিষয়টি সাময়িক। স্থায়ী বা দীর্ঘমেয়াদি হবে না। পোশাক খাতের ক্রয়াদেশকে আমরা যদি চারটা মৌসুমে ভাগ করি তাহলে প্রতি মৌসুমে ১০ বিলিয়ন ডলারের মতো ক্রয়াদেশের কাজ আমরা করে থাকি। এ হিসাব বিবেচনায় নিলে একটি মৌসুমে ক্রয়াদেশ দেড় থেকে ২ বিলিয়ন ডলার কমতে পারে। তবে আমরা যদি দ্রুত সবকিছু গুছিয়ে ফেলতে পারি, অর্থাৎ যে অস্থিরতা আছে, যে সমস্যাগুলো আগেও ছিল যেমন গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ কম—বিষয়গুলো নিয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারি তাহলে পরিস্থিতি আমাদের অনুকূলেই থাকবে।’


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫