সেন্সর বোর্ড বাতিল চান অধিকাংশ তারকা

প্রকাশ: আগস্ট ১৭, ২০২৪

অহিদুর রহমান

সেন্সর বোর্ড এটা একটা প্রাগৈতিহাসিক প্রথা, যা দিয়ে সিনেমা কিংবা শিল্পচর্চাকে আটকে দেয়া হয়। পৃথিবীর কোথাও সেন্সর বোর্ড নেই। সেন্সর বোর্ড ঠিক করে দিতে পারে না দর্শক কী দেখবে আর কী দেখবে না। বিভিন্ন দেশে সার্টিফিকেশন বোর্ড আছে। সার্টিফেকশন বোর্ড থেকে সিনেমার গ্রেডিং দিয়ে দেয়া হয়, আমাদের এখানেও সে চর্চাই হওয়া উচিত। এমনটাই মনে করছেন তারকারা। 

তবে ভিন্ন মত পোষন করেন অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন। এ বিষয়ে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সেন্সর প্রথা বাতিলের পক্ষে আমি বলব না। তবে সেন্সর বোর্ডে যারা থাকবেন তাদের মনমানসিকতা এবং যোগ্যতা দেখে যেন বসানো হয়। নতুন সরকারের কাছে চলচ্চিত্রের উন্নয়ন, সংস্কার সম্পর্কে কোনো প্রত্যাশা আছে কিনা তা জানতে চাইলে ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন ‘সিনেমার উন্নয়নের জন্য দেশের যেসব সিনেমা হল বন্ধ আছে এগুলো খুলতে হবে এবং আধুনিকায়ন করতে হবে। কারণ অনেক আগের সিনেমা হলগুলোর এত জীর্ণ দশা যে এমন সিনেমা হলে আসলে মানুষ সিনেমা দেখতে চায় না।

সরকার যে পদ্ধতিতে অনুদান দিচ্ছে তা বন্ধ করে দিয়ে একটা কমিটি করতে হবে যারা স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করবে। সে কমিটির মাধ্যমে একটি বড় অংকের অর্থ ব্যাংকে রাখতে হবে। সে ব্যাংকের অর্থ দিয়ে প্রথম বছর ২০টি সিনেমা তৈরি করা, এ কমিটিই গল্প নির্ধারণ করবে, তারাই শিল্পী নির্বাচন করবে, প্রথম বছরের মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমার টাকাটা আবার ব্যাংকে চলে যাবে। এই সিনেমাগুলোর মুক্তির মধ্য দিয়ে আরো নতুন ২০টি সিনেমা তৈরি হবে। আমি মনে করি, এভাবে অনুদান না দিয়ে সিনেমা বানানোর জন্য একবারই একটা মোটা টাকা বরাদ্দ করলে সিনেমা মুক্তির পর আবার টাকাটা ব্যাংকে চলে গেলে এ টাকায় আবার আরো সিনেমা নির্মাণ করা যাবে। একসঙ্গে যদি ১ হাজার কোটি টাকা কিংবা ৫০০ কোটি টাকা দেয়া যায় তাহলে এ টাকা থেকেও একটা লাভের পরিমাণ আসবে, এটাও ব্যাংকে জমা হলো, এ অর্থ দিয়ে যদি বছরে ২০-২৫টি সিনেমা তৈরি হয় তাহলে মানুষ কাজ করতে পারবে এবং সিনেমা হলগুলো খুলবে, আধুনিকায়ন হবে। এ পদ্ধতিতে কাজ করলে হয়তো সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচানো যেতে পারে।’ 

সরকারি অনুদান দেয়া ও নেয়ার সময় শর্ত জুড়ে দেয়া হয় শিল্পসম্মত সিনেমা বানাতে। এ নিয়ে ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘শিল্পসম্মত সিনেমা বানাতে হলে এটা যদি ব্যবসায়িক না হয় তাহলে তো সেটা লস হবে। এ বিষয়ও মাথায় রাখতে হবে স্বাভাবিক সিনেমা বানাতে যা সবার কাছে পছন্দ হয়। শুধু শিল্পসম্মত নাম দিয়ে ইন্ডাস্ট্রিকে দাঁড় করা যাবে না। ইন্ডাস্ট্রিকে দাঁড় করাতে হলে অবশ্যই ব্যবসায়িক সিনেমা তৈরি করতে হবে। আমি নিজেই চলচ্চিত্রে এসেছি শিল্পসম্মত সিনেমা আর্টিস্ট হিসেবে, পরবর্তী সময়ে ব্যবসায়িক সিনেমা দিয়েই আমার সিনেমায় উত্থান হয়েছে। অতএব ইন্ডাস্ট্রিকে দাঁড় করাতে হলে ব্যবসায়িক সিনেমা বানাতে হবে।’ 

অভিনেতা, নির্মাতা, প্রযোজক মনোজ প্রামাণিক চলচ্চিত্র নিয়ে তার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন বণিক বার্তার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে যে সেন্সর প্রথা চালু আছে তা বাতিল করে সারা বিশ্বে যে গ্রেডিং সিস্টেম চালু আছে তা চালু করতে হবে। সেন্সরের মাধ্যমে একটি বক্তব্যকে থামিয়ে রাখা হচ্ছে। একটি সিনেমায় অনেক টাকা লগ্নি করা হয়। অনেক সময় দেখা যায় সেন্সর বোর্ডে সিনেমাটি আটকে দেয়া হচ্ছে। তাই আমি বলব, চলচ্চিত্র বিভিন্ন রকমের হতেই পারে সেটাকে সেন্সর না করে গ্রেডিং করা। গ্রেডিং করলে এটা কোন ধরনের সিনেমা, কারা দেখতে পারবে সেটা মানুষ জেনে-বুঝে দেখতে যাবে। প্রথমে গ্রেডিং থাকবে যে এটা কারা দেখতে পারবে বা এত বছর বয়স থেকে এত বছরের মানুষ দেখতে পারবে, অথবা কেউ পছন্দ না করলে দেখবে না। এ ব্যবস্থা করা গেলে অনেক ভালো। এছাড়া অবকাঠামোগত অনেক উন্নয়ন দরকার। যেমন এফডিসিকে নতুন করে ঢেলে সাজানো, একটা চেইন কমিশন তৈরি করা। নানা ধরনের সাপোর্ট সিস্টেম তৈরি করা, চলচ্চিত্রে বিনিয়োগ বাড়ানো, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশে যে সিনেমা হলগুলো আছে সেগুলো হয় সংস্কার করা, না হয় নতুন করে সিনেমা হল তৈরি করা। এ রকম অসংখ্য বিষয় আছে আমাদের চলচ্চিত্রে, যা সংস্কার করা প্রয়োজন।’

আগামী দিনে চলচ্চিত্রের সংস্কার নিয়ে নির্মাতা আশফাক নিপুণ বণিক বার্তাকে জানান, সেন্সর বোর্ড এটা একটা প্রাগৈতিহাসিক প্রথা, যা দিয়ে সিনেমা কিংবা শিল্পচর্চাকে আটকে দেয়া হয়। ‘শনিবার বিকেল’, ‘নমুনা’, ‘মাই বাইসাইকেল’, ‘কাঠগোলাপ’, ‘অমীমাংসিত’ কোনো কারণ ছাড়াই আটকে দেয়া হয়েছে। আবার অনেক সিনেমা কাটছাঁট করা হয়। এ পুরো প্রথাই শিল্পের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। শিল্পীর কাজ হচ্ছে উন্মুক্তভাবে শিল্পচর্চা করা।

সেন্সর বোর্ডের ন্যারেটিভের মধ্যে শিল্পীর চিন্তাকে বন্দি রাখার চেষ্টা করা হয়। কেউ কেউ বলেন, ‘সেন্সর বোর্ড না থাকলে অশ্লীলতা চরম আকার ধারণ করবে। কাটপিসের যুগেও কিন্তু সেন্সর বোর্ড ছিল। কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।’

আবার ওটিটির শুরুর দিকে কেউ কেউ বলছিলেন, ওটিটিতে অশ্লীলতা প্রচার করা হচ্ছে; ওটিটি বন্ধ করা হোক কিংবা নীতিমালা করা হোক। পরে কিন্তু কোনো নীতিমালা ছাড়া, সেন্সরশিপ ছাড়াই ‘মহানগর’, ‘কারাগার’, ‘কাইজার’, ‘নেটওয়ার্কের বাইরে’র মতো কাজ এসেছে। এগুলো দর্শক গ্রহণ করেছে। দর্শক ‘মহানগর ৩’-ও চাইছে। এগুলো কোনো নীতিমালা কিংবা সেন্সর বোর্ড দিয়ে আটকানো হয়নি। যেটা গ্রহণ করার, সেটা দর্শক গ্রহণ করবেই।

পৃথিবীর কোথাও সেন্সর বোর্ড নেই। সেন্সর বোর্ড ঠিক করে দিতে পারে না দর্শকরা কী দেখবে আর কী দেখবে না। 

অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চলচ্চিত্র অঙ্গনে প্রচুর সংস্কার প্রয়োজন। আমি প্রথমেই বলতে চাই, এ জায়গা খুবই গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে, আমাদের মিডিয়ায় কিছু প্রডাকশন হাউজ, প্রযোজক, পরিচালক ও কিছু অভিনয়শিল্পী আছেন যাদের আচরণ খুবই স্বৈরাচারী। তারা ভীষণভাবে মিডিয়াকে প্রভাবিত ও কলুষিত করেছেন। তাদের হাত থেকে মিডিয়াকে রক্ষা করতে হবে। শিল্পীদের রাষ্ট্র থেকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। আমাদের ইনস্টিটিউশন লাগবে। এছাড়া আরো অনেক ধরনের সংস্কার প্রয়োজন।’


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫