বছরের ব্যবধানে দক্ষিণ-পশ্চিমের তিন জেলায় কমেছে পাট চাষ

প্রকাশ: জুলাই ২৭, ২০২৪

শুভব্রত আমান, কুষ্টিয়া

একটা সময় পাট উৎপাদনে বড় ভূমিকা রাখত কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ ও মেহেরপুর। এক বছরের ব্যবধানে সোনালি আঁশখ্যাত এ ফসলটির আবাদ কমেছে দক্ষিণ-পশ্চিমের এ তিন জেলায়। মাটির উর্বরতা পাট চাষের অনুকূলে থাকা সত্ত্বেও আবাদ কম হওয়ায় চিন্তিত সংশ্লিষ্টরা।

কারণ হিসেবে কৃষকরা বলছেন, গত কয়েক বছরে আবহাওয়া পরিবর্তন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বৃষ্টিপাত কমে যাওয়া, পাট পচাতে পর্যাপ্ত পানির অভাব, ন্যায্য দাম না পাওয়া, সার, কীটনাশকের দাম নাগালের বাইরে যাওয়া এবং উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় পাট চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন এখানকার কৃষক। পাট পচাতে কৃষি অফিস যে রিবন রেটিং পদ্ধতির কথা বলছে, তা অনুসরণ করলে পাটের রঙ নষ্ট হয়ে যায় এবং বাজারে দাম কমে যায়।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আবহাওয়া প্রতিকূল হয়ে ওঠা ও পাট পচানোর জলাশয় ব্যাপক কমে গেছে এ জেলাগুলোয়। কৃষক সাধারণত পাট কেটে সরকারি অথবা ব্যক্তিমালিকানার বিভিন্ন পরিত্যক্ত জলাশয় বা ডোবায় পাট পচানোর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। তবে সারা দেশের মতো এসব জেলায় জলাশয় বা ডোবা ভরাট হয়ে গেছে। যেসব জলাশয় রয়েছে, সেগুলোয়ও পানি নেই। কোনো কোনো এলাকায় কেউ কেউ শ্যালো মেশিন দিয়ে পানি উত্তোলন করে তা জলাশয়ে জমা করে পাট জাগ দিচ্ছেন। এতে খরচ বেশি হওয়ায় লাভের অংক কমে যাওয়ার শঙ্কায় অনেক কৃষক।

কুষ্টিয়া জেলা পাট অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় চলতি বছর পাট চাষ হয়েছে ৮৬ হাজার হেক্টর জমিতে। তবে চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ লাখ ১৫ হাজার হেক্টর। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ২৯ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ কমেছে। গত বছর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল এক লাখ একর। কিন্তু আবাদ হয়েছিল ১ লাখ ১৫ হেক্টর জমিতে।

কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার আমলা গ্রামের কৃষক আতাউর রহমান বলেন, ‘বিঘাপ্রতি গড়ে ১৩ হাজার টাকা করে খরচ হয়েছে। শ্যালো মেশিনে পানি দিয়ে পাট জাগ দিয়েছি। বিঘাপ্রতি গড়ে ৯-১০ মণ পাট পাওয়া যাচ্ছে। পুরো খরচ তুলতে হলে প্রতি মণ পাট আড়াই হাজার টাকার ওপরে বিক্রি করতে হবে। যদি পাটের দাম পড়ে যায় তাহলে লোকসান হবে।’

খোকসা উপজেলার গোপগ্রামের কৃষক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘তাপপ্রবাহের সময় রোদ ও গরমের কারণে মাঠেই পাট নষ্ট হয়েছে। অনেকের জমিতে পাট বাড়েনি। এজন্য এবার আবাদ কম হয়েছে।’

কুষ্টিয়ার পাট ব্যবসায়ী বদর উদ্দিন বলেন, ‘গত বছর থেকে পাট কেনা কমিয়ে দিয়েছি। কারণ গুদামে এখনো গত বছরের পাট পড়ে রয়েছে। এ বছরও মিলগুলোয় পাটের চাহিদা কম। দাম আবারো কমতে পারে। সেই আশঙ্কায় আপাতত পাট ক্রয় করছি না।’

কুষ্টিয়া জেলা মুখ্য পাট পরিদর্শক সোহরাব উদ্দিন বলেন, ‘এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় পাট আবাদ কমেছে। তবে তা বাড়াতে কৃষককে সার ও বীজ বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে।’ আগামীতে আবাদ বাড়বে বলে আশা করেন তিনি।

এদিকে মেহেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র বলছে, জেলায় এ বছর ২২ হাজার হেক্টর জমিতে পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও আবাদ হয়েছে ১৬ হাজার ৬৩০ হেক্টরে। গত বছর আবাদ হয় ২২ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে। পাট ফসলের জন্য সহনীয় তাপমাত্রা ১৮-৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অথচ প্রতি বছরই পাটা চাষের মৌসুমে মেহেরপুরে তাপমাত্রা বিরাজ করে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর, সঙ্গে রয়েছে অনাবৃষ্টি। এতে পাটখেতে পোকার আক্রমণ দেখা দেয়। পোকা দমনের প্রায় সব ওষুধের দামও বিগত দুই বছরে বেড়েছে। মূলত এসব কারণে এ অঞ্চলে পাট চাষ কমেছে।

এছাড়া চলতি মৌসুমে ঝিনাইদহে পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ২৩ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে। তবে চাষ হয়েছে ২২ হাজার ৫২৪ হেক্টর জমিতে। গত বছর আবাদ হয়েছিল ২৪ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে।

কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহাবুব আলম রনি জানান, এ এলাকার মাটি পাটচাষের উপযোগী। একসময় রেকর্ড পরিমাণ পাট চাষ হতো। নদী, খাল-বিল ও জলাশয়ে পর্যাপ্ত পাওয়া যেত। কৃষক সেখানে পাট জাগ দিতেন। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। নদী, খাল-বিল ও জলাশয়ে পানি না থাকায় পাট পচাতে বেগ পেতে হয় কৃষকের। এ কারণে কৃষক পাট চাষ কমিয়ে দিয়েছেন।

একই কথা বলেন, জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ষষ্টি চন্দ্র রায়। তিনি বলেন, ‘প্রকৃতির ওপর তো হাত নেই। অন্য উপায়ে যেমন—শ্যালো মেশিন দিয়ে পানি উত্তোলন করে পাট জাগ দেয়া যায়। কিন্তু এতে কৃষকের খরচ আরো বেড়ে যাবে। প্রত্যাশিত দাম না পেলে তারা আরেক দফা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।’

শৈলকুপা উপজেলার সারুটিয়া গ্রামের পাটচাষী আবিদ হোসেন বলেন, ‘এক একর জমিতে পাট চাষ করেছি। ফলনও বেশ ভালো হয়েছে। কিন্তু পানির অভাবে পাট কেটে জাগ দিতে পারছি না। একটা পুকুর ভাড়া নিয়েছি। মেশিনে সেচ দিয়ে পানি ভরে তাতে পাট জাগ দিয়েছি। এটা ব্যয়বহুল। কত টাকা মণ দরে পাট বিক্রি করলে লোকসান হবে না, সে হিসাব মেলাতে পারছি না।’


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫