রওনক জাহান একজন উচ্চপদস্থ সফল ব্যাংকার। ইদানীং একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বশীল থাকায় কাজের চাপ অত্যন্ত বেশি। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর ওনার অনেক মাথাব্যথা হয়। পরে আস্তে আস্তে সহনীয় পর্যায়ে-আসে। উনি ধারণা করছেন সম্ভবত কাজের চাপে উনার মাথাব্যথা হচ্ছে। তিনি অ্যান্টি-অ্যাংজাইটি গ্রহণ করেন। তার মাথা ব্যথার কোনো রকম হেরফের হয় না।
পেশাগতভাবে পারফেকশনিস্ট রওনক জাহানের কাজে ছোটখাটো ভুল হতে থাকে। তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে তিনি কিছুটা মন্থর হতে থাকেন। উনার জ্ঞানমূলক দক্ষতা হ্রাস পায়। এক পর্যায়ে উনার হাতের লেখা খারাপ হতে থাকে। ডান হাতের গ্রিপ কিছুটা দুর্বল হয়। ডান পায়ের মুভমেন্টে কিছুটা আড়ষ্ঠতা দেখা যায়। চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছি-যাব করেও কাজের চাপে আর যাওয়া হচ্ছে না।
একদিন, শুক্রবার ছুটির দিন। রওনক জাহান প্রচণ্ড মাথাব্যথা নিয়ে ঘুম থেকে ওঠেন। উনার বমি হয়। একসময় উনার খিঁচুনি হয়। চিকিৎসক ছোট বোন দেখতে আসেন। তিনি রওনক জাহানকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে ব্রেনের এমআরআই করান। দুর্ভাগ্যক্রমে ব্রেন টিউমার ধরা পড়ে।
মাথাব্যথার শুরুতে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বললে হয়তো ব্রেন টিউমার আগেই ধরা পড়ত। ব্রেন টিউমার যত তাড়াতাড়ি নির্ণয় হবে, রোগী তত কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তার ট্রিটমেন্ট আউটকাম তত ভালো হয়।
উপরোক্ত লক্ষণ ছাড়াও ব্রেন টিউমারের রোগী দৃষ্টিশক্তির সমস্যা, শোনার সমস্যা, মাথা ঘোরানো, কথা বলার সমস্যা ইত্যাদি হরেক রকম সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে আসতে পারে।
উপরোক্ত সমস্যাগুলো স্ট্রোকেও থাকতে পারে। তবে ব্রেন টিউমারের সমস্যাগুলো ধীরে ধীরে প্রকাশিত হতে থাকে।
ব্রেন টিউমার—উৎস অনুযায়ী দুই রকম হতে পারে। ১. প্রাইমারি ব্রেন টিউমার—ব্রেন ও ব্রেন রিলেটেড স্ট্রাকচারে উদ্ভূত টিউমার
২. সেকেন্ডারি ব্রেন টিউমার—শরীরের অন্য কোনো অংশের টিউমার, যা ব্রেনে ছড়িয়ে যায়।
সাধারণত নিম্নলিখিত ক্যান্সারগুলো ‘ব্রেন মেটাস্টোসিস’ করতে পারে বা ব্রেনে ছড়িয়ে পড়তে পারে- ফুসফুসের ক্যান্সার, ব্রেস্ট ক্যান্সার, ম্যালিগন্যান্ট মেলানোমা নামে এক ধরনের ক্যান্সার (যা চামড়ায় হয়), পরিপাক নালির ক্যান্সার, কিডনির ক্যান্সার, প্রস্টেটের ক্যান্সার, থাইরয়েড ক্যান্সার
প্রাইমারি ব্রেন টিউমার অর্থাৎ ব্রেন বা ব্রেন রিলেটেড স্ট্রাকচার থেকে উদ্ভূত টিউমার অনেক রকমের হয়ে থাকে। যেমন অ্যাস্ট্রোসাইটোমা, অলিগো ডেনড্রোগ্লায়োমা, এনে এপেনডাইমা, মেডুলোব্লাস্টোমা, সোয়ানোমা, পিটুইটারি এডেনোমা ইত্যাদি।
তাদের বৈশিষ্ট্য আলাদা, ব্রেনে আক্রান্ত হওয়ার স্থানও আলাদা। নিউরোইমেজিংয়ে চেহারা আলাদা, ট্রিটমেন্ট-আউটকাম আলাদা।
পিটুইটারি টিউমার মানবদেহে হরমোন ব্যালান্সের সমস্যা তৈরি করতে পারে। চোখের নার্ভে চাপ দিয়ে দৃষ্টিশক্তির সমস্যা তৈরি করতে পারে।
মেডুলোক্লাস্টোমা, ক্রেনিওফেরিনজিওমা শিশুদের ক্ষেত্রে দেখা যায়। অর্থাৎ বড়দের পাশাপাশি শিশুদেরও ব্রেন টিউমার হয়।
বিভিন্ন ধরনের ব্রেন টিউমারের বিভিন্ন ধরনের বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। প্রতিটি টিউমারের এমআরটি/সিটি স্ক্যান ইমেজ আলাদা।
চিকিৎসার জন্য আলাদা করে টিউমার চেনা অত্যন্ত জরুরি। সাধারণত কালারসহ (contrast) ব্রেনের সিটি স্ক্যান/এমআরআই করে ব্রেন টিউমার ডায়াগনোসিস করা হয়। এমআরএস নামে একটি পরীক্ষারও প্রয়োজন হয়। খুব অল্প ক্ষেত্রে বায়োপসি করার প্রয়োজন হতে পারে।
অন্য সোর্স থেকে ব্রেনে যে টিউমার *(ব্রেন মেটাস্টেসিস), সেই টিউমারের প্রাইমারি সোর্স জানাটা ও চিকিৎসার জন্য জরুরি। ফুসফুস, ব্রেস্ট, প্রস্টেট, পরিপাক নালি, কিডনি, স্ক্রিন ইত্যাদি অঙ্গ থেকে ব্রেনে ক্যান্সার ছড়াতে পারে বিধায় এর পরীক্ষা-নিরীক্ষা জরুরি। প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের জন্য আলাদাভাবে বিশেষ বিশেষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা রয়েছে।
চিকিৎসা
ব্রেন টিউমারের চিকিৎসার ক্ষেত্রে দুটি দিকে লক্ষ রাখা হয়
১. সিম্পটোমেটিক চিকিৎসা—
(ব্রেন টিউমার যে রোগ লক্ষণগুলো তৈরি করে—মাথাব্যথা, খিঁচুনি, অবশ হয়ে যাওয়া) ইত্যাদি সেই রোগ লক্ষণগুলোর চিকিৎসা করা হয়।
২. সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা—
সাধারণত সার্জারি-ই-ব্রেন টিউমারের সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা। পাশাপাশি বিশেষ ক্ষেত্রে রেডিওথেরাপি কেমোথেরাপিও প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।
এছাড়া ব্রেন মেটাস্টেসিসের ক্ষেত্রে প্রাথমিক ক্যান্সার সোর্সের (যে অঙ্গ থেকে ব্রেনে ক্যান্সারের বিস্তার ঘটেছে) চিকিৎসা করা হয়।
মাথাব্যথা হলো ব্রেন টিউমারের সবচেয়ে পরিচিত লক্ষণ। যদিও অনেক কারণেই মাথাব্যথা হতে পারে। মাথাব্যথা মানেই ব্রেন টিউমার, বিষয়টি এ রকম নয়। তবে মাথাব্যথাকে অবহেলা করার সুযোগ নেই। মাথাব্যথা বা অন্য কোনো লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসকের সেবা নিন। বিশেষ প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতামত নিন। ব্রেন টিউমারের দ্রুত ডায়াগনোসিস এর চিকিৎসার পথ আরো সুগম করবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, নিউরোলজি বিভাগ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ