দুই দশকে গ্যালারি কায়া

প্রকাশ: জুলাই ১০, ২০২৪

হাসনাত মোবারক

সড়ক ১৬, বাড়ির নম্বর ২০, সেক্টর ৪, উত্তরা, ঢাকা। ফোনের ওপাশ থেকে এভাবে কথাগুলো জানালেন দায়িত্বরত ব্যক্তি। ২০ নম্বর সেই বাড়ির পরিচয় ‘গ্যালারি কায়া’। এটি শিল্প ও শিল্পীর বাড়ি হিসেবে শিল্পজনের কাছে পরিচিত। বরেণ্য শিল্পীদের চিত্রকর্ম নিয়ে এখানে প্রায়ই প্রদর্শনী চলে। এখন বাড়িটির ২০ বছর পূর্তিতে চিত্রকর্মের প্রদর্শনী চলছে। ইট-কাঠের ব্যস্ত এ নগরীর একদিকে ব্যয়ের ভারে ন্যুব্জ। অন্যদিকে শিল্প ও শিল্পীদের প্রতি সমাজের অধিকাংশ মানুষের চোখরাঙানি; এ কথা তো অস্বীকার করার উপায়ও নেই। অর্থাৎ প্রতিপক্ষ আর প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে একটি প্রতিষ্ঠান ২০ বছর পার করল। ঘটনাটি বাংলাদেশের জন্য আনন্দের সংবাদ বটে।

যা হোক, শিল্পকর্মের প্রদর্শনী উপলক্ষে যাওয়া সেখানে। নির্দেশনা অনুযায়ী পৌঁছলাম কাঙ্ক্ষিত স্থানে। দর্শনার্থীদের সাদর সম্ভাষণ জানানোর জন্যই বুঝি আঙিনার বৃক্ষের পাতাগুলো মুখিয়ে আছে। ৫ জুলাই প্রদর্শনীর উদ্বোধন হয়েছে। সে ছাপ আঙিনার শিউলিতলার ব্যানার দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

বৃষ্টি ধোয়া সন্ধ্যার ক্ষণে আলোর রেখার অভূতপূর্ব ঢেউ খেলে গেল প্রাঙ্গণজুড়ে। প্রদর্শনী কক্ষের গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই কনকচাঁপা চাকমার ‘উৎসব’ চিত্রকর্মে চোখ আটকাল। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর উৎসব নিয়ে আঁকা এ শিল্পকর্মের রঙে বুঁদ হয়ে রইলাম কিছুটা সময়। কয়েকজন পাহাড়ি নারীর আনন্দঘন দৃশ্য অ্যাক্রিলিক ক্যানভাসে তুলে ধরেছেন শিল্পী। পাশে সাদা পাতায় কালির টানে আঁকা শিশির ভট্টাচার্যের শিরোনামহীন চিত্রকর্ম। চিত্রকর্মটি দর্শনার্থীর হৃদয়ে আলাদা দ্যোতনার সৃষ্টি করে। শিল্পী মুর্তজা বশীরের তিনটি প্রতিকৃতিধর্মী চিত্রকর্ম এখানে ঝুলছে।

অ্যাক্রিলিক ক্যানভাসে আঁকা কাইয়ূম চৌধুরীর ‘নারী’ শিরোনামের শিল্পকর্মে রয়েছে ঢেউ খেলানো চুলের এক নারীর মুখাবয়ব। পাতা ও রঙ রেখায় কাইয়ূম চৌধুরীর পরিস্ফুট স্বাক্ষর। রফিকুন নবীর আঁকা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবিটি মুগ্ধকর। বিশাল ক্যানভাসে আঁকা হামিদুজ্জামান খানের শরৎকালের লেকের দৃশ্য। মায়াময় এ চিত্রকর্ম ভাবায়। আকাশের কত রঙ, প্রকৃতির কী অপার বিস্ময়! জলের ওপর রঙের খেলা ফুটে উঠেছে।

মৈমনসিংহ গীতিকা ও লোকজ ধারার শিল্পী হিসেবে পরিচিত আবদুস শাকুর শাহর চারটি শিল্পকর্ম এখানে ঠাঁই পেয়েছে। লোকায়ত বাংলার পাখি ও নারী-পুরুষের দৃশ্যে জুড়ে দিয়েছেন মহুয়া পালার গীত। ‘কিসের গয়া কিসের কাশি কিসের বৃন্দাবন। বাদ্যার কন্যা খুঁজতে ঠাকুর ভরমে তিরভুবন।’ জলরঙ ও অ্যাক্রিলিক ক্যানভাসে আঁকা এ শিল্পকর্মগুলো চিরায়ত বাংলার পরিচয়। হাশেম খানের ‘বসন্ত’ শিরোনামে পাখির ছবিটি আবেগের জায়গা।

প্রদর্শনীর চারটি কক্ষে সাজানো চিত্রকর্মগুলোর সঙ্গে দর্শনার্থীরা ছবি তুলছে। আলপ্তগিন তুষারের চারকোল ও পেস্টাল পেপারে আঁকা ‘নারীর সাথে ফুল’ চিত্রকর্মকে মোবাইল ক্যামেরার ফ্রেমে এনে ছবি তুলছিলেন রুম্মান হোসেন নামের এক তরুণ। গ্রাম থেকে ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে এসেছেন এ দর্শনার্থী। জানালেন, ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ঘোরা শেষে এখানে এসেছেন। তুষারের আঁকা লাস্যময়ী নারীর দৃশ্যকাব্যটিই ভালো লেগেছে এ দর্শনার্থীর।

কামালউদ্দিনের ‘খামার বাড়ি’ চিত্রকর্মের সামনে দাঁড়ালে সব স্মৃতি উসকে দেবে। ছবিটিতে এক খামারি দুধের বালতি মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। পাশেই আরেকজন গাভীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। সেই সঙ্গে তিনি খামারের অন্যান্য গরু কী করছে সেদিকেও খেয়াল রাখছেন। এ দৃশ্যকাব্য মূলত যারা গরু পালন করে এসেছে অথবা খামারিদের সঙ্গে দীর্ঘদিন মিশেছেন তাদের কাছে নস্টালজিয়া। এ চিত্রের চরিত্র দান করেছেন শিল্পী অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। শিল্পী কামালউদ্দিনের আঁকা এ ছবিতে খামারিদের চরিত্র যথাযথভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন। চিত্রকর্মটিতে প্রাণের স্পন্দন উপস্থিত। পাঁচিলে বসে থাকা দুটি পায়রার ‘ভালোবাসা’ শিরোনামের চিত্রকর্মটি দূর থেকে দেখে বোঝা যাচ্ছে এটি জামাল আহমেদের চিত্রকর্ম। রঙের মিশ্রণে সজ্জিত হয়ে ওঠে দুটি পায়রা জমিন।

কথা হয় গ্যালারি কায়ার পরিচালক শিল্পী গৌতম চক্রবর্তীর সঙ্গে। তিনি জানালেন, এ বছর গ্যালারি কায়া ২০ পেরিয়ে ২১ বছরে যাত্রা করেছে। প্রত্যেক বছর পূর্তিতে এখানে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা। প্রত্যেক প্রদর্শনীতেই বৈচিত্র্য নিয়ে আসার চেষ্টা থাকে। এবারো এর ব্যতিক্রম নয়। তিনি বলেন, ‘গ্যালারি কায়া মূলত শুদ্ধ পরিশীলিত শিল্পকর্মের প্রচার ও প্রসারের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। তাছাড়া প্রবীণদের সঙ্গে নবীন শিল্পীদের তুলে ধরাও আামদের অন্যতম লক্ষ্য।’

দুই দশক পূর্তিতে ভারতীয় চিত্রকর মকবুল ফিদা হোসেনসহ দেশ-বিদেশের স্বনামধন্য ৩৫ শিল্পীর ৭১ চিত্রকর্ম নিয়ে সাজানো হয়েছে গ্যালারি কায়ার প্রদর্শনীর ছোট-বড় চারটি কক্ষ। ১৯৭৭ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে আঁকা ৭২টি শিল্পকর্ম রয়েছে। শিল্প রসিকরা পছন্দ অনুযায়ী ক্রয়ও করছেন। প্রদর্শনীতে যাদের শিল্পকর্ম রয়েছে তারা হলেন শিল্পী আবুল বারক আলভী, আহমেদ শামসুদ্দোহা, দেবদাস চক্রবর্তী, আশরাফুল হাসান, অতীন বসাক, চন্দ্র ভট্টাচার্য, চন্দ্র শেখর দে, গণেশ হালুই, গৌতম চক্রবর্তী, কাজী আবদুল বাসেত, মানু পারেখ, মোহাম্মদ ইউনুস, মোহাম্মদ ইকবাল, নিতুন কুন্ডু, রণজিৎ দাস, রতন মজুমদার, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, সমীরণ চৌধুরী, সনৎ কর, শাহানুর মামুন, শহীদ কবির, শিশির ভট্টাচার্য্য, সোহাগ পারভেজ ও সুনীল দাস। প্রদর্শনীটি চলবে ১৯ জুলাই পর্যন্ত। প্রতিদিন বেলা সাড়ে ১১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সবার জন্য উন্মুক্ত এ গ্যালারি।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫