রংপুর বিভাগে ২৮ শতাংশ মানুষই থ্যালাসেমিয়ার বাহক

প্রকাশ: জুলাই ০৮, ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশে বংশগত রক্তস্বল্পতাজনিত দুরারোগ্য ব্যাধি থ্যালাসেমিয়া দিন দিন বাড়ছে। প্রতি বছর সাত হাজার শিশু জন্ম নিচ্ছে থ্যালাসেমিয়া নিয়ে। বাবা-মা দুজনই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে সন্তানের থ্যালাসেমিয়ার রোগী হওয়ার সর্বোচ্চ ঝুঁকি থাকে। দেশে ১৪-৩৫ বছর বয়সীদের মধ্যে শতকরা ১১ শতাংশের বেশি মানুষ থ্যালাসেমিয়ার বাহক। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাহক রংপুর বিভাগে। বিভাগটিতে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ২৮ জনই এই জিনগত রোগের বাহক।

গতকাল ন্যাশনাল ‘থ্যালাসেমিয়া সার্ভে ২০২৪’-এর প্রাথমিক ফল প্রকাশ করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। এতে দেখা যায়, দেশে থ্যালাসেমিয়া বাহকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি রংপুরে ২৭ দশমিক ৭ শতাংশ। ১১ দশমিক ৩ শতাংশ বাহক নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রাজশাহী। তৃতীয় স্থানে থাকা চট্টগ্রামে বাহক ১১ দশমিক ২ শতাংশ। এছাড়া ময়মনসিংহে ৯ দশমিক ৮, খুলনায় ৮ দশমিক ৬, ঢাকায় ৮ দশমিক ৬ ও বরিশালে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। সবচেয়ে কম ৪ দশমিক ৮ শতাংশ বাহক সিলেটে।

সারা দেশে থ্যালাসেমিয়ার বাহকের হার ১১ দশমিক ৪ শতাংশ। নারী ১১ দশমিক ২ ও পুরুষ ১১ দশমিক ৯ শতাংশ। ১৪-৩৫ বছর বয়সী বিবাহিত ও অবিবাহিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ জরিপ পরিচালনা করা হয়। জরিপে অংশ নেন ৮ হাজার ৬৮০ জন।

রংপুরে থ্যালাসেমিয়ার বাহক বেশি হওয়ার সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি। তবে রংপুর বিভাগের রক্তরোগ ও স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ অঞ্চলে স্থানীয়দের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রবণতা বেশি। এতে থ্যালাসেমিয়ার বাহকের সংখ্যা বাড়তে পারে। কারণ স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে কেউ একজন থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে তাদের সন্তান থ্যালাসেমিয়া রোগাক্রান্ত না হলেও বাহক হবে।

রংপুর বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. এবিএম আবু হানিফ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘থ্যালাসেমিয়া হচ্ছে ক্রোমোজোমাল ডিজঅর্ডার। একটি অটোজোমাল মিউট্যান্টের প্রচ্ছন্ন জিনঘটিত বংশগত রক্তের রোগ। এ রোগে রক্তে অক্সিজেন পরিবহনকারী হিমোগ্লোবিন কণার উৎপাদনে ত্রুটি হয়। থ্যালাসেমিয়া ধারণকারী ব্যক্তি সাধারণত রক্তে অক্সিজেনস্বল্পতা বা অ্যানিমিয়ায় ভুগে থাকে।’

থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) বলছে, থ্যালাসেমিয়া হলো উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বা জিনের মাধ্যমে বাবা-মায়ের কাছ থেকে শিশুদের কাছে চলে যাওয়া একটি রোগ। স্বামী বা স্ত্রীর একজন থ্যালাসেমিয়ার জিনের বাহক হলে তাদের সন্তানদের ৫০ শতাংশ সুস্থ হয় এবং ৫০ শতাংশ থ্যালাসেমিয়ার বাহক হয়। আর স্বামী ও স্ত্রীর দুজনই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে তাদের সন্তানদের ২৫ শতাংশের থ্যালাসেমিয়া হয়, ২৫ শতাংশ সুস্থ হয় এবং ৫০ শতাংশ এ জিনের বাহক হয়।

বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়াকে দ্রুত বিস্তারকারী একটি রোগ বলে উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন। সারা বিশ্বে বছরে সাড়ে ৪০ হাজার শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মায় বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। 

দেশের রক্তরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ থ্যালাসেমিয়া রোগে ভুগছে। আর এক থেকে দুই কোটি মানুষ থ্যালাসেমিয়ার বাহক। মানুষের শরীরে যে রক্ত থাকে তার গড় আয়ু হচ্ছে ১২০ দিন। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের ত্রুটিপূর্ণ গ্লোবিনের কারণে লোহিত রক্তকণিকা ২০-৬০ দিনের মধ্যে ভেঙে যায়। এতে ওই রোগীকে প্রতি মাসে এক থেকে চার ব্যাগ রক্ত দিতে হয়। এর স্থায়ী চিকিৎসা অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন ও জিনথেরাপি। বাংলাদেশে এ চিকিৎসার প্রচলন এখনো হয়নি এবং চিকিৎসাটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমাটোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মাসুদা বেগম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘থ্যালাসেমিয়ার বাহক হওয়া বা রোগী হওয়ার ক্ষেত্রে ভৌগোলিক কোনো কারণ নেই। রংপুরে কেন বাহক বেশি তার সঠিক কারণ জানা নেই। আর আত্মীয় বা স্থানীয়দের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে থ্যালাসেমিয়ার বাহক বাড়ছে এমনটি গবেষণা ছাড়া বলা যাবে না। পরীক্ষার মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ সম্ভব। বিয়ের আগে দেখতে হবে দুজনই বাহক কিনা। পরীক্ষা ও সচেতনতা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এ রোগ থেকে মুক্ত রাখতে পারে।’

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের (এনআইএলএমসিআর) রক্তরোগ বিভাগের প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ যুবায়ের খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রংপুর থেকে থ্যালাসেমিয়ার রোগী বেশি পাই। রোগটি প্রতিরোধযোগ্য। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিয়ের আগে থ্যালাসেমিয়ার পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে। নারী ও পুরুষ দুজনই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে তাদের বিয়েতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আমরা একটি নীতি ও আইন করার চেষ্টা করছি। থ্যালাসেমিয়ার বাহক যেন অন্য বাহককে বিয়ে না করেন সেজন্য কাউন্সেলিং করছি। তাদের মধ্যে একজন বাহক হলে সমস্যা নেই।’


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫