শিক্ষা, গবেষণা ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে বাংলাদেশ-চীন বন্ধুত্ব

প্রকাশ: জুলাই ০৭, ২০২৪

ড. মো. তোফাজ্জল ইসলাম

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৮ জুলাই থেকে তিনদিনের জন্য চীন সফরে যাচ্ছেন; প্রায় এক দশক পর। তার এ সফর বাংলাদেশের ২০৪১ সালের মধ্যে একটি স্মার্ট ও উন্নত জাতি গড়ার লক্ষ্য পূরণের জন্য দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ও আলোচনার নতুন আশার সঞ্চার করেছে। চীন সরকারও দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার জন্য তাদের উচ্চ প্রত্যাশা প্রকাশ করেছে। শেখ হাসিনা ও শি জিনপিংয়ের এ বৈঠককে স্মরণীয় করে রাখতে দুই দেশের মধ্যে বেশ কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হতে পারে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় চীন মানসম্মত উচ্চ শিক্ষা, গবেষণা, উদ্ভাবন ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন বৈশ্বিক র‍্যাংকিংয়ে শীর্ষ স্থান দখল করছে এবং তাদের গবেষণা কার্যক্রম বৈশ্বিক জ্ঞানভাণ্ডারে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে, চীন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এবং সবুজ প্রযুক্তির মতো ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উন্নয়নে বিশ্বব্যাপী নেতৃত্ব দিচ্ছে। কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তার ক্ষেত্রে চীনের অগ্রগতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যেখানে তারা উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদনশীলতা এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করছে। সামগ্রিকভাবে চীনের এ সাফল্যগুলো তাদের উচ্চ মানের শিক্ষা, গবেষণা এবং প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ অর্জনে অগ্রগামী করেছে। চাইনিজ একাডেমি অব সায়েন্সেস ন্যাচার ইনডেক্স ২০২৩ বার্ষিক তালিকায় শীর্ষে রয়েছে, যা প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ক্ষেত্রে উচ্চ মানের গবেষণায় প্রাধান্যকারী প্রতিষ্ঠান এবং দেশগুললোকে হাইলাইট করে। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে, এরপর জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক সোসাইটি এবং ফ্রেঞ্চ ন্যাশনাল সেন্টার ফর সায়েন্টিফিক রিসার্চ স্থান পেয়েছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ গত কয়েক দশকে খাদ্যনিরাপত্তা, দারিদ্র্য বিমোচন এবং শিক্ষা সম্প্রসারণে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে। প্রয়োজনভিত্তিক কৃষি গবেষণা এবং গবেষণা ফলাফল মাঠ পর্যায়ে প্রয়োগের ফলে ফসল, উদ্যানতাত্ত্বিক পণ্য, মৎস্য চাষ এবং প্রাণিসম্পদ খাতে উৎপাদন বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার, চাষযোগ্য জমির পরিমাণ বছরে প্রায় ১ শতাংশ হারে হ্রাস, মাটির স্বাস্থ্যের অবনতি এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ খাদ্যনিরাপত্তার জন্য ক্রমবর্ধমান হুমকি তৈরি করছে।

যদিও বাংলাদেশ দেড় শতাধিক পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ করেছে, উচ্চ শিক্ষায় গুণগত মান নিশ্চিত করা এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বিশ্ব র‍্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় শীর্ষ ৫০০-তে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ই শিক্ষাদানমুখী, যেখানে গবেষণার অর্জন খুবই দুর্বল। ফলে বাংলাদেশ বিশ্ব উদ্ভাবন এবং গবেষণা র‍্যাংকিংয়ে প্রায় নিচের দিকে অবস্থান করছে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্য হলো নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি, সংরক্ষণ ও প্রসার। একটি উন্নত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশকে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক গুণগত শিক্ষা, গবেষণা ফলাফল এবং উদ্ভাবনের ওপর মনোযোগ দিতে হবে, যাতে প্রয়োজনভিত্তিক নতুন প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং রফতানি করতে পারে। যেহেতু চীন এসব খাতে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে, বাংলাদেশ-চীনের মধ্যে কার্যকর অংশীদারত্ব বাংলাদেশের উদীয়মান অর্থনীতিকে ব্যাপকভাবে উপকৃত করতে পারে। এ পরিপ্রেক্ষিতে, মানসম্মত উচ্চ শিক্ষা, গবেষণা, উদ্ভাবন এবং বিশেষ করে কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য চীনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করা উচিত।

চীন বাংলাদেশের বিশ্বস্ত বন্ধু এবং উন্নয়ন অংশীদার। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে চীন বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীদের আসন্ন সম্মেলনে শক্তি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস, রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা এবং কৃষি বিষয়গুলো অগ্রাধিকার পেতে পারে। এ নিবন্ধে আমি উচ্চ শিক্ষা, গবেষণা, উদ্ভাবন এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, বিশেষ করে কৃষি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ-চীন অংশীদারত্ব কীভাবে সহায়ক হতে পারে সে বিষয়ে আমার মতামত উপস্থাপন করছি।

২০২৩ সালের হিসাবে, সাংহাই র‍্যাংকিংয়ের বিশ্ব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক র‍্যাংকিংয়ের (এআরডব্লিউইউ) শীর্ষ ১০০ তালিকায় চীনের ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। একইভাবে টাইমস হায়ার এডুকেশনের র‍্যাংকিংয়েও চীনের সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় শীর্ষ ১০০ তালিকায় স্থান পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাশাপাশি চীনের প্রাথমিক, বৃত্তিমূলক এবং কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থা বিশ্বমানের। জনবহুল বাংলাদেশের জন্য শিক্ষার মান উন্নত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ; এক্ষেত্রে চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে কার্যকর অংশীদারত্ব ও বিনিময় কর্মসূচি অত্যন্ত লাভজনক হতে পারে। চীন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ও পোস্টডক্টরাল গবেষকদের আকৃষ্ট করতে বৃত্তি ও ফেলোশিপ প্রদান করছে, যার ফলে বর্তমানে ১২ হাজারের বেশি বাংলাদেশী শিক্ষার্থী চীনে পড়াশোনা করছেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ-চীন অংশীদারত্ব প্রকল্পের মাধ্যমে শিক্ষার মান উন্নয়নের প্রস্তাব দেয়া যেতে পারে।

চায়নিজ একাডেমি অব সায়েন্সেস এবং চায়নিজ একাডেমি অব এগ্রিকালচারাল সায়েন্সেসসহ বেশির ভাগ চীনা বিশ্ববিদ্যালয় সত্যিকারের গবেষণাভিত্তিক উচ্চতর ডিগ্রি প্রোগ্রাম (মাস্টার্স ও পিএইচডি) অফার করে, যা বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে দুর্বল। দুই নেতার বৈঠককে স্মরণীয় করে রাখতে বাংলাদেশে একটি সত্যিকারের গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ‘বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেয়া যেতে পারে। এটি বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে একটি ভালো মডেল হবে।

প্রয়োজনভিত্তিক গবেষণা ও উদ্ভাবন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় একটি যৌথ কর্মশালায় বিভিন্ন ডিসিপ্লিনের চীনা বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ জানাতে পারে। এ কর্মশালায় বাংলাদেশ ও চীনের বিশেষজ্ঞরা প্রয়োজনভিত্তিক গবেষণার জন্য উপযুক্ত থিমগুলো চিহ্নিত করতে এবং পারস্পরিক আগ্রহের বিষয়গুলোয় যৌথ গবেষণার জন্য সহযোগী অংশীদার খুঁজে পেতে পারবেন। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মশালায় অংশগ্রহণ করে দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত কর্মসূচির প্রস্তাব দিতে পারে।

আমার অভিজ্ঞতা থেকে আমি নিশ্চিত যে, চীনা গবেষকরা বাংলাদেশী গবেষকদের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। উদাহরণস্বরূপ, সম্প্রতি শানডং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করেছেন এবং যৌথ গবেষণা প্রকল্প, পোস্টডকের যৌথ তত্ত্বাবধান এবং দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একাডেমিক বিনিময় প্রোগ্রামে উচ্চ আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) এ ধরনের কর্মশালার আয়োজন করতে পারে এবং যৌথ একাডেমিক ও গবেষণা কার্যক্রমের সমন্বয় করতে পারে।

বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে সহযোগিতার সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাত হলো কৃষি। চীন বিশ্বের অনেক কৃষিপ্রযুক্তির পথিকৃৎ। উদাহরণস্বরূপ, চীনা বিজ্ঞানী ড. ইউয়ান লংপিং প্রথম হাইব্রিড ফসলের জাত আবিষ্কার করেন, যা বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে ফসল উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করেছে। শুধু হাইব্রিড শস্যের জাত উন্নয়নেই নয়, জলবায়ুসহনশীল ফসল উৎপাদনে জিনোম এডিটিংয়ের মতো বৈপ্লবিক প্রযুক্তি প্রয়োগে চীনা গবেষকরা চ্যাম্পিয়ন। সিআরআইএসপিআর (ক্রিসপার)-ক্যাস জিনোম এডিটিং ব্যবহার করে চীনা বিজ্ঞানীরা পাউডারি মিলডিউ রোগ প্রতিরোধী গমের জাত তৈরি করেছেন। জিনোম এডিটিং, ন্যানো টেকনোলজি, প্রিসিশন এগ্রিকালচারসহ কৃষিতে স্মার্ট প্রযুক্তির প্রয়োগে চীন এখন শীর্ষে। তারা উল্লম্ব কৃষিতেও চ্যাম্পিয়ন। চীনের কিছু এলাকা যেমন কুনমিংয়ের আবহাওয়া বাংলাদেশের মতোই। চীন বাংলাদেশের খুব কাছাকাছি হওয়ায় চীনের সঙ্গে সহযোগিতা বাংলাদেশের জন্য সাশ্রয়ী হবে।

বাংলাদেশী ও চীনা গবেষকদের ফলপ্রসূ সহযোগিতার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হলো, ধ্বংসাত্মক গমের বিস্ফোরণ রোগের জন্য একটি স্মার্ট এবং দ্রুত ডায়াগনস্টিক কিট আবিষ্কার। চাইনিজ একাডেমি অব এগ্রিকালচারাল সায়েন্সেসের ইনস্টিটিউট অব প্লান্ট প্রটেকশনের গবেষকদের সহযোগিতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজির গবেষকরা এ উন্নত প্রযুক্তি তৈরি করেছেন। বিশ্বের সেরা এ উদ্ভাবন এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোয় কৃষকদের ক্ষেত এবং উদ্ভিদ কোয়ারেন্টাইন অফিসে ব্যবহারের জন্য বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন এবং ব্রিটিশ এফসিডিও থেকে মিলিয়ন ডলার অনুদান অর্জন করেছে। আমার ধারণা, এ ধরনের আরো অনেক উদ্ভাবন বাংলাদেশী গবেষকরা চীনা গবেষকদের সহযোগিতায় অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। দুই দেশের মধ্যে একটি আনুষ্ঠানিক চুক্তি এ আবিষ্কারগুলোকে আরো বাড়িয়ে তুলতে পারে। আমি কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তা বিষয়ে গবেষণার কিছু ক্ষেত্র প্রস্তাব করতে চাই, যেখানে বাংলাদেশ-চীন সহযোগিতা অত্যন্ত লাভজনক হতে পারে।

উচ্চফলনশীল ফসলের জাত: ওমিক্স, জিনোম এডিটিং এবং অন্যান্য দ্রুত প্রজনন প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাংলাদেশ ও চীন খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্বল্প সময়ের মধ্যে উচ্চফলনশীল জলবায়ু-স্মার্ট বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবন করতে পারে। এছাড়া বাংলাদেশ-চীন সহযোগিতা লবণাক্ততা প্রশমন, মাটির স্বাস্থ্যের উন্নতি এবং উচ্চ ফসলের ফলন বজায় রাখার জন্য জৈব ও অ্যাবায়োটিক স্ট্রেস ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও কার্যকর হতে পারে।

খামার যান্ত্রিকীকরণ এবং ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার: বাংলাদেশে উৎপাদন খরচ হ্রাস, ফলন বৃদ্ধি, ঝুঁকি হ্রাস এবং পণ্যের গুণগত মান উন্নয়নের জন্য জমি প্রস্তুতি থেকে ফসল কাটা পর্যন্ত যান্ত্রিকীকরণ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ক্ষুদ্র চাষী ও খণ্ডিত জমির উপযোগী কাস্টমাইজড মেশিন ও টুলস নিয়ে বাংলাদেশ-চীন যৌথভাবে কাজ করতে পারে। কৃষিকে লাভজনক করতে স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে চীন বাংলাদেশের কৃষি খাতে বিনিয়োগ করতে পারে, যা বাংলাদেশের জন্য নতুন কর্মসংস্থান ও সক্ষমতা সৃষ্টি করবে।

ন্যানো প্রযুক্তি চতুর্থ শিল্প এবং কৃষি বিপ্লবের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকা। জাতীয় কৃষিনীতি ২০১৮-এ ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহারকে লাভজনক কৃষির জন্য একটি শক্তিশালী সরঞ্জাম হিসেবে অধিগ্রহণ করেছে, তবে বাংলাদেশ এখনো এ উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারে প্রায়ই অধিকার অধিগ্রহণ করেননি। অবিলম্বে প্রিসিশন কৃষিকে উন্নত করার জন্য বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে ফসলের উন্নতি, সুরক্ষা, পুষ্টি, সেচের উন্নত দক্ষতা, প্যাকেজিং, ন্যানো সেন্সর ব্যবহার, আইওটি, কীটপতঙ্গ পর্যবেক্ষণ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার, জিআইএস ও রিমোট সেন্সিংয়ের প্রয়োগ করতে পারে।

সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তি ও কৃষি প্রক্রিয়াকরণ: বাংলাদেশে ফসল সংগ্রহোত্তরের ক্ষতি একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা (১০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত)। ফসল সংগ্রহোত্তরের ক্ষতি হ্রাস করার জন্য শুকানো, প্যাকেজিং ও পরিবহনের জন্য নতুন প্রযুক্তি প্রয়োজন। কৃষিকে লাভজনক করতে এবং রফতানির দ্বার উন্মুক্ত করতে মূল্য সংযোজন, শেলফ-লাইফ বৃদ্ধি, বায়োফর্টিফিকেশন এবং সরবরাহ চেইনের ব্যবস্থাপনার জন্য তাজা পণ্য প্রক্রিয়াকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ-চীন সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশ এক্ষেত্রে উন্নতি অর্জন করতে পারে।

উল্লম্ব কৃষি: বাংলাদেশের কৃষির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা। উল্লম্ব কৃষি, যা উল্লম্ব চাষ নামেও পরিচিত, ঐতিহাসিক উপক্রমকে পরিবর্তন করে উল্লম্বভাবে স্তুপীকৃত স্তরে ফসলের বৃদ্ধির একটি পদ্ধতি। এটি সাধারণত উদ্ভিদের বৃদ্ধি অপ্টিমাইজ করার জন্য নিয়ন্ত্রিত-পরিবেশগত কৃষি কৌশল ব্যবহার করে হাইড্রোপনিক্স, অ্যাকোয়াপনিক্স এবং অ্যারোপোনিক্সের মতো পদ্ধতিতে। উল্লম্ব কৃষি পদ্ধতির মাধ্যমে মাটিহীন ফসল উৎপাদন ও বাড়তির উপায় খুঁজে বাংলাদেশ ও চীন একসঙ্গে কাজ করে বাংলাদেশের খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা উন্নত করতে পারে।

সামুদ্রিক জৈবসম্পদের ব্যবহার: বঙ্গোপসাগরের সামুদ্রিক অঞ্চলে বাংলাদেশের অংশের আয়তন প্রায় দেশের জমির সমান। তবে বঙ্গোপসাগরের জৈব সম্পদগুলো এখনো জাতির জৈব অর্থনীতির একটি অনাবশ্যক সম্পদ। সামুদ্রিক শৈবাল, মেরিকালচার এবং অন্যান্য অমেরুদণ্ডী প্রাণীর সঙ্গে সামুদ্রিক জৈবসম্পদ ব্যবহারে চীন দক্ষ। সামুদ্রিক জৈবসম্পদকে ব্যবহারে লাগানোর জন্য ও বাংলাদেশ কল্পনাকৃত সুনীল অর্থনীতির উন্নয়নে চীনের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে বাংলাদেশকে একটি প্রধান উপায়ে উন্নত করতে সহায়ক হতে পারে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল এবং চীনা কৃষিবিজ্ঞান একাডেমির মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হতে পারে যা উভয় সংস্থা একসঙ্গে থিমগুলো শনাক্ত করতে পারে এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীদের সমন্বিত প্রয়োজনভিত্তিক গবেষণার জন্য গবেষণা গ্রুপ গঠন করতে পারে। বাংলাদেশ সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু-পিয়েরে এলিয়ট ট্রুডেউ কৃষি কেন্দ্র স্থাপন এবং গবেষণা সক্ষমতা সমৃদ্ধকরণের জন্য কানাডার সঙ্গে একটি যৌথ প্রকল্প গ্রহণ করেছে। চীনের সঙ্গেও একই ধরনের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন চীন সফর বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে অংশীদারত্ব ও সহযোগিতার জন্য বিশাল আশার সঞ্চার করেছে। ভূরাজনৈতিক ইস্যু ছাড়াও আশা করা যায় যে বাংলাদেশ উচ্চ শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি, কৃষি, স্বাস্থ্য, জ্বালানি, সুনীল অর্থনীতির জন্য সামুদ্রিক জৈবসম্পদ ব্যবহার এবং পরিবেশের ওপর উন্নত গবেষণায় অংশীদারত্বের সহযোগিতায় আগ্রহ দেখাবে। বলা বাহুল্য, চীনের সঙ্গে সহযোগিতা আমাদের টেকসই খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষি বিজ্ঞানে শিক্ষা ও গবেষণা জোরদারে সাহায্য করবে।

ড. মো. তোফাজ্জল ইসলাম: অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক পরিচালক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরকৃবি)। প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং (আইবিজিই), ফুলব্রাইট স্কলার, বাংলাদেশ ও বিশ্ব বিজ্ঞান একাডেমির ফেলো


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫