অফশোর ব্যাংকিংয়ে সাফল্যের জন্য আমাদের করণীয়

প্রকাশ: জুলাই ০৩, ২০২৪

ফারুক মঈনউদ্দীন

আমাদের বিদেশী মুদ্রা তথা ডলার সংকট মোকাবেলা করার জন্য একাধিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও এযাবৎ সুস্পষ্ট কোনো আলোর রেখা দেখা যায়নি। সোয়াপ, স্থানীয় মুদ্রায় আমদানি-রফতানির চেষ্টা ইত্যাকার কয়েকটি সম্ভাবনার কথা ভাবা হলেও কার্যোপযোগী নয় বলে সেগুলো ফলবতী হয়নি। সুতরাং ডলার সংকট কাটানোর জন্য অফশোর ব্যাংকিংয়ের আমানত হিসেবে ডলার সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাংকিংয়ের এ পরিভাষা এখনো পরিচিত নয়। ইংরেজি অফশোরের শব্দগত অর্থ সমুদ্রতীর থেকে দূরবর্তী কিংবা অন্যভাবে বললে, সমুদ্রতীরাতিক্রান্ত, এক কথায় দেশের মূল ভূখণ্ডের বাইরের কোনো স্থান। শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত তথ্যই নির্দেশ করে যে এটি দিয়ে মূলত বোঝানো হয় দ্বীপ বা দ্বীপরাষ্ট্র। সে কারণে বিখ্যাত কিংবা কুখ্যাত যেভাবেই দেখা হোক না কেন সফল অফশোর ব্যাংকিং উৎকর্ষ লাভ করেছে বিভিন্ন দ্বীপে বা দ্বীপরাষ্ট্রে। অস্বচ্ছ ব্যাংকিং ব্যবস্থা, কর রেয়াত ও আইনি কাঠামোর নমনীয়তার কারণে এসব দেশের ব্যাংকগুলো পরিণত হয়েছে বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের কালো টাকার অভয়ারণ্যে। কারণ এখানে প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের কোনো নিয়ম বা নীতিমালা প্রয়োগ করা হয় না। গ্রাহকদের হিসাব সংরক্ষণের জন্য বিশেষ আইন-কানুনের উপস্থিতি এবং গোপনীয়তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা রয়েছে বলে সন্দেহজনক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্জিত আয় গচ্ছিত রেখে আমানতকারীরা স্বস্তিতে থাকেন। তবে এ সংকীর্ণ সংজ্ঞা বর্তমানে আর প্রযোজ্য নয়। এখন একটা ভূমিবেষ্টিত দেশেও অফশোর ব্যাংকিং ব্যবস্থা থাকতে পারে, তার জন্য আলাদা বা সমুদ্রতীর থেকে দূরবর্তী কোনো দ্বীপের প্রয়োজন পড়ে না।

অফশোর ব্যাংকিং নিয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে বর্তমানে যথেষ্ট পরিবর্তন এসেছে। করস্বর্গ কিংবা বেনামি ছদ্ম প্রতিষ্ঠানগুলো আগের মতো স্বস্তিদায়ক অবস্থায় নেই। বিশ্বব্যাপী মানি লন্ডারিং ও জঙ্গি অর্থায়নের বিরুদ্ধে নানান ব্যবস্থা শুরু হওয়ার পর বদনামের ভাগীদার এসব দেশ আইন-কানুনের রাশ টেনে তাদের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে। এমনকি কর ফাঁকি বা মানি লন্ডারিংয়ের বিরুদ্ধে তদন্তকাজেও সহায়তা দিচ্ছে এসব দেশ। তবে ব্যাংকের গ্রাহকদের গোপনীয়তা রক্ষায় রাখা হয়েছে কঠোর আইন। এটিও কালো টাকার মালিকদের জন্য কম স্বস্তিকর নয়। একসময় মরিশাসের ভাবমূর্তি ছিল নেতিবাচক, এটি ছিল বেনামি বা ছদ্ম প্রতিষ্ঠানের অভয়ারণ্য। ফলে মানি লন্ডারিং ও জঙ্গি অর্থায়নের নিরিখে দেশটি ছিল কালো তালিকাভুক্ত। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সংস্কার ও ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ২০২১ সালে কালো তালিকা থেকে বের হয়ে এসেছে দেশটি। দ্বীপরাষ্ট্রটির আর্থিক পরিষেবা ও সুশাসন মন্ত্রী সম্প্রতি দাবি করেছেন যে মরিশাস এখন আর করস্বর্গ নয়, বেনামি ছদ্ম কোম্পানিগুলোর জায়গা আর মরিশাসে হবে না। 

অবশ্য কর ফাঁকি কিংবা অবৈধ অর্থ বিনিয়োগের বিষয়টি বাদ দিলে এ ব্যাংকিং ব্যবস্থার অন্যান্য ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে বিদেশী উৎস থেকে আমানত সংগ্রহের সুযোগ, বিদেশী গ্রাহকদের ঋণ দানের ব্যবস্থা, একাধিক বিদেশী মুদ্রায় অনাবাসী ও বিদেশীদের হিসাব খোলার সুযোগ, বিদেশী আমানত অবাধে প্রত্যর্পণের ব্যবস্থা, আমানতের ওপর দেয়া সুদে কর অব্যাহতি ইত্যাদি। সুতরাং এ কথা স্পষ্ট যে প্রচলিত অভ্যন্তরীণ ব্যাংক ব্যবস্থার বিপরীতে দেশে অবস্থান করেই বিদেশে অবস্থানকারী একটি ব্যাংকের মতো কার্যক্রম পরিচালনার ব্যবস্থাই অফশোর ব্যাংকিং। কার্যকর ও সফল অফশোর ব্যাংকিংয়ের জন্য কর ব্যবস্থা, গোপনীয়তা, বিশ্বস্ততা, নিরাপত্তা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক।

আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থায়নের জন্য বাংলাদেশে অফশোর ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। বর্তমানে প্রায় ৪০টির মতো ব্যাংকে এ ইউনিট চালু রয়েছে। এতদিন দেশের অফশোর ব্যাংকগুলোর মূল কার্যক্রম সীমাবদ্ধ ছিল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বিদেশী মুদ্রায় ঋণদানের মধ্যে। এ তহবিলের উৎস ছিল বিভিন্ন বিদেশী প্রতিষ্ঠান থেকে গৃহীত স্বল্প সুদে ঋণ। ব্যাপারটা ছিল অনেকটা মাছের তেলে মাছ ভাজার মতো, অথচ এসব ঋণের আদর্শ উৎস হওয়া উচিত ছিল গ্রাহকদের আমানত।

বাংলাদেশে চলমান ও ক্রমবর্ধমান ডলার সংকটের প্রেক্ষাপটে এ ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে বিদেশী গ্রাহক ও অনাবাসী বাংলাদেশীদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নির্দেশিকায় ব্যাংকগুলো চালু করেছে ‘অফশোর ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট’ সেবা। এ সেবার আওতায় অনাবাসী বাংলাদেশী, বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত বিদেশী নাগরিক, বিদেশে নিবন্ধিত ও পরিচালিত প্রতিষ্ঠান এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা আমানত হিসাব পরিচালনার সুযোগ পাবেন। এ সেবার অধীনে রক্ষিত আমানতের ওপর বিভিন্ন হারে আকর্ষণীয় সুদ প্রদানের ব্যবস্থাও রয়েছে। মেয়াদ শেষে কিংবা যেকোনো সময়ে প্রবাসী আমানতকারীদের জন্য রাখা হয়েছে বিদেশী মুদ্রায় আমানত তুলে নেয়ার সুযোগ।

উদ্যোগটি আশাপ্রদ, কারণ এ রকম সুযোগ দিয়ে সুফল পেয়েছে পাকিস্তান। দেশটিতে এ ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর অনাবাসী পাকিস্তানিদের আমানত দাঁড়িয়েছে ৮০০ কোটি ডলার। ছয় মাস আগে সেবাটি চালু করেছে বাংলাদেশও। সংগৃহীত আমানতের পরিমাণ উল্লেখ করে বিভিন্ন ব্যাংকের তরফ থেকে পৃথকভাবে দাবি করা হলেও মোট আহরিত আমানত সম্পর্কে কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। নতুন এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক এবং কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রতিনিধিদের নিয়ে নিউইয়র্কে প্রচারণামূলক সেমিনারের আয়োজনও করা হয়েছিল। জানা গেছে সেই সেমিনারে উপস্থিত আগ্রহী বাংলাদেশীদের প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব দেয়া যায়নি। আমাদের আশঙ্কা ঠিক এ বিষয়কে ঘিরেই।

যেকোনো দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা হোক না কেন, আমাদের ব্যাংক খাতের স্বাস্থ্য যে খুব ভালো নেই, সে কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। বাংলাদেশের বাইরে অবস্থানকারী অনাবাসীদের মধ্যে স্বদেশের প্রতি মমত্ত্ব ও আগ্রহ বেড়ে যায়, একই সঙ্গে যদি নানান নেতিবাচক সংবাদ তাদের কাছে পৌঁছাতে থাকে, সেটি বাড়িয়ে দেয় তাদের সংশয়কেও। নিউইয়র্কের সেমিনারে প্রবাসী বাংলাদেশী নাগরিকের প্রশ্নটির মধ্যে লুকিয়ে আছে আমাদের ব্যাংক ব্যবস্থার বিষয়ে সাধারণ মানুষের সহজাত আশঙ্কা, যা প্রবাসে থাকলে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়।

অফশোর ব্যাংকিং ব্যবস্থার মূল আকর্ষণ হয় নিরাপত্তা, গোপনীয়তা ও শিথিল বিধি-নিয়ম। এসব বিষয়ের নিশ্চয়তা পাওয়া না গেলে আমানতকারীদের আস্থা অর্জন করা সম্ভব হবে না। বাংলাদেশে আমানতের নিরাপত্তার জন্য যে ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স স্কিম আছে, সেটি অফশোর ব্যাংকের আমানতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কিনা সে বিষয়ে ‘অফশোর ব্যাংকিং আইন ২০২৪’-এ কোনো বিধান রাখা হয়নি। বিদেশী নাগরিক কিংবা অনাবাসী বাংলাদেশীরা তাদের আমানতের নিরাপত্তা না পেলে এগিয়ে আসবেন না, এটি প্রায় নিশ্চিত। সুতরাং নিউইয়র্কের সেমিনারে উপস্থিত উপরোক্ত ব্যক্তির সংশয় দূর করার সক্ষমতা আমাদের ব্যাংক খাতের আছে কিনা, সেটি বিবেচনা করে দেখতে হবে। যদি না থাকে তাহলে সেটি কেন নেই এবং কীভাবে তা অর্জন করা যায় সে কথা ভাবতে হবে। আমাদের স্বীকার করতে হবে যে আমাদের ব্যাংক খাত একাধিক সমস্যায় জর্জরিত। তাহলেই কেবল আমরা রোগের সঠিক চিকিৎসা দিতে সক্ষম হব। আমাদের চলতি বছরের বাজেটে ‘খেলাপি ঋণ,’ ‘ঋণ খেলাপি’ এমনকি ‘খেলাপি’ শব্দটি একবারের জন্যও উচ্চারিত হয়নি। রোগকে ঢেকে রাখলে নিরাময় সম্ভব হয় না, বরং সেটা আরো দুরারোগ্য হয়ে পড়ে।

দেশে বিদেশী মুদ্রার সরবরাহ ও রিজার্ভের বর্তমান পরিস্থিতিতে নতুন এ সেবা অবশ্যই কাঙ্ক্ষিত ফল এনে দিতে সক্ষম, যদি ব্যাংক খাতের বর্তমান দুর্বলতাগুলো দূর করে সেবাগ্রহীতাদের রক্ষিত আমানতের নিরাপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিন্ত করা যায়। তার সঙ্গে এ বিশেষ সেবা গ্রহণ করার জন্য হিসাব খোলার বিষয়টি সহজ করতে হবে। আমরা অফশোর ব্যাংকিংয়ে মরিশাসের সফলতার উদাহরণ দিয়ে থাকি। কিন্তু দেশটি মানি লন্ডারিং বিরোধী ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্সের ধূসর তালিকা থেকে বের হয়ে এসেছে মাত্র বছর তিনেক আগে। ফলে সেটি আর আগের মতো অভয়ারণ্য নেই। বাংলাদেশ এ তালিকা থেকে বের হয়েছে ১০ বছর আগে অথচ আমরা কালো টাকা, মুদ্রা পাচার কোনো কিছুর দৌরাত্ম্য থেকে এখনো মুক্ত হতে পারিনি। 

এসব বিষয় মাথায় রেখে যদি ব্যাংক খাতের দুর্বলতাগুলো দূর করার জন্য বলিষ্ঠ ও সাহসী পদক্ষেপ নিতে পারি, তাহলে আশা করা অমূলক হবে না যে অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বিদেশী মুদ্রা আহরণে পাকিস্তানের চেয়ে আরো বেশি সাফল্য আমরা অর্জন করতে পারি। কারণ, আমরা বিশ্বাস করতে চাই, অনাবাসী বাংলাদেশীরা অনাবাসী পাকিস্তানিদের চেয়ে অনেক বেশি দেশপ্রেমিক। 

ফারুক মঈনউদ্দীন, লেখক ও ব্যাংকার


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫