বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু সেই কবে সবার ধারণা ভুল প্রমাণ করে আবিষ্কার করলেন যে গাছেরও প্রাণ আছে। বিষয়টি আবিষ্কারের পর খোদ আবিষ্কারক পড়ে গেলেন দ্বন্দ্বে, তিনি নিরামিষভোজী এখন খাবেন কী? প্রোটিনের জন্য উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল হতে হলে তো উদ্ভিদের সেই প্রাণ সংহারই করতে হবে। সে যা-ই হোক বাস্তুতন্ত্রের নিয়ম হলো এমন যে এক প্রাণ বেঁচে থাকে আরেক প্রাণ সংহার করে। গাছের প্রাণ আছে বিষয়টি যখন আমাদের গর্বের ধন বাঙালি বিজ্ঞানী আবিষ্কার করে ফেললেন, তখন জাতি হিসেবে বিশ্বে আমাদের অবস্থানেরও কিছু উন্নয়ন হলো। গাছের যেহেতু প্রাণ আছে, সেহেতু তারা নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময় করতেও পারে। বিজ্ঞানীরা বিশ্বব্যাপী এ নিয়ে নানা গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং মঝেমধ্যে সে বিষয়ে বিভিন্ন খবরও পত্রপত্রিকায় আসছে। কিন্তু এর কোনোটাই শক্ত ভিত্তি পাচ্ছে না। কিছু মিডিয়ায় খবর বের হলো, একদল বিজ্ঞানী পরীক্ষা থেকে দেখেছে উদ্ভিদরাও ভাব বিনিময় করে। খবরটি যেমন এসেছিল তেমনি কর্পূরের মতো উবেও গেল। তবে সবকিছুকে ছাড়িয়ে এই বাংলা মুলুকে ছড়িয়ে পড়েছে তাজা খবর—বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর উপজেলার রাঘদী ইউনিয়নের গর্জিনা গ্রামের একটি গাছ কথা বলছে। বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরও যখন গাছের কথা বলা কিংবা ভাব বিনিময়ের কোনো প্রমাণ আবিষ্কার করতে পারলেন না, সেখানে বাংলা মুলুকে একটি গ্রামে গাছ কথা বলছে—তা শুনতে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হবে—এটা দেশের সংস্কৃতির সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ বটে। যেখানে রাস্তার পাশে কোনো মানুষ কিছু দেখছে এমন দেখতে পেলে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে যায় লোকটি কী দেখছে সেটি দেখার জন্য, সেখানে গাছ কথা বলছে সেটি দেখতে কিংবা গাছের কথা শুনতে মানুষ ভিড় জমাতেই পারে।
আরেকটি বিষয় হলো, এখানে ঘটনার চেয়ে রটনার পেছনেই মানুষকে বেশি ছুটতে দেখা যায়। ঠিক তা-ই ঘটল, বিষয়টি এ মুখ থেকে ও মুখে ছড়িয়ে পড়লে কয়েক দিন ধরে গাছটি দেখতে ভিড় করতে থাকেন উৎসুক অসংখ্য মানুষ। গাছে কান পেতে কথা শোনার চেষ্টা করতে দেখা যায় অনেককে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে এবং স্থানীয় লোকজনের ভাষ্যমতে জানা যায়, ‘১৪ জুন ওই বাগানে একটি গাছ কাটতে যায় জুয়েল মোল্লার ছেলে নিরব মোল্লাসহ (১০) আরো কয়েকজন। তারা ধারালো অস্ত্র দিয়ে গাছটির গায়ে আঘাত করার সঙ্গে সঙ্গে গাছটি কথা বলে ওঠে। এ সময় ওই শিশুরা ভয় পেয়ে বাড়ি গিয়ে পরিবারের লোকজনকে বিষয়টি অবহিত করে। এর পরপরই পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে গাছে কথা বলার গুজব। অনেকের দাবি, গাছের কাছে গিয়ে প্রশ্ন করলে উত্তর দিচ্ছে। গাছটিকে কাটতে গেলে সেটি কী বলে উঠেছিল সেটি আমার জানা নেই, তবে আমার মনে হচ্ছে গাছটি বলছিল আমাকে কেটো না, আমাকে কাটলে তোমরা কিংবা তোমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শ্বাসকষ্টে মারা যাবে। এতে মানুষ ভয় পেয়ে যায় এবং মারা যাবে এমন খবর শ্রোতাদের এবং তাদের পাড়া প্রতিবেশীদের আরো আতঙ্কিত করে তোলে। আমি নিজ থেকে যেটা যোগ করেছি সেটা আদতে অসম্ভব, কারণ গাছ এমন কথা বলতে পারে না এবং কোথাও বলেছে বলেও শুনিনি। তবে আমি কামনা করি, সৃষ্টিকর্তা যেন গাছদের নানা ভাষায় কথা বলার শক্তি দেন, তাহলে হয়তো গাছ হত্যাকারী, বনখেকোরা যখনই গাছ কাটতে যাবে তখনই গাছ ভয়ের কথা শুনিয়ে দেবে এবং হত্যাকারীরা ভয়ে পালাবে। টাঙ্গাইল মধুপুরগড়টি লুট হয়ে যাচ্ছে, হে সৃষ্টিকর্তা সেখানকার গাছগুলোকে কথা বলার ক্ষমতা দিন, তারা যেন বলে দিতে পারে সমাজের কেতাদুরস্ত কোন লোক রাতের আঁধারে গাছ চুরি করে রাতারাতি টাকার পাহাড় তৈরি করছে এবং তারা ভবিষ্যতে কীভাবে শ্বাসকষ্টে মারা যাবে।
এই কয়েকদিন আগে কোরবানির জন্য কিনতে যাওয়া ছাগলটি যেমন কত সহজে টাকার খনি, খনির মালিক এবং খনি তৈরির কলাকৌশল রাষ্ট্র করে দিল। ব্যা, ব্যা শব্দ করা ছাগল যদি এত কিছু পারে তবে গাছ পারবে, মাছ পারবে, আপনি, আমি যে ঘরে বাস করছি সেটির দেয়াল, দরজা-জানালাও কথা বলা শুরু করবে এবং অনেক অজানা তথ্য জানাবে, এসব তথ্য খুঁজে বের করার জন্য হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নিয়োজিতরা বের করতে না পারলেও প্রাকৃতিকভাবেও হয়তো বের হবে। তবে প্রায়ই দেখা যায় এ খবরগুলো জনসম্মুখে নিয়ে আসার কাজটি করছে গণমাধ্যম, যার মাঝে যেমন থাকে সত্যি ঘটনা তেমনি অলীক রটনাও। অনেক সময় সত্যি ঘটনাগুলোও আমরা রটনা বলে আড়াল করতে চাই।
ছোটবেলায় বয়সে আমাদের চেয়ে অনেক বড় এক বন্ধু ছিল, যে নানা ধরনের ভয়ংকর গল্প সত্য বলে চালিয়ে দিত এবং আমাদের ছোটদের মনে এক ভয়ের জগৎ তৈরি করত। বয়সে বড় হওয়ায় তার কথা বিশ্বাস করতাম সহজেই। একবার সে শোনাল যে, তার পিতামহ মারা যাওয়ার পর যখন শশ্মানে উঠিয়ে মুখাগ্নি করা হবে ঠিক তখন লাশটি উঠে দৌড়ে গিয়ে পাশের খালে ঝাঁপ দেয় এবং পালিয়ে যায়, এরপর অমাবস্যার রাতে প্রায়ই তাকে খাল পাড়ের গাছে অনেকবার দেখা গেছে। শিশুমনে প্রোথিত এমন ভয় কাটাতে অনেক সময় লেগেছে। বিষয়টি মিথ্যা রটনা কিন্তু ভয়সঞ্চারী, তাই ঘটনা কিংবা রটনা যেটাই হোক না কেন সেটি মানব মনে ভয় কিংবা আনন্দ যেকোনোটাই সঞ্চার করতে পারে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সারা দিন কত খবর ভেসে আসে তার ইয়ত্তা নেই। এবার কোরবানির ঈদের আগে ও পরে নানা খবর এসেছে পত্রপত্রিকায়, যেগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে দেশে-বিদেশে জনে জনে। আমরা যারা পাঠক তারাও বুঝতে পারছিলাম না কোনটি সত্যি ঘটনা আর কোনটি রটনা। ফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এলোমেলো মন্তব্য করে যাচ্ছিলেন অনেকেই। কোরবানির জন্য কেনা গরু, ছাগল কিংবা অন্য পশুর সঙ্গে ছবি তোলা কিংবা তা ফেসবুক নামক সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করা অধুনাকালে কোনো ব্যতিক্রমী চিত্র নয়। কিন্তু এবার ঈদে এক তরুণ তার কিনতে যাওয়া একটি সুশ্রী ছাগলের সঙ্গে ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে দেন এবং জানান যে, কোরবানি দেয়ার জন্য তিনি ছাগলটি ১৭ লাখ টাকা দিয়ে কিনতে যাচ্ছেন। আমরা যখন কিশোর কিংবা যুবক ছিলাম তখন ফেসবুক ছিল না, তাই পত্রিকায় খবর খুঁজতাম সে বছর কোরবানির হাটে সবচেয়ে কত বেশি দাম উঠেছিল পশুর, কে কিনল সেটি। পত্রিকায় যেমন পশুটির ছবি থাকত তেমনি সেটির ক্রেতা এবং বিক্রেতারও হাসিমাখা ছবি থাকত। ধনকুবেরের নাম মানুষের মুখে মুখে, গণমাধ্যমে উচ্চারিত হতো। কিন্তু ফেসবুকের যুগে এসে ঘটল এ কী ঘটনা? বেরসিক মানুষ ছাগলের দিকে না তাকিয়ে দৃষ্টি দিল ছাগলের দাম কী করে ১৭ লাখ টাকা হয় আর এটি যিনি কিনতে যাচ্ছেন তার কত টাকা আছে সেদিকে। সংবাদমাধ্যমের কর্মীরাও লেগে গেলেন তথ্য অনুসন্ধানে। সংবাদমাধ্যমে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানা গেল ১৭ লাখ টাকায় ছাগল কিনতে যাওয়া তরুণের গর্বিত পিতা রাষ্ট্রের একজন অনেক ক্ষমতাশালী কর্মকর্তা যার কাজ হচ্ছে রাষ্ট্রের কোষাগারকে সমৃদ্ধ করা, কিন্তু তিনি তার নিজের কোষাগার সমৃদ্ধ করেছেন। এসব সম্পদের পরিমাণ সম্পর্কে নিত্যনতুন খবর আসছে পত্রপত্রিকায় এবং সেই শৌখিন তরুণের সুখ আর বিলাসিতার খবর দেখে ‘লাখ টাকা’ শব্দটি উচ্চারণ করতেও যাদের মুখ শুকিয়ে আসে তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তরুণের সেই ছাগলের সঙ্গে এখন যুক্ত হচ্ছে লাখ লাখ টাকার গরু, পাখি আরো কত কী! বেচারা ছাগলের কত ক্ষমতা! রাজাকে রাজ্যহারা করে রাস্তায় নামিয়ে আনার মতো কাজ করে ফেলেছে। যেমন ‘কথা বলা গাছটি’ মুহূর্তে কত মানুষকে জড়ো করে ফেলল, সব বিশ্বাস-অবিশ্বাস ভেঙে মানুষ আসতে থাকে গাছের এ অলৌকিক ক্ষমতা দেখতে কিংবা গাছের কাছ থেকে অলৌকিক কিছু পাওয়ার আশায়। ক্ষমতায় থাকা লোকগুলো যখন ক্ষমতা ভোগ করে তখন তাদের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না, অনেক সময় ধমকের সুরে আবার কখনো নিজেকে সাধু-দরবেশ পর্যায়ে পরিচিত করে অন্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করেন এবং বাগিয়ে নেয় অঢেল সম্পদ। যেমন এ ছাগলকাণ্ডের সঙ্গে আরো অনেক ক্ষমতা ও প্রভাবশালী কর্মকর্তার অঢেল সম্পদের কাণ্ড-খবর পত্রপত্রিকায়, সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হচ্ছে। এ নিয়ে সংবাদপত্রে যাদের অভিযুক্ত করা হচ্ছে তারাও তাদের সামাজিক সম্মান ও মর্যাদাহানি করায় সংবাদপত্রের ওপর রুষ্ট। এমনকি জোটবদ্ধভাবে প্রতিবাদও করা হচ্ছে। এটাই স্বাভাবিক যদি বিষয়টি ঘটনা না হয়ে রটনা হয়ে থাকে তাতে প্রতিবাদ করা উচিতও। কিন্তু আসলে কি রটনা?
এমন অনেক প্রতিষ্ঠানও আছে যেখানে জনসংযোগ ও প্রকাশনা অফিসে কর্তা বসানো হয়, যার কাজ হচ্ছে সংবাদকর্মী ‘ঠেকানো’ কিংবা ‘ম্যানেজ’ করা যাতে করে তাদের কোনো ‘অপকর্ম’ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হতে না পারে। এ কাজে কর্তার যত সফলতা বড় কর্তার কাছ থেকে তত বাহবা। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় বড় কর্তা বিভিন্নভাবে সবকিছু সামলালেও ক্ষমতা শেষ হয়ে গেলে কর্তাই বড় কর্তার সব কর্ম-অপকর্মের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে সংবাদমাধ্যমের কাছে হাজির হন। আহা! এত স্নেহ মমতা, সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যাকে কর্তার পদে বসালেন, সেই কিনা আজ গাছের মতো কথা বলা শুরু করেছে। বেকায়দায় পড়া বড় কর্তা ক্ষমতাহীন অবস্থায় যতই বলতে থাকুন যে তার বিরুদ্ধে যা বলা হচ্ছে তা রটনা, কে শোনে তার কথা, তার সব তথ্য-উপাত্ত তো ঘটনার বর্ণনাই দিচ্ছে।
গাছ, ছাগল, গরু, পাখি, জায়গা-জমি, রিসোর্ট যদি কথা বলতে পারত তাহলে বলে দিত কত টাকায়, কার টাকায় কীভাবে এসব সম্পদের মালিকানা পেল বড় কর্তা। সেক্ষেত্রে সাংবাদিকদেরও রটনা (!) রটানোর সুযোগ থাকত না এবং আমরা আমজনতাও ঘটনা-রটনা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগতাম না।
আবারো সেই কথা বলা গাছের কাছে ফিরে যাই। সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানতে পারলাম, শেষ পর্যন্ত ‘কথা বলা গাছটি’কে ২২ জুন কেটে ফেলা হয়েছে এলাকার গণ্যমান্যদের উপস্থিতিতে। হত্যার পূর্বে গাছটি কী কথা বলতে চেয়েছিল আমরা আর জানতে পারলাম না, শেষ বিচারে গাছটিরই প্রাণ গেল। দেশের বিভিন্ন স্থানে বনভূমিগুলো উজাড় করছে কিছু লোক, তাদের অনেকের দায়িত্ব আবার বনভূমি রক্ষা করা। টাঙ্গাইলের মধুপুর গড় আজ শালগাছ হারিয়ে কলাবাগান, আনারস বাগান, আকাশমণি কিংবা ইউক্যালিপটাসের উদ্যান হতে চলছে, বনের ভেতর গাছ পুড়িয়ে কয়লা বানানোর কারখানাও স্থাপিত হয়েছে এবং বাংলাদেশের অনেক বনভূমি একই পথে চলছে। সংবাদপত্রে, টেলিভিশনে এ নিয়ে সংবাদেরও শেষ নেই, কিন্তু কর্তাব্যক্তিরা বলছেন—এসবই গণমাধ্যমের ‘রটনা’ মাত্র, তারা রক্ষাকবচ হয়ে, অতন্দ্র প্রহরী হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। তাহলে ঘটনা কোনটি তা আমরা কীভাবে জানব যে কেন বন উজাড় হলো?
এই যে এত এত টাকার, সম্পদের মালিক হওয়ার খবর সংবাদপত্রে প্রকাশ হচ্ছে এবং সাংবাদিকরা রটাচ্ছে (!) তা যদি নিছক ‘রটনা’ হয়ে থাকে তাহলে আবারো সৃষ্টিকর্তার কাছে আবেদন—হে প্রভু এসব ‘রটনাকে’ মুছে দিয়ে গাছ, মাটি, পানি, ছাগল, গরু সবাইকে কথা বলার ক্ষমতা দান করো যাতে আমরা প্রকৃত ঘটনা জানতে পারি।
এএসএম সাইফুল্লাহ: অধ্যাপক, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়