লবণাক্ততা বৃদ্ধি, জোয়ারে ভূমিক্ষয়, কাঠ পাচার

বরগুনার সংরক্ষিত টেংরাগিরি বনাঞ্চলের গাছ কমছে

প্রকাশ: জুন ৩০, ২০২৪

সোহাগ হাফিজ, বরগুনা

বরগুনার তালতলী উপজেলার টেংরাগিরি বনাঞ্চলকে বলা হয় উপকূলীয় অঞ্চলের রক্ষাকবচ। সংরক্ষিত এ বনে গেওয়া, কেওড়া, সুন্দরীসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রয়েছে, যা ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে মানুষকে সুরক্ষা দিয়ে আসছে। এছাড়া বনে রয়েছে বানর, ৪০ প্রজাতির সাপসহ বিভিন্ন প্রাণী। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়েছে বনাঞ্চলে। সাগরের পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় হলদে হয়ে যাচ্ছে গাছের পাতা, মারা যাচ্ছে কাণ্ড। জোয়ারে বনের ভূমিক্ষয়ের কারণে উপড়ে পড়ছে গাছ। এছাড়া রয়েছে কাঠ পাচারের অভিযোগ। দীর্ঘদিন এ অবস্থা চলতে থাকায় বিস্তৃত হতে পারছে না বনাঞ্চলটি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন উজাড় হলে এর প্রভাব পড়বে জীববৈচিত্র্যের ওপর। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্রমে তাপমাত্রা বাড়ছে। এ অবস্থায় বনের সুরক্ষায় ভূমিকা রাখতে হবে।

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. নুরুল আমিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বনের গাছ বাঁচিয়ে রাখার দরকার। গাছ মরে গেলে অক্সিজেন কমে যাবে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটতে পারে। কোনো গাছ মারা যাক, সেটা আমাদের কাম্য নয়। কী কারণে শ্বাসমূলীয় বনের গাছ মারা যাচ্ছে, সেটা আমার জানা নেই। তবে গাছ মারা যাওয়া পরিবেশের জন্য হুমকি। গাছ বাঁচিয়ে রাখতে বন বিভাগকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কারণ উদ্ঘাটন করতে হবে।’

বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, টেংরাগিরি বনের আয়তন ১৩ হাজার ৬৪৪ একর। প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা টেংরাগিরি একসময় সুন্দরবনের অংশ ছিল। ১৯২৭ সালের বন আইনের জরিপ অনুযায়ী, ১৯৬০ সালের ১২ জুলাই এটিকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা করা হয়। ১৯৬৭ সালে টেংরাগিরি বনাঞ্চল হিসেবে নামকরণ করা হয়। বনে রয়েছে গেওয়া, জাম, ধুন্দল, কেওড়া, সুন্দরী, বাইন, করমচা, কেওয়া, তাল, কাঁকড়া, বনকাঁঠাল, রেইনট্রি, হেতাল, তাম্বুলকাটা, গরানসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। এছাড়া রয়েছে কাঠবিড়ালি, বানর, ৪০ প্রজাতির সাপ, সজারু, শূকর, কচ্ছপ, শেয়াল, বনমোরগসহ বেশকিছু বন্যপ্রাণী।

জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের টাকায় ইকোপার্ক

‘সংরক্ষিত বনাঞ্চলে ইকো ট্যুরিজমের সুযোগ বৃদ্ধি’ শীর্ষক কর্মসূচির অধীনে ২০০৯-১০ অর্থবছরে জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের ২ কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয়ে বনের মধ্যে নির্মাণ করা হয়েছে ইকোপার্ক। সেখানে রয়েছে পিকনিক স্পট, ব্রিজ, ওয়াকওয়েসহ যাত্রী ছাউনি ও বিভিন্ন স্থাপনা। 

এছাড়া বনের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে পাকা স্থাপনা নির্মাণ করায় বেড়েছে মানুষের আনাগোনা। আতঙ্কে আবাসস্থল ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে বন্যপ্রাণী। এ ব্যাপারে বরগুনা পাবলিক পলিসি ফোরামের আহ্বায়ক মো. হাসানুর রহমান ঝণ্টু বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করা হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে বাঁচতে। অথচ এ প্রকল্পের বরাদ্দকৃত অর্থের মাধ্যমেই গাছ উজাড় করে বিপন্ন করা হচ্ছে পরিবেশ। এতে করে উপকূলে আরো বেশি প্রকট হবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। যখন জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের অধীনে কোনো প্রকল্প নেয়া হয়, সরজমিনে পরিদর্শন করে অর্থ ছাড় করা উচিত।’

ভূমিক্ষয় ও বৃক্ষ নিধনে উজাড় হচ্ছে বন

জোয়ারের কারণে নলবুনিয়া, নিশানবাড়িয়া, আশারচর ও নিদ্রা-সখিনা এলাকায় বেশকিছু গাছ মারা যাচ্ছে। জোয়ারের সময় বালিতে ঢাকা পড়েছে গাছের শ্বাসমূল। ভাটায় গোড়ার মাটি সরে গিয়ে শেকড় বের হয়ে যাচ্ছে। বালিতে ঢাকা পড়ায় শ্বাসমূল থেকে গাছ জন্মাতে পারছে না। এছাড়া সমুদ্রের পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় গাছের পাতা ও কাণ্ড হলদেটে হয়ে যাচ্ছে। ঢেউ ও জোয়ারের পানি বনভূমির ক্ষয় ত্বরান্বিত করছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, গাছ মরার পাশাপাশি বন উজাড় হওয়ার আরো একটি বড় কারণ কাঠুরেদের উৎপাত। নিদ্রা, সখিনা, আশারচর, নলবুনিয়া বনসংলগ্ন গ্রামগুলোয় অনেকে বনের কাঠ সংগ্রহ করে পাচার করছে। কেওড়া ও গেওয়া গাছ জ্বালানি এবং সুন্দরী গাছ গৃহনির্মাণ ও আসবাব তৈরির কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। চার-পাঁচ বছর আগেও জোয়ারের পানি সৈকতের কাছাকাছি থাকত। এখন তা বনের তিন-চার কিলোমিটার পর্যন্ত ঢুকে পড়ছে।

বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, টেংরাগিরি, হরিণঘাটাসহ বরগুনায় ৭৫ হাজার একর বনভূমি রয়েছে। এর মধ্যে সংরক্ষিত বনাঞ্চল রয়েছে ৩০ হাজার একর। বিশাল এ বনভূমি সুরক্ষায় বরগুনার ছয়টি উপজেলায় দুটি বিট অফিস ও ১০টি ক্যাম্প অফিসে বনরক্ষী রয়েছে ২১ জন। শুধু লোকবল সংকট নয়, অধিকাংশ ক্যাম্প অফিসগুলোর বেহাল অবস্থা। বন পাহারা দেয়ার জন্য নেই পর্যাপ্ত যানবাহন।

পটুয়াখালী বিভাগীয় বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক মো. তারিকুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘টহল কার্যক্রম জোরদারে আমাদের প্রয়োজনীয় যানবাহনসহ জনবল সংকট রয়েছে। সংকট কেটে গেলে বনের সুরক্ষায় আরো বেশি তৎপর থাকবে বন বিভাগ।’

এ প্রসঙ্গে পটুয়াখালী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. সফিকুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যেকোনো শ্বাসমূলীয় বন গঠনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্তর আছে। শুরুতে উপকূলে ভূমি গঠনের পর উড়িগাছ জন্মায়। তার পর ভূমি কিছুটা শক্ত হলে উড়িগাছ মরে গিয়ে কেওড়া-গেওয়া জন্মায়। মাটি আরো শক্ত হলে আগের গাছগুলো মরে সেখানে সুন্দরী, গরানসহ অন্যান্য গাছ জন্মায়। বনের গাছ কেন মারা যাচ্ছে তা পরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দ্রুত এর বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে এটি শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চলের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি মোকাবেলায় আমরা ঝাউবাগান করেছিলাম। বনের কাঠ চুরির অভিযোগের বিষয়টি ভিত্তিহীন। কেউ যদি কাঠ চুরি করে, তবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫