বাজেট প্রতিক্রিয়া

প্রস্তাবিত বাজেটে কালো টাকাকে সাদা করার নীতি গণ ও নৈতিকতাবিরোধী

প্রকাশ: জুন ২৯, ২০২৪

ড. এম এম আকাশ

২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে দেশের সাধারণ মানুষের জন্য কিছু অঙ্গীকার ও প্রত্যাশা আছে। তবে আমার কাছে এসব অঙ্গীকার ও প্রত্যাশা অবাস্তব ও কল্পনাপ্রসূত মনে হয়েছে। যেমন দীর্ঘদিন ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিদ্যমান। প্রস্তাবিত বাজেটে উচ্চ মূল্যস্ফীতি দুই অংক থেকে সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। রফতানি সামান্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাই সেটা আরো বৃদ্ধি পাবে বলে প্রত্যাশা করা হয়েছে। রিজার্ভ বৃদ্ধি পাচ্ছে সেটা অব্যাহত থাকবে। এ দুটির বৃদ্ধির কারণে ডলারের দাম যে বাড়ছে সেই দাম আর বাড়বে না। আগের বাজেটের প্রত্যাশা ছিল বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ হবে ২৮ শতাংশ। কিন্তু হয়েছে ২৪ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটে ৪ শতাংশ বেড়ে ২৮ শতাংশ হয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। সরকারি খাতে বিনিয়োগ ৭ শতাংশ হয়েছে। তবে ৬ শতাংশ হলেও সরকারি-বেসরকারি সব মিলিয়ে ৩০ শতাংশ বিনিয়োগ হবে বলে ধরে নেয়া হয়েছে। ফলে প্রবৃদ্ধির হার হবে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এসব প্রত্যাশা ও অঙ্গীকার বাজেটে আছে। তবে এসব প্রত্যাশা ও অঙ্গীকার আমার কাছে মনে হয়েছে অবাস্তব ও কল্পনাপ্রসূত। কারণ এসব বাস্তবায়ন করতে যা করা দরকার সে বিষয়ে সরকারের কোনো কর্মকৌশল নেই। তাই এসব বিষয় বাস্তবায়ন করা সরকারের পক্ষে কষ্টসাধ্য। 

দীর্ঘদিন ধরেই দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিদ্যমান রয়েছে। সরকার প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলেছে। কিন্তু এটা বাস্তবায়ন করতে হলে বাজারের সিন্ডিকেশন ভাঙতে হবে। এছাড়া সরকারের মধ্যে যে ধনী শ্রেণীর প্রভাব আছে, সেই প্রভাব থেকে মুক্ত হতে হবে। সরকার ধনী শ্রেণীর প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারবে বলে মনে হয় না। 

সরকার যদি বাজার সিন্ডিকেট কোনোক্রমে ভেঙে ও কাঠামোগত সংস্কার করেস, ধনী শ্রেণীর প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে জনগণের প্রতি জবাবদিহিতা দেখাতে পারে, তার পরও মূল্যস্ফীতি নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রায় নামিয়ে আনতে পারবে না। কারণ এ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অন্যতম একটি বড় কারণ আমদানীকৃত পণ্যসামগ্রীর দাম বৃদ্ধি। বিদেশীদের দামের গতি-প্রকৃতি ও সরকারের আমদানি করার ক্ষমতার ওপর আমদানীকৃত পণ্যের দাম বৃদ্ধি নির্ভর করে। সরকারের আমদানি করার ক্ষমতা খুব কম। আর বিদেশীদের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা নেই, বরং বিদেশীরাই সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করছে। সেজন্য জ্বালানি, সার ও পানি এসবের দাম বাড়বে বা সরকার বাড়াতে বাধ্য হবে। 

এবারের বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পে (এডিপি) ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা, যেখানে প্রকল্প আছে ১ হাজার ২০০টির বেশি। গত ১০ বছরের তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, এডিপির মোট ব্যয় বরাদ্দের ৮৫ শতাংশ হয় এবং ১৫ শতাংশ অব্যয়িত থাকে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এডিপির ৮৫ শতাংশেরও কম ব্যয় হয়েছে। 

এবারের বাজেটে বিনা প্রশ্নে অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা, নগদ টাকা ও শেয়ারসহ যেকোনো বিনিয়োগ ১৫ শতাংশ কর দিয়েই তা বৈধ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ নীতি গণবিরোধী ও নৈতিকতাবিরোধী। কারণ এ নীতি দুষ্টুকে প্রশ্রয় দেয় এবং শিষ্টকে শাসন করে। এ নীতির মাধ্যমে ভালো বা শিষ্টদের তিরস্কার করা হচ্ছে। অথচ শিষ্টকে পুরস্কৃত করা এবং দুষ্টুকে শাসন করা উচিত ছিল। কারণ যে ব্যক্তি কালো টাকা উপার্জন করেছে সে দুষ্ট প্রকৃতির লোক, তা না হলে সে কেন কালো টাকা উপার্জন করবে? কালো টাকাকে সাদা করার সুযোগ দেয়ার মাধ্যমে অন্যায়কারীকে অন্যায় কাজ করার সুযোগ দেয়া হলো। তাকে কেন শাস্তি দেয়া, সেটি একটি প্রশ্ন। অর্থাৎ অপরাধীরা অপরাধ করেও শাস্তি পেল না বরং তারা ছাড় পেল। 

অন্যদিকে সৎ বা শিষ্টের ক্ষেত্রে কী হলো? যারা বৈধভাবে উপার্জন করেন ও নিয়মিত কর দেন তাদের ৩০ শতাংশ কর দিতে হবে। অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থকে বৈধ করতে ১৫ শতাংশ করের সুযোগ দেয়ার মাধ্যমে নিয়মিত ও সৎ করদাতাদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। বৈধ উপার্জনকারীদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাবের জন্ম দেবে। তারা ভাববেন, অবৈধভাবে উপার্জন করলেও যেহেতু কোনো ক্ষতি হয় না ও পরে তা বৈধ করার সুযোগ থাকে—তাহলে কেন নিয়মিত কর দেব? দুষ্টের মতোই কালো টাকা সাদা করে নিতে পারব। সুতরাং এ সুযোগ শিষ্টকে তিরস্কৃত করে এবং দুষ্টকে পুরস্কৃত করে। সে কারণে এটি গণবিরোধী ও নৈতিকতাবিরোধী সিদ্ধান্ত। 

২০২৪-২৫ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। অঙ্গীকার বাস্তবায়নের সক্ষমতা থাকলে সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা কঠিন। দেশে অনেক নিয়ম আছে, কিন্তু আমরা পালন করি না। যথাসময়ে কর না দিলে টাকা অবৈধ বা কালো হয়ে যায়। আবার প্রস্তাবিত বাজেটে কর দিয়ে কালো টাকাকে সাদা করার সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে বাজেটে এ ধরনের শিথিলতা তৈরি করা হয়েছে। অতীতে ও বর্তমানেও সেই শিথিলতাকে রক্ষা করে চলছে। সুতরাং কর আদায়ে কঠোর না হলে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কখনই পূরণ হবে না। 

অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের কর ব্যবস্থায় লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব। কারণ সেসব দেশে করনীতি আইনের মতো প্রয়োগ হয়ে থাকে। কেউ আইন ভঙ্গ করলে তাকে রেহাই দেয়া হয় না। তাকে আইনের আওতায় আনা হয়। 

সরকারের ব্যাংকনির্ভরতা অর্থনীতিতে ক্রাউডিং আউট ইফেক্টস তৈরি করবে। একটি ব্যাংকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ঋণযোগ্য তহবিল আছে। এখন প্রশ্ন হলো, কে এ ঋণ নেবে? সরকার যত বেশি ঋণ নেবে বেসরকারি খাতের জন্য তত কম থাকবে। এবার যেহেতু তারল্য সংকট আছে, নন-পারফরমিং লোন (এপিএল) আছে সে কারণে সরকার যদি বেশি নেয় তাহলে বেসরকারি খাতে খুব কমই থাকবে। তার ওপর সুদের হার এখন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, সুতরাং বেসরকারি খাত চাইলেও উচ্চ মূল্যের সুদ দিয়ে ঋণ নিতে পারবে না। ফলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য কম হবে। কর্মসংস্থান কম হবে। যেহেতু ব্যবসা-বাণিজ্য কম হবে তাই সরকারের রাজস্ব আহরণ কম হবে। ফলে সরকারের ব্যাংকনির্ভরতা অর্থনীতিতে এক ধরনের সংকট সৃষ্টি করবে। 

দেশের আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও রফতানি বৃদ্ধির মধ্যে কোনো বৈষম্য করা উচিত নয়। ১ ডলার আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ১ ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়। ১ ডলার রফতানি করতে পারলে যদি ওই রফতানীকৃত পণ্যের মধ্যে আমদানীকৃত কাঁচামাল না থাকে, তাহলেও ১ ডলার আয় হয়। কিন্তু দেশে সাধারণত ১ ডলার রফতানির মধ্যে কাঁচামাল খরচ হিসেবে কিছু বৈদেশিক মুদ্রা থেকে যায়। সুতরাং ১ ডলার রফতানি করে নিট রফতানি আয় ১ ডলার হয় না। কিন্তু আমদানির ক্ষেত্রে ১ ডলার দামের কোনো বিদেশী পণ্য যদি না আনা হয় যদি দেশী পণ্য দিয়ে সে অভাব মেটানো হয় তাহলে পুরো ১ ডলারই সাশ্রয়ী হয়। তাই বাংলাদেশে রফতানির মাধ্যমে ডলার আয় করার চেয়ে আমদানি প্রতিস্থাপন অধিক কার্যকর বলে মনে করি। যদি না ওই আমদানি প্রতিস্থাপন করার জন্য যে কারখানা তার কাঁচামাল আবার আমদানি করতে হয়। যদি সেটা হয় তাহলে আর হবে না। অর্থাৎ দুটোকে মিলিয়ে আমদানি ও রফতানির ক্ষেত্রে একই বিনিময় হারের একটি কৌশল নিতে হবে। 

দেশে আমদানি প্রতিস্থাপনের প্রতি বিরোধিতা আছে কিন্তু রফতানির প্রতি পক্ষপাতিত্ব আছে। আমদানি করেও যদি ১ ডলার পাওয়া যায় এবং রফতানি করেও যদি ১ ডলার পাওয়া যায় তাহলে এ দুটোর মধ্যে কোনো পক্ষপাত করা উচিত নয়। তাই অ্যাফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট (কার্যকর বিনিময় হার) দুই জায়গাতেই সমান হওয়া উচিত। এদিকে ব্যাংক খাতের অবস্থা খুবই নাজুক। ক্রমেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। প্রস্তাবিত বাজেটে সরকার ঋণখেলাপিদের বাঁচাতে চেয়েছে। কারণ ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কোনো নির্দেশনা নেই বাজেটে। যারা ঋণ পরিশোধ করছে না তাদের বাংলাদেশ ব্যাংক ধরেনি কেন? কারণ ঋণখেলাপি অত্যন্ত ক্ষমতাবান। 

খেলাপি ঋণে ভরপুর ব্যাংকগুলো এখন সরকারের টাকা দিয়েই ‍নিজেদের রক্ষার চেষ্টা করবে। আর তখন ক্ষমতাবানদের চাপে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনশীল মুদ্রানীতি থেকে পিছু হটে যায় কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়। 

ড. এম এম আকাশ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫