ভর্তুকির বিপরীতে বিশেষ বন্ড ইস্যু বন্ধ করতে বলেছে আইএমএফ

প্রকাশ: জুন ২৬, ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদক

নগদ অর্থের সংকটের কারণে বিদ্যুৎ ও সার খাতে ভর্তুকি বাবদ বিপুল অংকের অর্থ বকেয়া হয়ে পড়ে সরকারের। এ ভর্তুকি পরিশোধে আলোচ্য দুই খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর পাওনা পরিশোধে অর্থায়নকারী বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অনুকূলে বিশেষ বন্ড ইস্যু করে সরকার। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পক্ষ থেকে ভর্তুকি পরিশোধের পরিবর্তে বন্ড ইস্যু না করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য ঋণের তৃতীয় কিস্তি অনুমোদনের পর সংস্থাটির প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আর্থিক বিচক্ষণতার সুরক্ষায় নতুন করে বকেয়া এড়ানোর পাশাপাশি এরই মধ্যে পুঞ্জীভূত হওয়া বকেয়া পরিশোধ করা গুরুত্বপূর্ণ। স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ উৎপাদক (আইপিপি) ও সার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে বাড়তি ভর্তুকির দাবির কারণে ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে জিডিপির ১ শতাংশ পরিমাণ বকেয়া জমেছে। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ আইএমএফের কাছে নতুন করে বকেয়া পুঞ্জীভূত হওয়া এড়ানোর পাশাপাশি জমে থাকা বকেয়া আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে বাজেট থেকে পরিশোধ করার পরিকল্পনা করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বিদ্যুৎ ও সার কোম্পানিগুলোর পাওনা পরিশোধে ভর্তুকির পরিবর্তে বিদ্যমান বাজারদরের চেয়ে কম সুদে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বিশেষ বন্ড ইস্যু বন্ধ করার কথাও বলেছে আইএমএফ। সংস্থাটির তথ্যানুসারে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশ সরকার ২৬ হাজার ২০০ কোটি টাকার বিশেষ বন্ড ইস্যু করেছে।

আইএমএফের প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে চলেছে। আন্তর্জাতিক পণ্য এবং খাদ্যের ক্রমাগত উচ্চ মূল্য এবং বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা সামষ্টিক অর্থনৈতিক দুর্বলতাকে ত্বরান্বিত করছে। উদ্বৃত্ত থেকে ঘাটতিতে পড়ে যাওয়া আর্থিক হিসাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং বিনিময় হারের ওপর চাপ বাড়িয়েছে। যা সংস্কারের গতিকে পুনরুজ্জীবিত করার তাগিদ জানাচ্ছে। প্রতিবেদনের সারাংশে উপস্থাপিত সুপারিশে কঠোর মুদ্রানীতির সমর্থনে সামাজিক ও উন্নয়ন ব্যয়ের সুরক্ষার পাশাপাশি গৃহীত নীতিগুলোর জন্য রাজস্বভিত্তিক সমন্বয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বাহ্যিক ও মূল্যস্ফীতিজনিত চাপ তীব্র হলে গ্রহণ করা নীতিগুলোকে আরো কঠোর করতে প্রস্তুত থাকার সুপারিশও প্রতিবেদনে দিয়েছে আইএমএফ। মুদ্রা ও বিনিময় হার নীতি প্রসঙ্গে সুপারিশে বলা হয়েছে, বাড়ন্ত মূল্যস্ফীতির জন্য মুদ্রানীতি কঠোর করা প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত ক্রলিং পেগের কার্যকারিতাকে অগ্রাধিকার দেয়া। 

আর্থিক খাতের নীতি প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংক খাতের নন-পারফর্মিং ঋণ হ্রাস, ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি বাস্তবায়ন, করপোরেট সুশাসন বৃদ্ধি এবং নীতি সংস্থার ত্বরান্বিত করা হওয়া উচিত এখনকার অগ্রাধিকার। দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন ব্যবস্থা উন্নয়নে দেশীয় পুঁজিবাজারের বিকাশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা সুপারিশে বলা হয়েছে।

প্রতিবেদনে আইএমএফের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অ্যান্টোনেত্তে এম সায়েহর বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি একাধিক সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। কঠিন পরিবেশেও ঋণ কর্মসূচির কার্যকারিতা সঠিক পথে রয়েছে। কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় নীতিগত পদক্ষেপ ও সংস্কারের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আইএমএফের ঋণসহায়তা কর্মসূচি সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে সাহায্য করছে। পাশাপাশি শক্তিশালী অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং পরিবেশবান্ধব প্রবৃদ্ধির জন্য অর্থনৈতিক সংস্কারকে ত্বরান্বিত করতে সহায়তা করছে।’

বিনিময় হার পুনর্বিন্যাস এবং নতুন বিনিময় হার ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়নে সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলোকে স্বাগত জানিয়ে বিবৃতিতে অ্যান্টোনেত্তে এম সায়েহ বলেন, ‘স্বল্পমেয়াদি নীতিগুলোর অগ্রাধিকার হওয়া উচিত বহিঃখাতসংক্রান্ত সহনশীলতা পুনর্গঠন ও মূল্যস্ফীতি হ্রাস। ক্রলিং পেগের কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে পর্যায়ক্রমিক পর্যালোচনা গুরুত্বপূর্ণ হবে। আর্থিক ও রাজস্বনীতি ক্রমাগতভাবে কঠোর করা মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করবে।’

আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির আওতায় গত বছরের ডিসেম্বর সময়ে বাংলাদেশকে যেসব লক্ষ্যমাত্রা ও সংস্কার করতে বলেছিল আইএমএফ সেগুলোর মধ্যে একটি বাদে বাকি সবক’টিই পূরণ হয়েছে। শুধু নিট রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি বাংলাদেশ। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ১৭ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলারের নিট রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও এ সময়ে ১৬ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলারের নিট রিজার্ভ সংরক্ষণ করতে পেরেছে বাংলাদেশ। এ বছরের মার্চ শেষে ১৯ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলারের নিট রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত আইএমএফের লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে নিট রিজার্ভ সংরক্ষণ করতে পারেনি। বাংলাদেশের অনুরোধে আইএমএফ এ বছরের জুন শেষে রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা ২০ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার থেকে কমিয়ে ১৪ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলারে নামিয়ে এনেছে। সংস্থাটির তথ্যানুসারে এ বছরের এপ্রিল শেষে বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ ছিল ১২ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। আইএমএফের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে, এ বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ১৪ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ও ডিসেম্বর শেষে ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন এবং আগামী বছরের মার্চ শেষে ১৬ দশমিক ৭০ বিলিয়ন এবং জুন শেষে ১৯ দশমিক ৪৭ বিলিয়র ডলারের নিট রিজার্ভ সংরক্ষণ করতে হবে।

প্রসঙ্গত, গত বছরের ৩০ জানুয়ারি আইএমএফের নির্বাহী বোর্ডের সভায় বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। সাত কিস্তিতে ৪২ মাসে এ ঋণ পাবে বাংলাদেশ। ঋণের গড় সুদের হার ২ দশমিক ২ শতাংশ। ২০২৬ সাল পর্যন্ত এ ঋণ কর্মসূচি চলাকালীন বাংলাদেশকে বিভিন্ন ধরনের শর্ত পরিপালন ও সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার এবং গত বছরের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ গত সোমবার আইএমএফের পর্ষদে তৃতীয় কিস্তি বাবদ ১১৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার ছাড়ের বিষয়টি অনুমোদন করা হয়েছে। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ঋণ কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশের জন্য ২২৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার ছাড় করেছে আইএমএফ।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫