গণেশ হালুই ও তার একটি শিল্পগ্রন্থের কথা

প্রকাশ: জুন ২৬, ২০২৪

আলম খোরশেদ

উপমহাদেশের এ সময়ের জীবিত ও সক্রিয় চিত্রশিল্পীদের মধ্যে অন্যতম বয়োজ্যেষ্ঠ ও বরিষ্ঠ শিল্পী সর্বজনশ্রদ্ধেয় শ্রীগণেশ হালুই, যিনি জন্মেছিলেন এই বাংলাদেশেরই জামালপুর জেলায় ১৯৩৬ সালে এবং সেখানেই তার ছবি আঁকায় হাতে খড়ি ও হাতযশ লাভ হয়। দেশভাগের কারণে ১৯৫০ সালে পুরো পরিবারসহ ঠাঁইনাড়া হয়ে কলকাতায় শরণার্থী জীবনের কঠিন সংগ্রাম ও প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি তার সেই অভ্যাস অব্যাহত রাখেন এবং জন্মভূমিরই প্রিয় এক স্কুল শিক্ষকের অনুপ্রেরণায় কলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তি হয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে সেখানেই দীর্ঘকাল শিক্ষকতা করেন। পাশাপাশি ছবি আঁকা, প্রদর্শনী করা, অজন্তার গুহাচিত্রের ওপর তন্নিষ্ঠ গবেষণা এবং চিত্রকলাবিষয়ক নানাবিধ লেখালেখি অব্যাহত রাখেন। সম্প্রতি তার অত্যন্ত স্নেহভাজন একজন বাংলাদেশী শিল্পানুরাগী ও সংগ্রাহক অগ্রজপ্রতিম বন্ধুর কল্যাণে তার রচিত একটি ভিন্নধর্মী শিল্পগ্রন্থ, স্বহস্তে লিখিত উপহারলিপিসমেত, পাওয়ার সৌভাগ্য হয় এ আলোচকের। বর্তমান নিবন্ধটি মূলত সেই গ্রন্থেরই একটি দ্রুতলেখ পাঠপ্রতিক্রিয়া, যা আর কিছু নয়, এ মহান শিল্পীর প্রতি আমার অসীম কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনেরই একটি বিনম্র প্রয়াসমাত্র। 

বইটির ভাষা ইংরেজি; নাম Musings on art। প্রকাশ হয়েছে গত বছর জুলাইয়ে, কলকাতার দেবভাষা প্রকাশনী থেকে, যারা তার আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের প্রকাশক। আপন জনক ও জননীকে উৎসর্গকৃত বইটি সম্পর্কে লেখক জানিয়েছেন, এটি তার ১৯৯৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যকার চিন্তার ফসল। এতে প্রধানত তার শিল্পভাবনার প্রতিফলন ঘটলেও পাশাপাশি জীবনের গভীর বীক্ষণ ও উপলব্ধিরও পরিচয় মেলে। বইটিতে ভূমিকাসহ মোট ১০টি নাতিদীর্ঘ চিন্তামূলক রচনা স্থান পেয়েছে, যার শিরোনামগুলো হচ্ছে: Works of Art; Art-objects; Feelings; Art and Design; Dis tortion in Painting; The urge/Abs traction; Difference; The World of Art I My Search|। শিরোনামহীন প্রারম্ভিক রচনায় লেখক স্বীকার করেন যে শিল্প কী? তিনি কেন আঁকেন? এসব প্রশ্ন তার মনে উদয় হয়েছে অনেক পরে। তিনি এর উত্তরে নিজেই নিজেকে জিজ্ঞাসা করছেন, যদি কোনো অভ্যন্তরীণ তাগিদ থেকেই তার এ সৃষ্টিশীলতার জন্ম, তাহলে সেই তাগিদের উৎসটিইবা কী? বস্তুত গ্রন্থভুক্ত পরবর্তী নয়টি নিবন্ধে সেই উৎসের সন্ধানেই নিজেকে নিমগ্ন করেছেন তিনি। ভূমিকাগদ্যটির পরের পৃষ্ঠাতেই তিনি তুলি কিংবা কলমের মোটা আঁচড়ে একখানি চিত্রকর্ম উপহার দেন আমাদের, যেখানে একজোড়া বিস্ময়চিহ্ন ও প্রশ্নচিহ্নকে পাশাপাশি পরস্পরলিপ্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি আমরা, যেটি আমার বিবেচনায় এই গ্রন্থের অন্তর্লীন সারবস্তুটিকেই চিহ্নের ভাষায় প্রকাশ করে।

উল্লেখ্য, চিত্রকর্মটির মতো আরো নয়টি সাদা-কালো, মূলত রেখাভিত্তিক স্কেচ কিংবা নকশাধর্মী চিত্রকর্ম রয়েছে এ বইয়ে, যা গ্রন্থটির মূল্য ও শোভাবর্ধনের পাশাপাশি শিল্পীর সুচিন্তিত লেখাগুলোরও একধরনের শৈল্পিক পরিপূরক হিসেবে কাজ করে।

গ্রন্থের প্রথম রচনা Works of Art-এ শিল্পী গণেশ হালুই সামগ্রিকভাবে শিল্প সম্পর্কে, বিশেষ করে নিজের শিল্প বিষয়ে খুব মৌলিক ও প্রণিধানযোগ্য একটা কথা বলেন। তার মতে, মানুষ গভীর কোনো বেদনা থেকে জাত একধরনের আবেগ দ্বারা চালিত হয়ে থাকে, যা সে তার শৈশব থেকেই সঙ্গে বহন করে আনে। তার জীবনের সব সৃষ্টিশীল কর্মের গভীরে এ জোরালো আবেগের অভিঘাতটুকুই কাজ করে। যেকোনো শিল্পকর্মে এ অভিঘাতের স্বরূপটুকুকেই বলা হয় তার মৌলিকতা। আমরা শিল্পী গণেশ হালুইয়ের সব কর্মে ও ভাবনায়; বিশ্বাসে ও প্রকাশে তার শৈশব স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার যে শৈল্পিক প্রতিফলন দেখতে পাই, সেটি তার এ আশ্চর্য অভিব্যক্তিরই সাক্ষ্য দেয়। পরবর্তী রচনা Art-objects-এ তিনি রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে বলেন, শিল্প মানুষকে পার্থিব প্রয়োজনের বোঝা এবং তার দাসত্ব থেকে মুক্ত করে দেয়। The World of Art শীর্ষক গ্রন্থের ক্ষুদ্রতম রচনাটি এতই সারগর্ভ, সুলিখিত ও কবিত্বময় যে এর পুরোটাই, তার অপূর্ব ইংরেজিতেই, উদ্ধৃত করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। মাত্র ছয় লাইনের এ হিরণ্যপ্রভ লেখাটির ভাষ্য এ রকম: 

Any true painting or sculpture seems to dwell in a world of silence. It never speaks of itself, nor does it ask for any attention. It does not make a move, but instantly creates a vibration in our minds. It immediately leads us to its inner world. This world beyond the barrier of time and without borders inspires us to affirm ‘becoming’. It neither commences, nor does it end. This world that lies beyond ques tions and answers does not exist.

রচনাটির পার্শ্ববর্তী পৃষ্ঠায় তার নিজের করা একটি ক্যালিগ্রাফিতে আমরা এ becoming শব্দটিকেই উজ্জ্বল বিভায় উৎকীর্ণ হয়ে থাকতে দেখি।

এ গ্রন্থের বেশ একটি প্রয়োজনীয় ও প্রায়োগিক লেখা Art and Design, যা শিল্পরসিক, শিল্প শিক্ষার্থী, শিল্পী ও শিল্প সমালোচক সবারই কাজে লাগবে বলে মনে করি। তার মতে, একটি শিল্প তৈরি হয় তখনই, যখন সেটি জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত হয়; যে সংযুক্তিটুকু ছাড়া তা স্রেফ একটি নকশায় পর্যবসিত হয়; জীবনচেতনা কিংবা আত্মাবিহীন। এ আত্মা নামের বস্তুটি আমাদের হৃদয়ের গভীরে লুকানো থাকে, বাইরের দেহখাঁচাটি একটি নকশামাত্র, তার আত্মার নির্যাসটুকুই হচ্ছে আসল শিল্প। তার এ অন্তর্ময় উক্তির সমর্থনে তিনি একটি চমৎকার ছবিও যুক্ত করে দেন লেখাটির সঙ্গে, যার কোন অংশটি নকশা আর কোন অংশটুকু শিল্প, সেটি পরিষ্কারভাবে চিহ্নিত করে, যা বেশ অভিনব ও শিল্পসমঝদারির জন্য কার্যকর সন্দেহ নেই। 

আলোচ্য গ্রন্থের সর্বশেষ লেখা My Search-এর ওপর কিঞ্চিৎ আলোকপাত করেই আমার এ লেখার ইতি টানব। লেখাটির শুরুতেই শিল্পী গণেশ হালুই আবারো উল্লেখ করেন, তিনি নিজেকে খোঁজার জন্যই ছবি আঁকেন, একজন প্রত্নবিদের মতো নিজের গভীরে নিজেকেই খনন করে চলেন অবিরত। সেই আত্মানুসন্ধানের ভেতর দিয়ে তিনি ফিরে যান তার সেই হারানো শৈশবে, ফেলে আসা জীবনে। তার ভাষায়: ‘এই জীবন অকল্পনীয় মনে হয়। কোন সুদূর অতীতে আমি জন্মেছিলাম ব্রহ্মপুত্র নদীতীরের কোনো এক গ্রামে। এই নদী অববাহিকায় মানুষেরা প্রকৃতির সঙ্গে যে সম্পর্কসূত্র স্থাপন করে আমি এখনো তার অনুসন্ধানে রত। জগৎ আমার সামনে নিজেকে প্রকাশ করে অন্ধকারে, তেল ও সলতের সম্মিলনে সামান্য একটি কুপি জ্বালানোর মধ্য দিয়ে। আমি পাগলের মতো সেই ভাটিয়ালি গানের সুরটিকে খুঁজে ফিরি, খোলা আকাশের নিচে, নদীতীরে, যে সুর বাতাসের মতো বয়ে যায়।’ লেখাটির শেষে তিনি নিজ হাতে এঁকে দেন একটি বড়সড় Q, যা আর কিছু নয় পূর্বোল্লিখিত Ques t শব্দটিরই আদ্যক্ষর, যে অনুসন্ধান তার আজও অব্যাহত, আর যে আত্মানুসন্ধানের কথা খোদ রবীন্দ্রনাথ উচ্চারণ করেন তার গানে, ‘আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না...’।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫