সিলেট বিভাগে বন্যা-পরবর্তী রোগের প্রাদুর্ভাবের শঙ্কা

প্রকাশ: জুন ২৪, ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদক

বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করেছে সিলেট বিভাগে। একই সঙ্গে স্পষ্ট হচ্ছে বন্যা-পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতি। কয়েক দফা বন্যায় ব্যাহত হয়েছে বিভাগের বিভিন্ন অঞ্চলের স্বাভাবিক স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম। কোথাও কোথাও প্লাবিত হয়েছে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। ফলে সে সময় দেয়া যায়নি চিকিৎসাসেবা। পানি কমতে শুরু করলেও বন্যা-পরবর্তী রোগ বাড়ছে। যদিও এর সঠিক পরিসংখ্যান জানাতে পারেনি সিলেট বিভাগীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ। তবে পরিস্থিতির জটিলতা প্রকাশ্যে আসতে আরো কয়েক দিন সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, বন্যার পানি নেমে গেলে স্বাভাবিকভাবেই রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ে। তবে যেসব প্রস্তুতি থাকার কথা, তা নেয়া হয়েছে। প্রয়োজনীয় ওষুধের যে মজুদ রয়েছে, তাতে সংকট হবে না। পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে তা বোঝার জন্য আরো কয়েক দিন সময় লাগবে। কেননা এখন আশ্রয় কেন্দ্র থেকে মানুষ বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে।

জানা যায়, বন্যায় সবচেয়ে বেশি বিপর্যয়ে পড়ে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলা। বিভাগের বেশির ভাগ নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল। পানিবন্দি হয়ে পড়ে ১৫ লাখের বেশি মানুষ। বিশেষ করে সিলেট ও সুনামগঞ্জের প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়। কোনো কোনো অঞ্চলে প্লাবিত হয়েছে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো। এ কারণে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির টিকা। বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে নিরাপত্তার অংশ হিসেবে সরানো হয় টিকা। দুর্গত এলাকায় বাড়তে শুরু করেছে আঘাতজনিত, শ্বাসকষ্ট ও ডায়রিয়ার রোগী সংখ্যাও। এরই মধ্যে সিলেটের গোয়াইনঘাটে শ্বাসকষ্টের রোগী বাড়তে শুরু করেছে। তবে শুরুতে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে অক্সিজেন সরবরাহে সমস্যা দেখা দিলেও এখন স্বাভাবিক।

সিলেট বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বিভাগের চারটি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, ৬৬টি কমিউনিটি ক্লিনিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব কমিউনিটি ক্লিনিকের ৫১টি সিলেটে, ১৩টি সুনামগঞ্জে, পাঁচটি মৌলভীবাজারে ও একটি হবিগঞ্জে। বন্যাকবলিতদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে সিলেট বিভাগে ৪০০ মেডিকেল টিম কাজ করছে। এর মধ্যে সিলেটে ১২৬টি, সুনামগঞ্জে ৯৯, হবিগঞ্জে ৯৪ ও মৌলভীবাজারে ৭৪টি রয়েছে। প্রথম দিকে সিলেট জেলার তিনটি উপজেলায় হাসপাতাল চত্বর প্লাবিত হওয়ায় কয়েকদিন ব্যাহত হয় নিয়মিত চিকিৎসাসেবা। সিলেটের পরে সবচেয়ে বেশি বন্যাকবলিত হয় সুনামগঞ্জ। জেলার ছাতক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নিচতলা ও কৈতক ২০ শয্যার হাসপাতাল প্লাবিত হয়।

সিলেট বিভাগীয় পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সিলেট জেলার ২৬টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র পানিতে নিমজ্জিত হয়। এর মধ্যে ১০টি কেন্দ্র শতভাগ নিমজ্জিত হয়। চারটি কেন্দ্রের সিংহভাগই প্লাবিত হয়। তবে তাৎক্ষণিক ওষুধপত্রসহ পণ্য অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়। এতে সেবা কার্যক্রম সাময়িক বাধাগ্রস্ত হয়। এছাড়া সুনামগঞ্জ জেলার ২১টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র প্লাবিত হয়। যার মধ্যে পাঁচটি শতভাগ প্লাবিত হয়েছে। বাকিগুলোর সিংহভাগই প্লাবিত হয়। এসব কেন্দ্রে নৌকায় করে সেবা নিতে আসছেন সেবাগ্রহীতারা। চলমান বন্যায় সিলেট জেলার ২৬টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র প্লাবিত হওয়ায় সাময়িকভাবে সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হলেও এখন অবস্থার উন্নতি হয়েছে বলে বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন সিলেট জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের উপপরিচালক তপন কান্তি ঘোষ।

বন্যার পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে সংক্রামক ও ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পাবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্যবিদরা। তারা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় সংকট সৃষ্টি হবে। পুষ্টির অভাব দেখা দেবে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক অক্সফোর্ড অ্যাকাডেমি জার্নাল ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পেডিয়াট্রিক ইনফেকশাস ডিজিজেস জার্নাল বলছে, বন্যা চলমান সময়ে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু, সাপের দংশনের ঘটনা, বিভিন্ন রাসায়নিক পানিতে মিশে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হবে। বন্যা-পরবর্তী ১০ দিনে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়ার কারণে সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়তে পারে। নিউমোনিয়া, শ্বাসনতন্ত্রের রোগ, ডায়রিয়া, কলেরা, গ্যাস্ট্রিক দেখা দিতে পারে। দুর্গত এলাকার মানুষ মানসিক ব্যাধিতেও আক্রান্ত হতে পারে। বন্যার কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় ওষুধ সংকট দেখা দিতে পারে বলেও জানিয়েছেন স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিতরা।

২০২২ সালে সিলেট বিভাগে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। সে সময় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যে তথ্য দিয়েছিল তাতে দেখা যায়, সিলেট, ময়মনসিংহ, রংপুর ও চট্টগ্রামের ৩১ জেলায় ডায়রিয়া, শ্বাসনতন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগ (আরটিআই), বজ্রপাত, সর্প দংশন, পানিতে ডোবা, চর্মরোগ, চোখের প্রদাহ, আঘাতপ্রাপ্ত ও অন্যান্য কারণে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। আক্রান্ত হয় ১০ হাজারের বেশি মানুষ।  

ওই সময়ের মতো বর্তমানে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ না হলেও পানি নামার পর স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ার আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি শিশু, কিশোরী ও নারীদের ১১টি মারাত্মক সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে টিকাদান কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ টিকা নিয়মিতভাবে প্রয়োগ করা হয়। তবে চলমান বন্যা পরিস্থিতির কারণে টিকাদান কর্মসূচি ব্যাহত হচ্ছে।

ভারি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জে বন্যায় হাজার হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়ে। জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য বলছে, অন্তত ২০টি কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্লাবিত হয়। পানিবন্দি মানুষ পড়ে বিশুদ্ধ পানির সংকটে।

জেলার ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. শুকদেব সাহা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বন্যার পানি সুনামগঞ্জের ১২টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রতিটির ক্যাম্পাস প্লাবিত হয়। ছাতক-দোয়ারাবাজার উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিক পানিতে প্লাবিত হয়। এর মধ্যে দোয়ারাবাজার উপজেলার নয়টি ও ছাতকের ১০টি কমিউনিটি ক্লিনিক প্লাবিত হয়। ওষুধের যে মজুদ রয়েছে তাতে সংকট এখনো দেখা যায়নি। বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রসহ জেলায় শতাধিক চিকিৎসা দল কাজ করছে।’ 

অন্যদিকে সুনামগঞ্জ জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় জানিয়েছে, বন্যায় জেলার তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলার ২০টির বেশি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। 

মৌলভীবাজারে বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলা জুড়ি, কুলাউড়া ও বড়লেখা। জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, তিনটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মধ্যে কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নিচতলা পানিতে প্লাবিত হয়। জেলায় ৬৭টি ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মধ্যে কয়েকটি প্লাবিত হয়। জেলার চারটি কমিউনিটি ক্লিনিকে পানি প্রবেশ করায় কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে সদর উপজেলায় দুটি ও জুড়ি উপজেলায় দুটি। জেলায় ৭৪টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে।

সিলেট বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মো. আনিসুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘২০২২ সালে যখন সিলেটে বন্যা হয়েছিল, তখন অনেক বেশি ক্ষতি হয়েছিল। এবারের বন্যা ততটা ভয়াবহ নয়। তবে আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে। বন্যায় স্বাভাবিকভাবেই শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া, পেটের পীড়া দেখা দেয়। বিভাগের কয়েকটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র পানিতে প্লাবিত হয়েছিল। তবে বেশিক্ষণ স্বাস্থ্যসেবা যেন ব্যাহত না হয় এজন্য আমাদের সচেষ্ট কার্যক্রম ছিল। ওষুধের মজুদ যা রয়েছে তাতে সংকট দেখা  দেবে না। রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়তে পারে। মানুষ আশ্রয় কেন্দ্র থেকে বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছে। তারা যেন অসুস্থতার মধ্যে না পড়ে, এজন্য আমরা সচেতনতা কার্যক্রম চালাচ্ছি। বন্যা-পরবর্তী রোগ বাড়লে যেন প্রয়োজনীয় চিকিৎসা অব্যাহত রাখা যায়, সে প্রস্তুতি আমাদের রয়েছে।’

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন বণিক বার্তার সিলেট, মৌলভীবাজর ও সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি)


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫