১০ সমঝোতা স্মারক ও নথি সই

বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে চলবে ভারতের ট্রেন

প্রকাশ: জুন ২৩, ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদক

পশ্চিমবঙ্গের গেদে থেকে ভুটান সীমান্তবর্তী ডালগাঁও পর্যন্ত বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ট্রেন চালাতে চায় ভারত। এ বিষয়ে আগে প্রস্তাব দেয়া হলেও গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছে। আলোচনা হয়েছে তিস্তা প্রকল্প নিয়েও। সেই সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সুসংহত করার পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা জোরদারে ১০টি সমঝোতা স্মারকে (এমওইউ) সই করেছে বাংলাদেশ ও ভারত। নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউজে গতকাল দুপুরে দুই দেশের সরকারপ্রধানের মধ্যে একান্ত ও দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে তাদের উপস্থিতিতেই এসব এমওইউ সই হয়। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান। 

বর্তমানে পাঁচটি রুটে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ট্রেন চলে। তিনটি যাত্রীবাহী ইন্টারচেঞ্জ, বাকি দুটি পণ্যবাহী। বর্তমান নিয়মানুযায়ী, ভারতীয় ট্রেন সীমান্তে আসার পর বাংলাদেশী ইঞ্জিনে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আসে। বাংলাদেশী লোকোমাস্টার (চালক) তা চালিয়ে আনেন। ফিরে যাওয়ার সময়েও একই নিয়ম অনুসরণ করা হয়। এখন ভারত পশ্চিমবঙ্গের গেদে থেকে ভুটান সীমান্তবর্তী ডালগাঁও পর্যন্ত পণ্যবাহী ট্রেন চালু করতে চায়। এক্ষেত্রে সময় ও দূরত্ব কমাতে ব্যবহার করতে চায় বাংলাদেশের রেলপথ। অর্থাৎ দর্শনা দিয়ে ঢুকে ঈশ্বরদী-আব্দুলপুর-পার্বতীপুর হয়ে চিলাহাটি পর্যন্ত বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভারতীয় ট্রেনটি আবার ভারতে প্রবেশ করবে। 

দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপক্ষীয় বৈঠক ও এমওইউ সই অনুষ্ঠান শেষে গতকাল বিকালে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এ নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের রেলপথ ব্যবহার করে ভারতের একটা অংশ থেকে আরেক অংশে রেলওয়ে সংযোগ চালু করতে চায়। এ নিয়ে দুই দেশের নেতার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে।’

বিনয় কোয়াত্রা বলেন, ‘আমরা রাজশাহী ও কলকাতার মধ্যে একটি নতুন যাত্রীবাহী ট্রেন পরিষেবা শুরু করছি। এছাড়া বাংলাদেশ রেলওয়ের পথ ব্যবহার করে গেদে-দর্শনা থেকে হলদিবাড়ি-চিলাহাটি ক্রসবর্ডার ইন্টারচেঞ্জ পয়েন্ট পর্যন্ত একটি পণ্যবাহী ট্রেনের ট্রায়াল চালানো হবে। আগামী মাসে কোনো এক সময়ের জন্য এর পরিকল্পনা করা হয়েছে। এটি ভুটানের সঙ্গে উপ-আঞ্চলিক সংযোগে সহায়তা করবে।’

রেলওয়ে সংযোগের বিষয়ে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘রেলওয়ের জন্য এমওইউ ছিল দুই দেশের রেলওয়ের মধ্যে সংযোগ স্থাপন সংক্রান্ত। এর মধ্যে প্রায় ছয়টি আন্তঃসীমান্ত রেল যোগাযোগ রয়েছে। তবে আন্তঃসীমান্ত রেল সংযোগের গুরুত্ব ছাড়াও এ রেল যোগাযোগের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো বাংলাদেশের ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে ভারতের বিভিন্ন অংশের মধ্যে ট্রানজিট। এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করেই আজকে (গতকাল) আলোচনা হয়েছে।’ 

পরীক্ষামূলক রেল চলাচলের বিষয়ে বিনয় কোয়াত্রা বলেন, ‘এ কানেক্টিভিটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামোর একটি খুব বড় অংশকে শক্তিশালী করে। প্রকৃতপক্ষে এটি উভয় দেশ, উভয় সমাজ, উভয় অর্থনীতিকে ব্যাপকভাবে উপকৃত করবে। পাশাপাশি আলোচনায় ছিল উপ-আঞ্চলিক ট্রানজিট, যা ভুটান ও নেপালে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সুযোগ পাবে। বিদ্যমান অংশটিকেও আরো প্রসারিত ও শক্তিশালী করা হবে।’ 

এর আগে স্বাক্ষর হওয়া সমঝোতা স্মারকের মধ্যে নতুন রয়েছে সাতটি এবং নবায়ন হয়েছে তিনটির। সমুদ্র অর্থনীতি ও সামুদ্রিক সম্পদ, রেলওয়ে কানেক্টিভিটি, ডিজিটাল অংশীদারত্ব, স্বাস্থ্য ও ওষুধ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, মৎস্য খাত ইত্যাদিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এমওইউগুলো সই হয়। 

ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ডিজিটাল অংশীদারত্ব, টেকসই ভবিষ্যতের সবুজ অংশীদারত্ব এবং পারস্পরিক মেরিটাইম সহযোগিতা ও সুনীল অর্থনীতি নিয়ে নতুন তিনটি এমওইউতে সই করেছে দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এছাড়া দুই মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্য ও ওষুধ খাতে সহযোগিতা নিয়েও পুরনো একটি এমওইউ নবায়ন করেছে। এ চার এমওইউতে নিজ নিজ দেশের পক্ষে সই করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন ও ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রা।

একটি যৌথ ক্ষুদ্র উপগ্রহ প্রকল্পে সহযোগিতার লক্ষ্যে ভারতের জাতীয় মহাকাশ প্রচার ও অনুমোদন কেন্দ্র (ইন-স্পেস) এবং বাংলাদেশের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে এমওইউ সই হয়েছে। এতে নিজ নিজ দেশের পক্ষে সই করেন বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও সিইও ড. শাহজাহান মাহমুদ এবং ভারতের ডিপার্টমেন্ট অব স্পেসের সচিব এস সোমনাথ। 

রেল কানেক্টিভিটি নিয়ে দুই দেশের রেল মন্ত্রণালয়ের মধ্যে হওয়া সমঝোতায় নিজ নিজ পক্ষে সই করেন বাংলাদেশ রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. হুমায়ুন কবির ও ভারতের রেলওয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যান জয়া সিনহা। 

ভারত মহাসাগরে সমুদ্রবিজ্ঞান নিয়ে যৌথ গবেষণার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ওশেনোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট (বিওআরআই) ও ভারতের কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চের (সিএসআইআর) মধ্যে নতুন একটি এমওইউ সই হয়েছে। এছাড়া দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং মৎস্য খাতে দুটি এমওইউ নবায়ন হয়েছে। এমওইউ তিনটিতে সই করেন ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. মুস্তাফিজুর রহমান ও বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা। 

এছাড়া ডিফেন্স সার্ভিসেস স্টাফ কলেজ (ডিএসএসসি), ওয়েলিংটন ও ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজ (ডিএসসিএসসি) মিরপুরের মধ্যে স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড অপারেশনাল স্টাডিজ বিষয়ে সামরিক শিক্ষাসংক্রান্ত একটি এমওইউ সই হয়। এতে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল মিজানুর রহমান শামীম ও বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার নিজ নিজ পক্ষে সই করেন। 

এসব চুক্তি স্বাক্ষরের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে একান্ত ও দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের বিষয়ে দুই দেশের যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এসব বৈঠকে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, বাণিজ্য ও কানেক্টিভিটি, অভিন্ন নদী, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, উন্নয়ন সহযোগিতা, সাংস্কৃতিক এবং নাগরিক পর্যায়ের যোগাযোগ বিষয়ে আলোচনা হয়। উভয় নেতাই স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণে ‘ভিশন ২০৪১’ এবং ভারতের ‘ভিকশিত ভারত’ অর্জনে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছান। এছাড়া ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম, স্পেস টেকনোলজি, সবুজ জ্বালানি ও সুনীল অর্থনীতির মতো নতুন নতুন ক্ষেত্রে সহযোগিতা সম্প্রসারণের বিষয়েও তারা একমত হয়েছেন।

এতে আরো বলা হয়, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের বর্তমান সম্প্রসারণমুখী প্রবণতায় দুই নেতাই সন্তোষ প্রকাশ করেছেন এবং এর পরিমাণ বৃদ্ধির সম্ভাব্য ক্ষেত্রগুলো নিয়েও আলোচনা করেছেন। দুই দেশের জনগণের কল্যাণে পারস্পরিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়টিও তারা উল্লেখ করেন। এ সময় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চাল, গম, চিনি, পেঁয়াজ, আদা ও রসুনের মতো খাদ্যপণ্যের অনুমানযোগ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার অনুরোধ জানানো হয়। কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্টের (সেপা) আলোচনার দ্রুত সমাধান দুই দেশের বাণিজ্য খাতে চলমান সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলোকে আরো এগিয়ে নেবে। 

ভারতের নয়াদিল্লিতে হোটেল তাজ প্যালেসে গতকাল বিকালে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। দুই দেশের মধ্যে কানেক্টিভিটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর যাতে ভারতের উত্তর-পূর্ব বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলের জন্য ব্যবহার করা যায়, সে বিষয়ে তাদের আগ্রহ ও আমাদের অগ্রগতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।’ 

সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে রাজনৈতিকভাবে দুই দেশের মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে জানিয়ে ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘এর পরও যে ঘটনাগুলো ঘটছে, সেগুলোও যাতে একদম কমিয়ে আনা যায়, সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।’ 

এছাড়া বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৫৪টি অভিন্ন নদীর নাব্য রক্ষাসহ সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা, তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনা, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলা, বন্যা দুর্যোগ মোকাবেলা ও পরিবেশ সংরক্ষণ নিয়েও গুরুত্ব সহকারে আলোচনা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাদের সঙ্গে বিদ্যুৎ খাতে সহযোগিতার প্রসার, ভারতের মধ্য দিয়ে নেপাল ও ভুটান থেকে জলবিদ্যুৎ আমদানিতে সহায়তা এবং ভারত যে ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের নতুন সঞ্চালন লাইন করছে সেটি থেকে কীভাবে সহায়তা পাওয়া যেতে পারে সে বিষয়ে আলোকপাত করেন।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘ব্রিকস সদস্য বা অংশীদার যেকোনো পদে আমরা ভারতের সমর্থন চেয়েছি এবং তারা ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। পাশাপাশি বিমসটেক, ইন্ডিয়ান ওশান রিম অ্যাসোসিয়েশনসহ বহুপক্ষীয় ফোরামগুলোয় অবস্থান শক্তিশালী করা, অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়েও আলোচনা ছিল ইতিবাচক।’ 

‘এ সময় পেঁয়াজ, তেল, গম, চিনিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানিতে বাংলাদেশের জন্য নির্দিষ্ট কোটা সংরক্ষণ ও আমদানি যাতে বন্ধ না হয়, সে বিষয়েও আমরা আলোচনা করেছি’, বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫