চলতি বছরের তাপপ্রবাহের প্রভাব নিয়ে সমীক্ষা

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৪ জেলায় ক্ষতি প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা

প্রকাশ: জুন ২৩, ২০২৪

শুভব্রত আমান I কুষ্টিয়া

চলতি বছর দেশের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে টানা ২৭ দিনের রেকর্ড তাপপ্রবাহ। এবার তাপপ্রবাহের প্রভাবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চার জেলা চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ ও কুষ্টিয়ায় প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদসহ বেশ কয়েকটি খাতে এ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বেসরকারি সংস্থা ওয়েভ ফাউন্ডেশনের সমীক্ষা বলছে, এ চার জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চুয়াডাঙ্গা। মোট ক্ষতির প্রায় অর্ধেকই এ জেলায়।

চার জেলার কৃষি, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ, পরিবেশ ও জীবিকার ওপর তাপপ্রবাহের প্রভাব মূল্যায়ন করতে এ সমীক্ষা চালায় ওয়েভ ফাউন্ডেশন। সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্চে এ চার জেলায় প্রায় ১১ দিন তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে রেকর্ড হয়। এর মধ্যে বৃষ্টিপাত একেবারেই ছিল না। 

প্রতিবেদনে বলা হয়, এ চার জেলায় মোট ১ লাখ ৮০ হাজার ৮১১ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ হয়। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ লাখ ৮৪ হাজার ৮৬৬ টন। ধানের দানা পুষ্ট না হওয়া ও সময়ের আগেই পেকে যাওয়ায় চলতি মৌসুমে বোরোর ফলন বিঘাপ্রতি দুই মণ কম হয়েছে। ফলে ধান উৎপাদন ১ লাখ ৮ হাজার ৫২ টন কমে গেছে। এর মূল্য ২৭০ কোটি টাকার বেশি। অন্যদিকে তাপপ্রবাহ ও মৌসুমজুড়ে বৃষ্টি না হওয়ায় বোরো ধানে বাড়তি সেচ দিতে হয়েছে। এতে বিঘাপ্রতি গড়ে ১ হাজার ৫০০ টাকা হারে ব্যয় বেড়েছে। ফলে ধান চাষ বাবদ অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে অন্তত ৩৫০ কোটি টাকা। 

চার জেলার আরেক অর্থকরী ফসল ভুট্টার মোচায় দানা সংখ্যা কম ও অপুষ্ট হওয়ায় উৎপাদন কম হয়েছে। ভুট্টার ফলন বিঘাপ্রতি গড়ে ছয় মণ কম হয়েছে। চলতি মৌসুমে চার জেলায় মোট ৯৯ হাজার ৪৪ হেক্টর জমিতে ১৩ লাখ ৩১ হাজার ৭৪৫ টন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল। উৎপাদন হয়েছে ১১ লাখ ৫৪ হাজার ১৭৯ টন। উৎপাদন কমেছে ১ লাখ ৭৭ হাজার ৫৬৬ টন। এর দাম প্রায় ৪৪৪ কোটি টাকা।

সমীক্ষায় উঠে এসেছে, চার জেলায় ৮ হাজার ২৫৫ বিঘা জমিতে ৩৩ হাজার ২০ টন ড্রাগন ফল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু উৎপাদন ৪ হাজার ১২৭ টন কম হতে পারে। আর্থিক ক্ষতি হবে প্রায় ৮২ কোটি টাকা। এ বছর এসব জেলায় লিচু উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৫ হাজার ৪৮০ টন। স্থানীয় কৃষকদের তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৩০ ভাগ লিচু নষ্ট হয়েছে। সে হিসেবে এ বছর লিচু উৎপাদন কমবে প্রায় ৪ হাজার ৬৪৪ টন। একইভাবে এসব জেলায় আমে আয় কমবে প্রায় ৪০ শতাংশ, মাল্টা ও কমলায় কমবে ৫০ শতাংশ। সমীক্ষা প্রতিবেদন বলছে, চার জেলায় এপ্রিল ও মে মাসে ডিম উৎপাদন কমেছে গড়ে প্রায় সাড়ে ২২ শতাংশ। ক্ষতির পরিমাণ ৩৭ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।

এক মাসের বেশি সময় ধরে এ সমীক্ষা চালানো হয়। এতে চার জেলার কৃষি দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী, বেসরকারি সংস্থার কর্মী, সাংবাদিক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, দিনমজুর, রিকশাচালক, পরিবহন শ্রমিক, কৃষি শ্রমিক, মৎস্যজীবী, ছোট ব্যবসায়ী ও ছোট চাকরিজীবী শ্রেণী অংশ নেন। সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলনে সমীক্ষার নানা তথ্য তুলে ধরেন সংস্থাটির মুখ্য গবেষক ড. হাসান আলী।

গত কয়েক দিন বণিক বার্তার পক্ষ থেকে এ চার জেলার কৃষক, কৃষি কর্মকর্তা ও সাধারণ ব্যবসায়ীদের মতামত নেয়া হয়। এর মধ্যে চুয়াডাঙ্গা শহরের বস্তাপট্টির শ্রমিক রুহুল কুদ্দুস সালেহ জানান, তাপপ্রবাহের সময় তিনি দিনে ৫ ঘণ্টার বেশি কাজ করতে পারেননি। এতে গড়ে প্রতিদিন তার আয় কমেছে ২৭৭ টাকা। এ চার জেলার কর্মক্ষম মানুষ ২৬ লাখ ২০ হাজার ৩৮০ জন। সেই হিসাবে চার জেলায় প্রতিদিন আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৬১ কোটি টাকা।

দামুড়হুদা উপজেলার কৃষক আলমগীর হোসেন ভূঁইয়া জানান, এ বছর তিনি সাত বিঘা জমিতে বোরো ধান আবাদ করেছিলেন। তাপপ্রবাহের কারণে সেচ ও ওষুধ বাবদ বিঘাপ্রতি বাড়তি ৬০০ টাকা খরচ হয়েছে।

কুষ্টিয়া সদরের আলোকদিয়া গ্রামের কৃষক মতিউর রহমান লাল্টু জানান, তাপপ্রবাহের কারণে তাদের গ্রীষ্মকালীন সবজি ও আমের ফলন কমে গেছে। পাট চাষেও একই অবস্থা।

মেহেরপুরের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রাকিবা ইয়াসমিন জানান, এ সময়ে বেচাকেনা খুবই কম ছিল। সাধারণ মানুষ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও কম কিনেছে। চুয়াডাঙ্গার কৃষক জোটের সভাপতি রবিউল হক বলেন, ‘গ্রীষ্ম মৌসুমের চাষাবাদ ঝুঁকির মুখে পড়ছে। একদিকে কৃষকের খরচ বাড়ছে, অন্যদিকে ফলন কমে আসছে।’

চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিভাষ চন্দ্র সাহা জানান, তাপপ্রবাহে চুয়াডাঙ্গার কৃষিতে বাড়তি সেচ খরচ লেগেছে। তবে তিনি উৎপাদন ঘাটতির আশঙ্কা করছেন না।

কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সুফি মোহা. রফিকুজ্জামান জানান, কুষ্টিয়ায় বোরো ধানের ৪৫৬ হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাটে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪ হাজার ৫০০ হেক্টর।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫