সমুদ্রতীরবর্তী এলাকা হওয়ায় চট্টগ্রাম একসময় মহিষের বিচরণভূমি হিসেবে পরিচিত ছিল। নতুন করে জেগে ওঠা চর ছিল মহিষের বড় চারণভূমি। তবে ক্রমে চর দখল, কৃষি আবাদ বেড়ে যাওয়া এবং উপকূলে অবকাঠামো নির্মাণের কারণে কমে আসছে মহিষের চারণভূমি। এক দশক আগে চট্টগ্রামে যেখানে লক্ষাধিকের বেশি মহিষ ছিল, এখন সেটা নেমে এসেছে প্রায় ৪৭ হাজারে। গত তিন বছরে সংখ্যাটি কমেছে প্রায় ২০-২৫ হাজার।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, মহিষের চারণভূমি হলো উপকূলীয় বা চর এলাকা। কিন্তু সেখানে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ, বাগান কেটে ফেলা কিংবা খাদ্য সংকটের কারণে মহিষ লালন-পালন সীমিত হয়ে আসছে, যার বড় প্রভাব পড়ছে মাংস বা দুধ উৎপাদনে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, মহিষ সাধারণত খোলামেলাভাবে চলতে পছন্দ করে। সমুদ্রতীরবর্তী পানিতে মহিষের বিচরণ বেশি। দিন দিন উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া, প্রাকৃতিক খাদ্যের সংকট, বাজারে কেনা খাদ্যের দাম বেশি হওয়ায় মানুষ আর আগের মতো মহিষ পালন করছে না। তাছাড়া মহিষের প্রতিদিন যে পরিমাণ খাবারের প্রয়োজন সেটা কিনে খাওয়ানো প্রান্তিক খামারিদের পক্ষে সম্ভব নয়। এ কারণে মহিষ পালনে আগ্রহ হারাচ্ছেন খামারিরা।
চট্টগ্রাম প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছর চট্টগ্রামে মহিষের সংখ্যা ৪৬ হাজার ৪৭৪টি। ২০২৩ সালে সংখ্যাটি ছিল ৭১ হাজার ৩৩টি এবং ২০২২ সালে লালন-পালন করা হয়েছিল ৬৬ হাজার ২৩৭টি। চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ, বাঁশখালী, আনোয়ারা, সীতাকুণ্ড, মিরসরাই ও সাতকানিয়ায় এক দশক আগেও মহিষ লালন-পালন করা হতো লক্ষাধিকের কাছাকাছি।
চট্টগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়, চট্টগ্রাম জেলার উপকূলীয় এলাকায় চরের পরিমাণ প্রায় ১৩ হাজার ৮০ হেক্টর। এসব চরের মধ্যে আবাদি জমির পরিমাণ প্রায় ৮ হাজার ৩০০ হেক্টর। এর মধ্যে মিরসরাইয়ে দুই হাজার হেক্টর চরের মধ্যে কৃষি আবাদ হচ্ছে দেড় হাজার হেক্টরে। এছাড়া সীতাকুণ্ডে ২৭০ হেক্টর চরের পুরোটাই কৃষি আবাদ হচ্ছে। বোয়ালখালীর ৪৮০ হেক্টরের মধ্যে ২৯০ হেক্টর, সাতকানিয়ায় ১৩০ হেক্টরের মধ্যে ১২০, বাঁশখালীতে ২০০ হেক্টরের মধ্যে ১২০ এবং সন্দ্বীপে ১০ হাজার হেক্টরের মধ্যে ৬ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রাম জেলায় মোট মহিষ আছে ৪৬ হাজার ৪৭৪টি। এর মধ্যে ১৫ হাজার ৪৫টি মহিষ রয়েছে সন্দ্বীপে। অর্থাৎ চট্টগ্রামের তিন ভাগের এক ভাগ মহিষ লালন পালন হয় সন্দ্বীপে।
সন্দ্বীপের উড়িরচরের বাসিন্দা মো. নূরনবী রবিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘উড়িরচর মহিষ পালনের জন্য বিখ্যাত। মহিষের ব্যাপারীরাও ছিলেন উড়িরচরের বাসিন্দা। সমুদ্রতীরবর্তী হওয়ায় বাতানরা (যারা মহিষ নিয়ে চরাঞ্চলে ঘুরে বেড়ান তাদের স্থানীয় ভাষায় বাতান বলা হয়) মহিষের পাল চরে ছেড়ে দিত। এখানে লোনা পানির গাছের বাগান থাকায় মহিষের বিচরণ বেশি ছিল। খাবারের কোনো সংকট ছিল না। দুধ কিংবা মাংস উৎপাদনের জন্য এখানকার মহিষের সুনাম ছিল অনেক। কিন্তু এখন সেই বাগান কেটে ফেলা, বসতি গড়ে ওঠা, নতুন স্থাপনা নির্মাণের কারণে মহিষের বিচরণভূমি কমে গেছে। যারা ব্যক্তিগত উদ্যোগে মহিষ পালন করতেন, তারাও সেটা বিক্রি করে দোকান দিয়েছে।’
চট্টগ্রাম জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মহিষের মাংস ও দুধের চাহিদা রয়েছে বাজারে। চট্টগ্রামসহ সারা দেশে গরু উৎপাদন, মাংসের চাহিদা, দুধ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য যত উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে সেখানে মহিষ কিছুটা পিছিয়ে। আগে চরাঞ্চলে ছেড়ে দিয়ে মহিষ লালন-পালন করা হতো। কিন্তু এখন চর এলাকায় কৃষি উৎপাদন বেড়ে যাওয়া, স্থাপনা নির্মাণের কারণে আগের মতো উপকূলীয় এলাকায় মহিষের বিচরণ দেখা যায় না। এখন পশুপালন খামারভিত্তিক হয়ে যাওয়ায় মহিষের উৎপাদন কিছুটা কমেছে। খাদ্যের দাম বাড়ার কারণে সংকট বেড়েছে আরো বেশি। তবে সার্বিকভাবে মহিষের সংখ্যা কমে আসছে।’
প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা বলছেন, মহিষের বিচরণ চট্টগ্রাম উপকূলে হলেও ফেনী, নোয়াখালী, ভোলাসহ বিভিন্ন উপকূলবর্তী এলাকায়ও প্রচুর মহিষ রয়েছে। তবে খাবার সংকট প্রকট হওয়া, খাবারের দাম বাড়ার কারণে মহিষের মাংস ও দুধ উৎপাদনে বড় প্রভাব পড়েছে। মূলত মহিষ খামারে বেঁধে রেখে লালন-পালন সম্ভব হয় না। তাদের বিচরণের জন্য যে পরিমাণ জায়গা দরকার তার সংকট বাড়ছে। এক কেজি মহিষের দুধে যে পুষ্টিগুণ সেটা দুই কেজি গরুর দুধে পাওয়া যায়। তাছাড়া মহিষের মাংসে কোলেস্টেরল কম থাকায় বাজারে বেশ চাহিদা রয়েছে।