সময়ের ভাবনা

যোগাযোগ খাতে এত মাস্টারপ্ল্যান, অগ্রগতি সন্তোষজনক কি

প্রকাশ: জুন ২২, ২০২৪

পাপলু রহমান

পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে টানা মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। দেশের দুই লেনের সড়ক চার লেনে বা তারও বেশি, ফ্লাইওভার থেকে এক্সপ্রেসওয়ে, নতুন নতুন সেতু ও বন্দর স্থাপিত হচ্ছে। গড়ে উঠছে নিবিড় ও সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা। আগামীতে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো বেগবান করতে এবারো প্রস্তাবিত বাজেটে সবচেয়ে বেশি খরচ করবে সরকার। মোট উন্নয়ন ব্যয়ের ২৫ দশমিক ১ শতাংশ যোগাযোগ খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। নির্মাণাধীন একাধিক মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি), চার লেনের মহাসড়কে উন্নীতকরণ, নতুন রেলপথ নির্মাণ, যমুনা নদীর ওপর রেলসেতু নির্মাণ, নৌপথ ও নৌবন্দর এবং বিমানবন্দর উন্নয়নসহ নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে এ টাকায়।

সারা দেশে আগামী ৩০ বছরে ৪৭টি সেতু, তিনটি টানেল, ২৭টি এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণসহ ৭৭টি মেগা প্রকল্প শুরুর মাস্টারপ্ল্যান রয়েছে সেতু বিভাগের। এর অংশ হিসেবে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ গড়ার লক্ষ্যে এবারের বাজেট পরিকল্পনায় ১২ এক্সপ্রেসওয়ে, ১০ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। উন্নয়ন বাজেটের অংশ হিসেবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য পরিচালন ব্যয়সহ পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ৮২ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

বর্তমানে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আশুলিয়া হয়ে সাভার ইপিজেড পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মিত হচ্ছে। এটি দেশের দ্বিতীয় এক্সপ্রেসওয়ে। এর নির্মাণকাজ এগিয়ে চলছে। দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে এটি। ফলে ঢাকা ইপিজেড থেকে চিটাগং রোডের কুতুবখালী পর্যন্ত ৪৪ কিলোমিটার পথ নির্বিঘ্নে চলবে যানবাহন। এই দুই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে দেশের চার প্রধান মহাসড়ক-ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-উত্তরবঙ্গ সংযুক্ত হবে।

ঢাকার পূর্ব-পশ্চিমে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ বাড়াতে চায় সরকার। তারই অংশ হিসেবে আরো একটি এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বালিয়াপুর থেকে নিমতলী-কেরানীগঞ্জ-ফতুল্লা-বন্দর হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের লাঙ্গলবন্দ পর্যন্ত ৩৯ দশমিক ২৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা ইস্ট-ওয়েস্ট এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মিত হবে। প্রস্তাবিত বাজেটে এ এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে পূর্ব, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর যানবাহনগুলো ঢাকা শহরে প্রবেশ না করেই এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে নিজ নিজ জেলায় যাওয়ার সুযোগ পাবে।  

আবার সহজ বাধাহীন যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ঢাকা-জয়দেবপুর-দেবগ্রাম-ভুলতা-মদনপুর পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে নির্মিত হচ্ছে। বাধাহীন এই সড়কটি হচ্ছে প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত। নির্দিষ্ট জায়গা দিয়েই এ মহাসড়কে প্রবেশ ও বের হতে হবে। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের আওতায় এ প্রকল্পটি দৃশ্যমান হয়েছে। বেশির ভাগ অংশেই চার লেনের মহাসড়কের কাজ প্রায় শেষ।

রাজধানী ঢাকাকে যানজটমুক্ত করাসহ ঢাকা প্রবেশ না করেই দূরপাল্লার যানবাহনগুলো যাতে করে চলাচল করতে পারে সেজন্য ঢাকা ইনার এলিভেটেড সার্কুলার রোড নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। সেতু বিভাগ বলছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে ঢাকা ইনার এলিভেটেড সার্কুলার রোডের নির্মাণকাজ শেষ করার পরিকল্পনা প্রণয়ন রয়েছে। বর্তমানে প্রকল্পটির জন্য একটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা চলছে। 

অন্যদিকে হাওরাঞ্চলের যোগাযোগ সহজ ও পরিবেশের বিষয়টি বিবেচনা করে সুনামগঞ্জ-নেত্রকোনার হাওরে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের প্রস্তাব করেছে সংস্থাটি। সে লক্ষ্য পূরণে সেতু কর্তৃপক্ষ সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনায় ২২ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে সম্ভাব্যতা সমীক্ষার কাজ এগিয়ে চলছে। এ প্রকল্পটি সিলেট থেকে রংপুরের দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার কমবে। 

উন্নয়ন বাজেটে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য পরিচালন ব্যয়সহ পরিবহন ও যোগাযোগ খাতের জন্য ৮২ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। এর মধ্যে এককভাবে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পেয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক পরিবহন এবং মহাসড়ক বিভাগ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত উন্নয়ন বাজেটে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের জন্য ৩২ হাজার ৪২ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। 

দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের জন্য। এ মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়নাধীন পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের কাজ শেষের পথে। বিদ্যমান বঙ্গবন্ধু সেতুর সমান্তরালে নতুন রেলসেতু নির্মাণসহ দেশের রেলওয়ে নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। আগামী অর্থবছর রেলপথ মন্ত্রণালয়ের চলমান প্রকল্পগুলো এগিয়ে নেয়ার জন্য ১৩ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। 

তৃতীয় সর্বোচ্চ ১০ হাজার ৩৭৩ কোটি বরাদ্দ পেয়েছে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়। চতুর্থ সর্বোচ্চ বরাদ্দ পেয়েছে সেতু বিভাগ। আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এ বিভাগের জন্য ৭ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা ও বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের জন্য ৫ হাজার ৬৩২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। অন্যদিকে প্রস্তাবিত বাজেটে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের জন্য ১ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। 

গত কয়েক বছরে দেশজুড়ে নানা যোগাযোগ অবকাঠামো দৃশ্যমান হয়েছে। সরকারি তথ্যানুসারে, ১৫ বছরে দেশের বিভিন্ন মহাসড়কে ১ হাজার ৪৩৯টি সেতু নির্মাণ-পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। ২২ হাজার ৪৭৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মহাসড়ক তৈরি করা হয়েছে। বিভিন্ন সমাপ্ত ও চলমান প্রকল্পের আওতায় ৮৫১ দশমিক ৬২ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক চার লেন ও তার বেশি লেনে উন্নীত করা হয়েছে। 

গত ১৫ বছরে দেশে ৯৪৭ দশমিক ৯৯ কিলোমিটার নতুন রেললাইন নির্মাণ, ৩৪০ কিলোমিটার মিটারগেজ রেললাইনকে ডুয়ালগেজে রূপান্তর, ১৪৮টি নতুন স্টেশন বিল্ডিং নির্মাণ ও নতুন ১৪৪টি ট্রেন চালু করা হয়েছে। দেশের তৃতীয় সমুদ্রবন্দর পায়রায় সীমিত আকারে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সড়ক ও রেলপথের ওপর চাপ কমানো এবং নৌপথে নিরাপদ ও নির্বিঘ্নে যাত্রী এবং পণ্য পরিবহনের উদ্দেশ্যে গত ১৫ বছরে অভ্যন্তরীণ নৌপথে ২৬টি নদীবন্দর ঘোষণা করা হয়েছে। মোট ৪৭২টি নানা আকারের পন্টুন লঞ্চঘাট ও নদীবন্দরে স্থাপন কার্যক্রম শেষ করা হয়েছে। এছাড়া মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের কার্যক্রম চলছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, কক্সবাজার বিমানবন্দর ও ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিদ্যমান রানওয়ে এবং ট্যাক্সিওয়ে উন্নত ও দীর্ঘ করা হয়েছে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের উদ্বোধন, দেশের এভিয়েশন খাতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এছাড়া উত্তরা-কমলাপুর রুটে মেট্রোরেল চলাচল ঢাকার জনগণের মধ্যে বিপুল সাড়া জাগিয়েছে। বাংলাদেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা চালু হয়েছে। মাটির তলদেশ দিয়ে ঢাকা মেট্রোরেলের কাজও শুরু হয়েছে। ঢাকার যানজট নিরসনে বিভিন্ন ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে। দেশের প্রতিটি জেলার সঙ্গে রেল পরিষেবা চালু করা হচ্ছে। নৌপথের উন্নয়নে সরকার নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে সড়ক, রেল, আকাশ ও নৌপথকে সমান গুরুত্ব দিয়ে একটি আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। সাউথ এশিয়া সাব-রিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন (সাসেক) আঞ্চলিক সহযোগিতার আওতায় বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল-ভুটানকে নিয়ে একটি সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজ চলছে।

একটি দেশের উন্নয়ন কেমন হবে তা নির্ভর করে সরকারের পরিকল্পনা ও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ওপর। আবার উন্নয়নে দরকার উন্নত ও নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার গুরুত্ব অনেক। দেশের সড়ক, রেল, বিমান ও নৌপথ যোগাযোগের উন্নয়নে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা স্পষ্ট এবং তা বাস্তবায়নে কাজ করছে। 

গুরুত্বপূর্ণ ও অগ্রাধিকার খাত হিসেবে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে বিস্তৃত, আধুনিকীকরণ ও নিরাপদ করার উদ্যোগকে ইতিবাচকভাবে দেখতে হবে। যোগাযোগ খাতের অবকাঠামো উন্নয়ন দেশের অর্থনীতিতে নিঃসন্দেহে ভূমিকা রাখছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য আগামী দিনে পরিবহন ও যোগাযোগ খাত সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। রফতানির জন্য দরকার হবে যন্ত্রপাতি ও প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানির। প্রয়োজনীয় পণ্য দ্রুত ও সময়মতো সরবরাহ করার জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

দেশের যোগাযোগ খাতের সাফল্যে সরকার যেমন প্রশংসিত হচ্ছে তেমনি সমালোচনাও রয়েছে। এর মূল কারণ বৈদেশিক ঋণ, প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি, বাস্তবায়ন সময়মতো শেষ না হওয়া ও সমন্বয়হীনতা। সরকারকে এসব বিষয়ে কড়া নজরদারি করতে হবে। একই সঙ্গে প্রকল্পের তদারকি, স্বচ্ছতা ও মান নিশ্চিত করতে হবে। তবেই সমন্বিতভাবে সহজ, নিরাপদ, টেকসই ও সাশ্রয়ী যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত হবে। বাংলাদেশ পৌঁছে যাবে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে—উন্নত ও সমৃদ্ধ বিশ্বে।

পাপলু রহমান: সহসম্পাদক, বণিক বার্তা


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫