অর্ধেক দামে চামড়া কিনছেন ব্যবসায়ীরা, দায় চাপাচ্ছেন ট্যানারি মালিকদের ঘাড়ে

প্রকাশ: জুন ১৮, ২০২৪

বণিক বার্তা প্রতিনিধি, নওগাঁ

ঈদের দিন কোরবানি শেষে সরকার নির্ধারিত মূল্যে ১টি ষাঁড় গরুর চামড়া বিক্রি করতে নওগাঁ শহরের মুক্তির মোড়সহ চামড়া গুদাম এলাকায় রিকশা নিয়ে ঘুরছিলেন সদর উপজেলার তিলকপুর ইউনিয়নের তিলকপুর গ্রামের সাদ আহমেদ। তবে প্রায় এক ঘণ্টা ঘুরেও সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া বিক্রি করতে পারেননি তিনি। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে মাত্র ৪০০ টাকায় স্থানীয় চামড়া ব্যবসায়ীর কাছে সেটি বিক্রি করেন ওই যুবক।

সাদ আহমেদ আক্ষেপ করে বলেন, ৯১ হাজার টাকা দিয়ে একটি ষাঁড় গরু ৫ ভাগে কিনে কোরবানি দিয়েছি। এই চামড়া মাত্র ৪০০ টাকায় বিক্রি করতে হলো। চামড়ার টাকা গরীব মিসকিনদের হক। ওরা (চামড়া ব্যবসায়ী) সিন্ডিকেট করে কম দামে চামড়া কিনে গরীব-মিসকিনদের হক মেরে খাচ্ছে।

শুধু সাদ আহমেদের থেকেই যে চামড়া কম দামে কেনা হয়েছে। বিষয়টি এমন নয়। নওগাঁয় কম দামে চামড়া কেনার এ চিত্র শহরজুড়ে ঈদের দিন দুপুর ১২টার পর থেকেই দেখা গেছে। ট্যানারি মালিকদের কাছে বকেয়া টাকা পাওনা থাকায় জেলার বেশিরভাগ ব্যবসায়ী এবার সরাসরি চামড়া কিনছেন না। মূলত এই সুযোগকেই কাজে লাগিয়েছেন শহরের গুটি কয়েক চামড়া ব্যবসায়ী। তাদের সিন্ডিকেটের কারণে কোরবানি দাতারা কম দামে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেকে এসব ঝামেলা এড়াতে মাদ্রাসা ও এতিমখানায় চামড়া দান করেছেন।

শহরের হাট নওগাঁ মহল্লার বাসিন্দা এমরুল হাসান শাহীন বলেন, ১ লাখ ১৩ হাজার টাকায় ৫ ভাগে মাঝারি আকারের একটি ষাঁড় গরু কিনে আমরা কোরবানি দিয়েছি। কুরবানি শেষে মাংস কাটা-বাছাইয়ের পর দুপুর ১টার দিকে পার্শ্ববর্তী চামড়া গুদাম এলাকার কিছু ব্যবসায়ী এসে চামড়ার দাম হেঁকেছেন মাত্র সাড়ে ৫০০ টাকা। সরকার নির্ধারিত দামে কোনক্রমেই তারা চামড়া কিনতে চান না। তাই তাদের চামড়া না দিয়ে মাদ্রাসায় চামড়া দান করেছি।

শহরের পার নওগাঁ মহল্লার থেকে পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় চামড়া বিক্রি করতে আসা মৌসুমী ব্যবসায়ী রাজু আহম্মেদ বলেন, লাভের আশায় সকাল থেকে বিভিন্ন মহল্লা ঘুরে ২৫টি গরু এবং ১২টি ছাগলের চামড়া কিনেছি। সেই চামড়া কিনে বিক্রি করতে এসে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। ৩ ঘণ্টা যাবত ব্যবসায়ীদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। কেউই ভালো দাম দিতে চাইছে না। সকালেও ব্যবসায়ীরা বলেছিলো ভালো দাম দেবে। অথচ শেষ মুহূর্তে এসে তারা (ব্যবসায়ীরা) কথা রাখল না। পুরোটাই একটি সিন্ডিকেটের হাতে। এখন হয়তো লোকসান দিয়েই চামড়াগুলো বিক্রি করতে হবে।

চামড়া গুদাম এলাকার স্থানীয় চামড়া ব্যবসায়ী সাহেব আলী বণিক বার্তাকে বলেন, এ বছর মানভেদে প্রতি পিস গরুর চামড়া ৩০০ টাকা থেকে সর্ব্বোচ্চ ১ হাজার টাকা দাম দিয়ে কেনা হচ্ছে। ছাগল ও ভেড়ার চামড়া কেউ আনলেও সেটা নেয়া হচ্ছে না। কারণ এসব চামড়ার আড়ত বা ট্যানারি মালিকদের কারোরই চাহিদা নেই। এই চামড়া কিনলে বিক্রি করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই ওইসব চামড়া যাতে যত্রতত্র ফেলে দিয়ে নষ্ট করা না হয় সেদিকটি মাথায় রেখে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নামমাত্র দামে ১০ টাকা পিস হিসেবে নেয়া হচ্ছে। অনেকে ছাগলের চামড়া ফ্রি দিয়ে যাচ্ছেন। তবে ভালো মানের ছাগলের চামড়া সর্ব্বোচ্চ ৫০ টাকায় কেনা হচ্ছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ বছর ঢাকায় প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। ঢাকার বাইরে লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। গত বছর এ দাম ছিল ৪৫ থেকে ৪৮ টাকার মধ্যেই। সেই হিসেবে এবছর ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি পিস গরুর চামড়ার সর্বনিম্ন দাম হবে ১ হাজার ২০০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে সর্বনিম্ন দাম হবে ১ হাজার টাকা। এছাড়াও এবছর সারাদেশে প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত খাসির চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ থেকে ২৫ টাকা। প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত বকরির চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ থেকে ২০ টাকা। গত বছর প্রতি বর্গফুট খাসির চামড়ার দাম ছিল ১৮ থেকে ২০ টাকা এবং বকরির ১২ থেকে ১৪ টাকা।

অন্যদিকে, বর্গফুট হিসেবে চামড়া কেনার কারণে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হয় জানিয়ে এ বছর পিস হিসেবে চামড়া কেনার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ)। এবার প্রতি পিস গরুর চামড়া ঢাকার ভেতরে ১ হাজার টাকা এবং ঢাকার বাহিরে ১ হাজার ২০০ টাকা দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সংগঠনটি। চামড়া লবণহীন হলে তা সাড়ে ৮০০ টাকা থেকে ৯০০ টাকা দাম পড়বে বলেও জানিয়েছে বিটিএ।

এরপরেও ব্যবসায়ীরা কেন কম দামে চামড়া কিনছেন জানতে চাইলে নওগাঁ জেলা চামড়া ব্যবসায়ী গ্রুপের সাবেক সভাপতি শেখ আজাদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ট্যানারি মালিকরা সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া কেনার কথা মুখে বললেও প্রকৃতপক্ষে আমরা লবণজাত চামড়া বিক্রি করতে গেলে বিভিন্নরকম ফন্দি আঁটে। চামড়ার নায্য দাম কখনোই আমাদের দেয়া হয় না। তাদের (ট্যানারি মালিক) সিন্ডিকেটের কারণে ঈদে চামড়া কেনার পর আমাদের বিনিয়োগকৃত টাকা ওঠানোই কঠিন হয়ে পড়ে। তাই ইচ্ছে থাকলেও সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া কেনা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। গরীব-মিসকিনদের হক আমরা নয়, ট্যানারি মালিকরা মেরে খাচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, দেশীয় চামড়া শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে ঋণ করে হলেও আমরা চামড়া কিনছি। ট্যানারিদের কাছে আমাদের পাওনা কোটি কোটি টাকা আটকে আছে। কাঁচা চামড়া কেনার নামে সরকারের কাছে থেকে প্রতি বছর যে টাকাগুলো ট্যানারি মালিকরা নেয় তার ছিটেফোঁটাও আমরা পাই না। পাওনা টাকা চাইতে গেলে সামান্য কিছু টাকা দিয়ে ট্যানারি মালিকরা আমাদের অপমান করে তাড়িয়ে দেন। তাদের আবারো চামড়া দিলে অর্ধেকেরও বেশি টাকা আটকে রাখে। এইভাবে হেনস্তা হতে হতে চামড়া ব্যবসায়ীরা বর্তমানে পুঁজি সংকটে পড়েছে। এই সংকট না কাটলে চামড়ার নায্য মূল্য কখনোই দেয়া সম্ভব হবে না।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫