অভিমত

সম্ভাবনাময় ট্যানারি শিল্প তবু সস্তা কেন কোরবানির পশুর চামড়া

প্রকাশ: জুন ১৫, ২০২৪

তাসনীম ইসলাম দ্যুতি, ড. মূহঃ আব্দুর রহীম খান

কোরবানির ঈদ আসন্ন। নানা জায়গায় বসবে গরু-ছাগলের হাট। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মো. আব্দুর রহমানের তথ্য মোতাবেক এবার ১ কোটি ২৯ লাখ ৮০ হাজার ৩৬৭টি গবাদি পশু কোরবানির জন্য প্রস্তুত রয়েছে। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় ৪ লাখ ৪৪ হাজার ৩৪টি পশু এ বছর বেশি উৎপাদিত হয়েছে। পশু রফতানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশকে গবাদি পশু উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে বাধ্য করেছে। আর এক্ষেত্রে সাহায্য করেছে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদত্ত ঋণ। 

চামড়া শিল্পকেন্দ্রিক বিভিন্ন গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য ও উপাত্ত থেকে জানা যায়, ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী চামড়াজাত পণ্যের বাজার ছিল ৪২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০২৩ থেকে ২০৩২ সাল পর্যন্ত ৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ চক্রবৃদ্ধি হারে প্রসারিত হয়ে ২০৩২ সালের মধ্যে ৭৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। এ মুহূর্তে বিশ্ববাজারে চামড়া শিল্পের ৩০ শতাংশ দখল করে আছে চীন। এরপর ইতালি, ফ্রান্স, ভিয়েতনাম ও ভারতের অবস্থান। বিশ্বের মোট গবাদি পশুর ১ দশমিক ৩ থেকে ১ দশমিক ৮ শতাংশের আবাসস্থল বাংলাদেশ হওয়া সত্ত্বেও বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের হিস্যা মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। এ করুণ ও ভগ্নদশার পেছনের কারণগুলোকে সক্রিয় বিবেচনায় আনতে হবে। কেননা মুক্তবাজার অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতার সক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে এমন ধরনের পণ্য আমাদের হাতে বেশি নেই। সেক্ষেত্রে চামড়া শিল্প হতে পারে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাত। শুধু চামড়াই নয়, এসব পশুর হাড়/অস্থি এগুলো রূপান্তরের মাধ্যমে উপজাত (বাই-প্রডাক্ট) হিসেবে রফতানি বাজার দখল করে নিতে পারে। এত সম্ভাবনা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অগ্রগতি পুরোটাই নেতিবাচক। ২০১৫ সালে এর বাজার ছিল ২৯৯ মিলিয়ন ডলার, ২০২২ সালে তা হ্রাস পায় ১৫৪ মিলিয়ন ডলারে। হ্রাসের এ ধারা অব্যাহত আছে। 

সামর্থ্যবান মুসলিমরা কোরবানি দিতে সমর্থ হলেও বিপাকে পড়েন পশুর চামড়া নিয়ে। সাধারণত মসজিদ বা মাদ্রাসায় এ চামড়া দান করে থাকেন কিংবা কোরবানির স্থলে আগত পাইকারদের কাছে তা বিক্রি করেন। পাঁচ বছর আগেও যেখানে একটি পূর্ণবয়স্ক গরুর চামড়া প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি করা যেত সেখানে গত কোরবানির ঈদে একটি পূর্ণবয়স্ক গরুর চামড়ার বিনিময় মূল্য হিসেবে ৩০০ টাকার বেশি পাওয়া যায়নি। অথচ এক দশকে চামড়ার জুতার দাম উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে! এবার ঢাকায় সরকার কর্তৃক প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার নির্ধারিত বিনিময় মূল্য ধরা হয়েছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, ২০১৩ সালে যা ছিল ৮৫ থেকে ৯০ টাকা। উল্লেখ্য একটি পূর্ণ বয়স্ক গরু জবাইয়ের পর এর চামড়ার আকার হয়ে থাকে ৫০-৫৫ বর্গফুট। চামড়ার এ অস্বাভাবিক মূল্য হ্রাসের পেছনে চামড়া শিল্পসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার প্রবণতা ছাড়াও দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বেশকিছু কারণ রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অদক্ষ এবং অপেশাদার কসাই দিয়ে অবৈজ্ঞানিক ও অস্বাস্থ্যকর উপায়ে কোরবানির পশুর চামড়া ছাড়ানো হয়। এতে করে উচ্চ মূল্যের ভালো জাতের চামড়াও মূল্যহীন হয়ে যায়। নির্দিষ্ট সময়ে চামড়া সংরক্ষণে আমাদের ব্যর্থতা রয়েছে। কোটি টাকা ব্যয়ে পুরনো ঢাকায় একটি কসাইখানা প্রতিষ্ঠা করা হলেও গত ১০ বছরেও তা চালু করা সম্ভব হয়নি। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সনদ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) পূর্বশর্ত পূরণ না হলে চামড়াজাত পণ্য রফতানি সম্ভব নয়। 

এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষক দল, খামার মালিক সমিতি, বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিবন্ধকারদের আলোচনা হয়। প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার সংক্ষিপ্তসার হলো: বর্তমানে গবাদি পশু মোটাতাজা করতে গিয়ে খামারিরা ইউরিয়া সারসহ বিজাতীয় যেসব খাদ্য গবাদি পশুকে খাওয়ান তার পরিণতিতে এসব পশুর চামড়া কখনই এলডব্লিউজি কর্তৃক নির্ধারিত মানের হয় না। এ ধরনের চামড়া সংরক্ষণ করা যেমন কঠিন, তেমনি প্রক্রিয়ার পরও মূল্যবৃদ্ধি ঘটে না। হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সাভারে স্থানান্তরের পেছনে যে উদ্দেশ্য ছিল তা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। চামড়া শিল্পনগরী স্থানান্তরের সময় যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তা ট্যানারি ব্যবসায়ীরা এখনো পুষিয়ে উঠতে পারেননি। কোরবানীকৃত গবাদি পশুর চামড়া কোরবানিস্থলে আগত পাইকার/দালালদের ছাড়া সরাসরি কখনই ট্যানারি শিল্প মালিকদের কাছে বিক্রি করা যায়নি। ট্যানারি ব্যবসায়ীদের কাছে এসব দালাল এবং পাইকারদের বিপুল পরিমাণ অর্থ পাওনা আছে। এ পরিমাণ অর্থ যদি তাদের হাতে থাকত তাহলে তারা অতীতের ন্যায় কোরবানির চামড়াগুলো কিনতে পারত এবং তা সংগ্রহ করে ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি করতে পারত, যা এখন ঘটছে না। মোদ্দা কথা, ভ্যালু অ্যাড (মূল্য সংযোজন) ও ভ্যালু চেইন সৃষ্টির যে সক্ষমতা চামড়া শিল্পে তৈরি হওয়ার প্রয়োজন ছিল তা বিভিন্ন মহলের অবহেলা ও গাফিলতির কারণে সম্ভব হচ্ছে না। 

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নিত্যনতুন অভিঘাত, ঝুঁকি এবং অস্থিরতা এরই মধ্যে যথেষ্ট অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। এ বাস্তবতায় চামড়া শিল্পকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের নিরিখে ঢেলে সাজাতে হবে। স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে গবাদি পশু লালন-পালন, তাদের চামড়া যথাযথভাবে ছাড়ানো ও প্রক্রিয়াজাতকরণ, ট্যানারি মালিক ও খামারিদের মাঝখানে দালাল-পাইকার তথা মধ্যস্বত্বভোগীদের যে দৌরাত্ম্য রয়েছে তা বিমোচন এবং সর্বোপরি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে অনুপ্রবেশের জন্য উপযুক্ত ভ্যালু চেইন প্রতিষ্ঠা করার কার্যকর পদক্ষেপ শিগগিরই গ্রহণ করতে হবে। ট্যানারি শিল্প হাজারীবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তর যে সমস্যার সমাধান নয়, বরং ধলেশ্বরী নদীর মতো একটি খরস্রোতা প্রবহমান নদীর অকাল মৃত্যু ডেকে আনা, তা এরই মধ্যে প্রমাণিত। এ শিল্পের সঙ্গে যত ধরনের স্টেকহোল্ডার সম্পৃক্ত আছে—সরকার থেকে শুরু করে খামারি, কৃষক তাদের কোনো কর্তৃপক্ষ কি আছে যা সব স্টেকহোল্ডারের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটাবে? অনুভূত চাহিদার ভিত্তিতে উপযুক্ত নীতি, পরিকল্পনা ও কর্মসূচি গৃহীত হলে এবং সার্বক্ষণিক তদারকির মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন হলে আমাদের দেশের চামড়া শিল্পের পুনর্জাগরণ সম্ভব বলে আমাদের বিশ্বাস।

তাসনীম ইসলাম দ্যুতি: গবেষণা সহযোগী

ড. মূহঃ আব্দুর রহীম খান: সহযোগী অধ্যাপক

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (বিআইজিএম)


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫