জনসংখ্যার তুলনায় আমাদের দেশে রক্তদাতার
সংখ্যা খুব বেশি নয়। তার পরও রক্তদান সম্পর্কে মানুষের স্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটা
এমন যে, এক ব্যাগ রক্ত দান করলাম আর সেই রক্ত একজন রোগীর শরীরে সম্পূর্ণটাই প্রবেশ
করানো হলো। তিনি সুস্থ হলেন বা তার প্রয়োজন মিটল। রক্তদাতা তৃপ্ত হলেন একটি ভালো কাজের
আনন্দ নিয়ে। কিন্তু রক্তদানসংশ্লিষ্টরা আধুনিক প্রযুক্তির সুবাদে এক ব্যাগ রক্তকে একাধিক
রোগীর জন্য কাজে লাগাতে পারছেন। এটি আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ রক্তদাতাদের জানার বিষয় নয়।
তাই বলে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগও নেই। বরং বিষয়টি সম্পর্কে রক্তদাতাদের আরো সচেতনতা
জরুরি।
বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর ১৪ জুন বিশ্ব রক্তদাতা
দিবস উদযাপন হয়। এমন সময়ে এক ব্যাগ রক্তে একাধিক রোগীর উপকারের মতো বিষয়টি নিয়ে সচেতনতা
তৈরি হলে সবাই স্বেচ্ছা রক্তদানে বিশেষত ল্যাবে গিয়ে রক্ত দিতে উৎসাহিত হবেন। সাধারণত
প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মানুষের শরীরে ৪ থেকে ৬ লিটার পরিমাণ রক্ত থাকে। প্রতিবার ৪৫০ মিলিলিটার
রক্ত দেয়া হয়। আর এই এক ব্যাগ রক্তই প্রয়োজন মেটাতে পারে একসঙ্গে কয়েকজনের। কেননা রোগভেদে
একেক রোগীর জন্য রক্তের একেক উপাদান লাগে। যেমন অগ্নিদগ্ধ রোগীকে শুধু রক্তরস বা প্লাজমা
দিলে চলে। আবার রক্তস্বল্পতার রোগীকে দিতে হয় রক্তকণা বা প্যাকড্ সেল। থ্যালাসেমিয়া
রোগীদের দিতে হয় লোহিত রক্তকণা বা রেড সেল। এভাবে পুরো ব্যাগ বা হোল ব্লাড সব রোগীর
প্রয়োজন হয় না। নির্দিষ্ট প্রয়োজন মেটাতে নির্দিষ্ট উপাদান হলেই চিকিৎসার কাজটি সম্পন্ন
হয়ে যায়। এখানেই প্রয়োজন সচেতনতার।
রক্তদানের পরপরই রক্ত যদি উন্নত প্রযুক্তির
এসব মেশিনে দিয়ে দেয়া যায় তাহলে রক্ত উপাদানগুলো যথাযথভাবে পৃথক করে ফেলা সম্ভব হয়।
তাই রক্তদাতা যদি সরাসরি ল্যাবে গিয়ে রক্তদান করেন তাহলে এসব নানা উপাদানে ভাগ করা
সম্ভব। কিন্তু যদি ল্যাব থেকে দূরে কোথাও রক্তদান করেন তাহলে তা বহন করে ল্যাবে নিয়ে
আসতে আসতে সেই রক্ত আর বিভিন্ন রক্ত উপাদানে বিভক্ত করা সম্ভব হয় না।
আমাদের দেশে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন
সংগঠন রক্তদান ও রক্তদাতাদের নিয়ে কাজ করছে। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের
ল্যাবের দিকে তাকাই। দুই যুগ ধরে তারা কাজ করছেন রক্ত নিয়ে। এটি একটি আন্তর্জাতিক মানের
ব্লাড ল্যাব। নিরাপদ ও দ্রুত সেবা দানের নিমিত্তে প্রয়োজনীয় আধুনিক যন্ত্রপাতির অনেকগুলোকেই
সন্নিবেশিত করা হয়েছে এ ল্যাবে। আল্ট্রা লো ডিপ ফ্রিজ, সেল সেপারেটর মেশিন, প্লাজমা
এক্সট্রাক্টর, প্লাটিলেট ইনকিউবেটরসহ ল্যাবটিতে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে এক ব্যাগ
রক্তকে আটটি উপাদানে আলাদা করার ব্যবস্থা রয়েছে। যেমন ১. প্লাটিলেট কনসেনট্রেট ২. ফ্রেশ
প্লাজমা ৩. ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা ৪. প্লাটিলেট রিচ প্লাজমা ৫. প্লাটিলেট পুওর প্লাজমা
৬. প্রোটিন সলিউশন ৭. রেড সেল কনসেনট্রেট এবং ৮. ক্রায়ো-প্রিসিপিটেট। তার মানে আপনার
দেয়া এক ব্যাগ রক্তকে একই সঙ্গে কাজে লাগানো যাচ্ছে কয়েকজনের প্রয়োজনে।
এক ব্যাগ রক্তের একাধিক উপকারের বিষয়টি
এখন সামনে আসা প্রয়োজন। অর্থাৎ নতুন রক্তদাতা তৈরির পাশাপাশি এক ব্যাগ রক্তের সর্বোচ্চ
ব্যবহার বিষয়েও সচেতন হতে হবে। উন্নত মানের ল্যাবে রক্ত দান এবং বিভিন্ন উপাদানে ভাগ
করে এক ব্যাগ রক্তকে আরো বেশি কাজে লাগাতে নিতে হবে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ। বিশেষত যারা
নিয়মিত রক্তদাতা, তাদের ল্যাবে গিয়ে রক্তদানে উৎসাহিত করতে হবে।
শারীরিক মানসিকভাবে আপাত সুস্থ ১৮ থেকে
৬০ বছর বয়সী যেকোনো সক্ষম ব্যক্তি প্রতি চার মাস পর রক্ত দিতে পারেন। নিয়মিত রক্তদানে
হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোকের ঝুঁকি দ্বিগুণেরও বেশি কমে যায়। ল্যাবে গিয়ে নিয়মিত রক্ত
দিন। এক বা একাধিক মুমূর্ষুর জীবন বাঁচাতে ভূমিকা রাখুন।
ড.
আবুল হাসনাত রোবেল: অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়