তিন মাসে খেলাপি ঋণ বাড়ল ৩৬,৬৬২ কোটি টাকা

প্রকাশ: জুন ০৭, ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাজেট ঘোষণার দিনই দেশের ব্যাংক খাতের দুঃসংবাদ নিয়ে হাজির হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ও হার দুটিই অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা ছিল। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩৬ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা বেড়েছে। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে গড় খেলাপি ঋণের হার ছিল ৯ শতাংশ। মাত্র তিন মাস পর খেলাপির এ হার ১১ দশমিক ১১ শতাংশে ঠেকেছে। মার্চ শেষে দেশের ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৪০ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা।

ব্যাংকনির্বাহীরা জানান, গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ কম দেখাতে বাছবিচার ছাড়াই ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছিল। এক্ষেত্রে জাতীয় নির্বাচনের প্রভাবও ছিল। নির্বাচনে প্রার্থী হতে অনেক ঋণখেলাপি পুনঃতফসিলের আশ্রয় নিয়েছিলেন। এর আগে কেবল ২০২২ সালেই ব্যাংকগুলোর পুনঃতফসীলকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ৬৩ হাজার ৭২০ কোটি টাকা। পুনঃতফসিল করা সেসব ঋণের পাশাপাশি নতুন ঋণও খেলাপি হয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জানানো হয়, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ৩ লাখ ১২ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২৭ শতাংশ ঋণ খেলাপির খাতায় উঠেছে।

একই সময়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ১২ লাখ ২১ হাজার ১১৬ কোটি টাকা। এ ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে। আর বিদেশী ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের ৫ দশমিক ২০ শতাংশ খেলাপি।

ঋণ পুনঃতফসিল বাড়ায় ব্যাংক খাতে ‘স্ট্রেসড’ বা ‘দুর্দশাগ্রস্ত’ ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে দেশের ব্যাংক খাতের পুনঃতফসীলকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত মোট ঋণের ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। খেলাপি ও পুনঃতফসীলকৃত ঋণকে ‘দুর্দশাগ্রস্ত’ হিসেবে দেখায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এ হিসেবে দেশের ব্যাংকগুলোর দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ লাখ ৫৮ হাজার ৪১৩ কোটি টাকায়। অন্যদিকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আদায় অযোগ্য হওয়ায় ব্যাংকগুলো প্রায় ৬৮ হাজার কোটি টাকার ঋণ অবলোপনও করেছে। সব মিলিয়ে দেশের ব্যাংক খাতের এক-চতুর্থাংশের বেশি ঋণ এখন দুর্দশাগ্রস্ত। 

আগে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত এককালীন বা ডাউন পেমেন্ট জমা দিতে হতো। কিন্তু খেলাপিদের প্রতি নমনীয় হতে গিয়ে ২০১৯ সালে এ হার ২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। যদিও ব্যাংকের প্রভাবশালী গ্রাহকরা কোনো ডাউন পেমেন্ট না দিয়েও খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ। গ্রাহকের অনুকূলে ঋণসীমা বাড়িয়ে দিয়েও ব্যাংকগুলো খেলাপি হওয়ার যোগ্য ঋণকে নিয়মিত দেখাচ্ছে। 

অন্যদিকে ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষমতাও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের হাতে ছেড়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অথচ আগে ব্যাংকগুলো নিজ পর্ষদে এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব পাস করে সেটি অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠাত। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যাচাই-বাছাইয়ের পর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করত। কিন্তু গত বছরের জুলাইয়ে সে ক্ষমতা ব্যাংকগুলোর হাতে ছেড়ে দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রজ্ঞাপনটি জারি হওয়ার পর ব্যাংকগুলো নিজেদের খেয়ালখুশিমতো ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ পায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ ‘উদারতাকেই’ খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলে উল্লম্ফনের প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশের ব্যাংক খাতের সুশাসন অনেক আগেই ভেঙে পড়েছে। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে ঋণের নামে জনগণের অর্থ লুণ্ঠন হয়েছে। এ কারণে পুনঃতফসিল নীতিমালা সহজ করা সত্ত্বেও ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। দেশের ব্যাংকগুলোয় দৃশ্যমান খেলাপি ঋণের চেয়ে ধামাচাপা দেয়া খেলাপি ঋণ অনেক বেশি। ব্যাংক খাত ভঙ্গুর হয়ে পড়ার প্রভাব অর্থনীতির সব ক্ষেত্রে এখন দৃশ্যমান।’ 


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫