আমি কেন জেলে যাব, আমি তো কোনো অপরাধ করিনি

প্রকাশ: জুন ০৫, ২০২৪

ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ক্ষুদ্র ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও নোবেলজয়ী (শান্তিতে, ২০০৬) একমাত্র বাংলাদেশী নাগরিক। ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মাননা ‘কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল’ পেয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে নোবেল শান্তি পুরস্কার, মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম (২০০৯) ও কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল—এই তিনটি অত্যন্ত সম্মানজনক পুরস্কার বিজয়ী বিশ্বের মাত্র সাতজন ব্যক্তিত্বের একজন ড. ইউনূস। ৪০০ কোটি ইউরো ব্যয়ে ‘প্যারিস ২০২৪ অলিম্পিক ভিলেজ’ তৈরি হয়েছে ড. ইউনূসের দর্শনের ভিত্তিতে এবং তিনি এ অলিম্পিকের উপদেষ্টা ও শুভেচ্ছা দূত। দারিদ্র্য বিমোচন ও নারীর ক্ষমতায়নে অবদান রাখার জন্য তিনি বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। কিন্তু দুর্নীতি ও শ্রম অধিকার লঙ্ঘনসহ নানা অভিযোগে দেশের আদালতে লড়ছেন শতাধিক মামলা। সম্প্রতি বণিক বার্তাকে দেয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে নানা ইস্যুতে কথা বলেন তিনি।

সম্প্রতি পৃথিবীজুড়ে গণমাধ্যমের শিরোনামে আপনার নাম। বেশকিছু ব্যত্যয়ের কারণে আদালতে যেতে হচ্ছে, সাজা হচ্ছে। এ বয়সে এসে এসব ঘটনা কি আপনার মনোবল কমাচ্ছে?

মনোবল কমানোর চেয়ে কাজে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে বেশি। যে কাজগুলো করতে চাচ্ছিলাম, শুরু করেছিলাম সেগুলো থেমে গেছে। এ বিষয়টি দুঃখজনক। জেলে নিয়ে যাওয়া মানে আমার সব উদ্যোগকে থামিয়ে দেয়া। এটা মৃত্যুর সমান। আমি কেন জেলে যাব। আমি তো কোনো অপরাধ করিনি।

আপনি যখন গ্রামীণ ব্যাংক, গ্রামীণ টেলিকম প্রতিষ্ঠা করেন ওই সময় সরকার আপনাকে সহযোগিতা করেছে। এখনো নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। বর্তমানে কি আপনি সরকারের থেকে সহযোগিতা পাচ্ছেন? না পেলে কেন পাচ্ছেন না?

সহযোগিতা পাচ্ছি কিনা বা কেন পাচ্ছি না এর উত্তর সাংবাদিকরাই ভালো দিতে পারবেন। যেহেতু তারা লক্ষ্য করছেন দেশে কী হচ্ছে আর কী হচ্ছে না। আমরা যেসব বড় ধরনের প্রস্তুতির জন্য তৈরি হয়েছিলাম, সেগুলো এগিয়ে নিতে পারছি না। এখন ভয় হচ্ছে যেগুলো তৈরি করেছি সেগুলো সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে! সবকিছুর পেছনে বহু মানুষের শ্রম আছে, সেসব তৈরি করা সহজ ছিল না। এগুলো ছিন্নভিন্ন হতে দেখা আমার জন্য সবচেয়ে বড় কষ্টের বিষয় এখন।  

বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে কয়েক বছর ধরে পশ্চিমা চাপ ছিল। নির্বাচনের পর মার্কিন এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এসেছিলেন। এবার বললেন, সম্পর্কটা পুনর্নির্মাণ করতে চান। আপনার কি মনে হয় এখন সেই চাপ কিছুটা কমে গেছে বা বাংলাদেশের গণতন্ত্র বা মানবাধিকার নিয়ে তারা ধীরে চলো নীতি গ্রহণ করছে?

পশ্চিমারা কী চায় তা আমার কাছে বড় বিবেচ্য বিষয় না। বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, আমরা গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা চাই কিনা। আমরা যা চাই, তারাও যদি তাই চায় তাহলে আনন্দের কথা। তারা না চাইলে আমরা আমাদের মতো করে চাইতে থাকব। তাদের মত আমাদের ওপর চাপিয়ে দেবেন, সেটা কেন হতে দেব?

তারা কখন কী বলল তা দিয়ে কিছু যায়-আসে না। প্রত্যেক দেশ তার নিজের নিয়মে তার পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করবে। আমাদের চাওয়া আগে পরিষ্কার হওয়া দরকার। তারা কী চাইল না চাইল, মতের বাইরে চলে গেল—তাতে আমাদের মত পাল্টাবে না। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত করা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো যতদিন আমরা প্রতিষ্ঠিত করতে পারব না ততদিন নানা ছলচাতুরীর মাধ্যমে কথা বলতে থাকব। এগুলো কোনো কাজের কথা না। কাজের কথা হলো এসব আমাদের নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।  

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আপনি আমেরিকায় ছিলেন। স্বাধীনতার পর দেশে এলেন। গত ৫০ বছরে নেশন বিল্ডিং বা জাতি গঠনে বাংলাদেশ কতদূর এগিয়েছে? সমস্যাগুলো কোথায়? 

আমি তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি অঙ্গরাজ্যের রাজধানী ন্যাশভিলে ছিলাম। সেখানে মিডল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ১৯৬৯-৭১ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করি। এ সময় দেশে কী হচ্ছে তার খোঁজখবর রাখছি। সব মিলিয়ে আমরা ছয়জন বাঙালি ছিলাম। তখন খবর পেলাম বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার জন্য আমরা ছয়জন একত্র হলাম। সেখানে বাংলাদেশের পক্ষে নাগরিকত্ব গ্রহণ করা ও বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য পেশের বিষয়ে আলোচনা-বিতর্ক হলো। দীর্ঘ আলোচনার পর আমরা বাংলাদেশ সিটিজেনস কমিটি গঠন করে ন্যাশভিলে সবক’টি টেলিভিশন স্টেশনে জানালাম এবং নাগরিকত্ব গ্রহণ বিষয়ে সেসব টেলিভিশন স্টেশনে আমরা সাক্ষাৎকার দিলাম। এটিই ছিল আমাদের প্রথম কাজ। তারপর এ কাজ চালু রাখতে একটি ফান্ড গঠন করলাম এবং সবাই একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মাসিক চাঁদা জমা দেয়ার সিদ্ধান্ত হলো। এর দুইদিন পর বাংলাদেশের পক্ষে জনমত  গঠনের জন্য আমি ওয়াশিংটন ডিসিতে গেলাম। কারণ আমেরিকার সব বাঙালি ওয়াশিংটনে একত্র হওয়ার কথা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এনায়েত করিম তখন পাকিস্তানের ডেপুটি অ্যাম্বাসাডার। আমরা কজন তার বাসাতেই উঠেছি। সেখানে বাংলাদেশের পক্ষে কর্মকাণ্ড শুরু করলাম। কয়েকদিনের মধ্যে একটি নিউইয়র্কভিত্তিক বাংলাদেশ লিগ অব আমেরিকা নামের এবং আরেকটি শিকাগোভিত্তিক বাংলাদেশ ডিফেন্স লিগ নামের দুটি সংগঠন সৃষ্টি হলো। 

এ দুটো সংগঠনের পেছনে মূলত কারা কাজ করেছেন? 

বিশ্বখ্যাত বাংলাদেশী-আমেরিকান স্থপতি ও পুরকৌশলী ফজলুর রহমান খান (এফআর খান) বাংলাদেশ ডিফেন্স লিগের প্রতিষ্ঠাতা। আমরা দুটো সংগঠনের সঙ্গেই যোগাযোগ রাখছি। বাংলাদেশ ডিফেন্স লিগের পক্ষে অধ্যাপক শামসুল বারীর সম্পাদনায় একটি নিউজলেটার প্রকাশ করা হলো। নিউজলেটার পেয়ে আমরা অত্যন্ত খুশি হলাম। আমাকে শিকাগো কনফারেন্সে আমন্ত্রণ জানানো হলো এবং সেখানে গেলাম। সেখানে অনেক আলাপ-আলোচনা হলো। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ডিফেন্স লিগ নিউজলেটার প্রকাশের দায়িত্ব আমাকে দিল। দায়িত্ব পাওয়ার পর আমার বাসা থেকে প্রকাশ করতাম। এরপর অনেকগুলো সংখ্যা প্রকাশ করেছি। স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত নিউজলেটার প্রকাশ করেছি। এটা ছিল আমার জন্য বড় কাজ।

আমি আরো একটি কাজ করেছিলাম, সেটা হলো ওয়াশিংটন ডিসিতে একটি ইনফরমেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা। বাংলাদেশে কী হচ্ছে বা কেন হচ্ছে কেউ জানতে পারছে না।  তাই এ ইনফরশন সেন্টারের মাধ্যমে যাতে সবাই জানতে পারে বাংলাদেশে কী হচ্ছে বা কেন হচ্ছে। এছাড়া সাংবাদিক, সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানদের বাংলাদেশে যা হচ্ছে সে সম্পর্কে তথ্য দিতে হয়। এ কারণেই মূলত এ তথ্য সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় গ্রীষ্মকালীন ছুটি হলো এবং ছুটিতে আমি ইনফরমেশন সেন্টারের দায়িত্ব নিলাম। 

কাজ করলাম। এ কাজটি চলতে থাকল। প্রকাশিত নিউজলেটারের প্রতি সংখ্যায় আমার একটি কার্টুন থাকত। পরবর্তী সময়ে এই নিউজলেটারগুলো একত্র করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর একটি বই প্রকাশ করেছে। এই বইয়ে আমি ও অধ্যাপক শামসুল বারী ভূমিকা লিখেছি। স্বাধীনতা পর্যন্ত এটাই ছিল আমার মূল কাজ।  

দেশ যখন স্বাধীন হয়ে গেল তখন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরকে বললাম, আমার আর আমেরিকায় থাকা হবে না। এখন দেশে চলে যাব। আমি পদত্যাগ করে ১৯৭২ সালের জুনে দেশে ফিরে আসি।  

যখন এলেন তখন তো যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ। চারদিকে নানান সমস্যা, সম্পদ নেই। বাংলাদেশ পরিবর্তনের একটি বড় স্বপ্ন ছিল আপনার। পঞ্চাশ বছর পরে এসে আপনারা যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন তা কতটুকু পূরণ হলো?

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের পরিচয় ছিল তলাবিহীন ঝুড়ি। প্রায় সবার কাছেই পরিচিত ছিল দরিদ্রতম দেশ হিসেবে। প্রায় ৮৬ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত। দেশটি কী দুরবস্থার মধ্যে ছিল তা চিন্তাও করা যাবে না। ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ হলে দেশটি আরো কঠিন অবস্থার মধ্যে পড়ে। স্বাধীনতার আগের বাংলাদেশ বলতেই শোনাত দারিদ্র্য-দুঃখে ও রোগে ভরা বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর থেকেই দেশে ধীরে ধীরে একটা পরিবর্তন শুরু হলো। সাধারণ মানুষ খুবই সক্রিয় ভূমিকায় চলে এল। বাংলাদেশের মানুষের পরিচয় ছিল ঘরকুনো মানুষ হিসেবে, তারা তাদের নিজেদের ঘর ও গ্রাম ছেড়ে কোথাও যায়নি। সেই মানুষগুলো নিজেদের চেষ্টায় বিদেশ যাওয়া শুরু করল। ফলে বিদেশ যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেল। সরকারও জানত না, এ বিষয়ে তাদের কী করা দরকার। গত ৫০ বছরের মধ্যে মানুষ গ্রাম থেকে বিভিন্ন দেশে যেতে শুরু করল। এভাবেই এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষগুলো বহির্বিশ্বের মানুষের সঙ্গে পরিচিত হতে লাগল। 

স্বাধীনতা-পরবর্তী দ্বিতীয় পরিবর্তন এসেছে শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে। স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময়ে পাকিস্তানের বিনিয়োগকারীরা এ দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে।  সেসব প্রতিষ্ঠানে আগে বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা শিক্ষিত তরুণরা কেরানি পদে চাকরি করত। তারা কেরানির চাকরির বাইরে যেতে পারত না। কেরানি চাকরি না হলে ব্যবসা করেছে। হঠাৎ করে তরুণদের মধ্যে পরিবর্তন আসতে শুরু করল। বিভিন্ন দেশের কোটা সুবিধার কারণে বাংলাদেশে পোশাক শিল্প গড়ে উঠেছে। হংকং, কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশ এ দেশে পোশাক শিল্প গড়ে তোলে। সেখানে বাংলাদেশের ছেলেরা চাকরি করতে শুরু করল। পোশাক শিল্পে কাজ শুরু করে সেই কাজ শিখে ফেলে তারা। পরে তারা নিজেরাই পোশাক কারখানা দিতে লাগল। এভাবে বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের সূত্রপাত হলো। এ শিল্পই বাংলাদেশে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। পোশাক রফতানি করে বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। এ খাতে কাজ শুরু করে নারীরা। অথচ এসব নারী কখনই ভাবেনি তারা বাড়ির বাইরে গিয়ে কাজ করতে পারবে কিংবা কাজ করা যাবে। তারা সামাজিক বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি মানল না। নারীদের ঘরের বাইরে গিয়ে কাজ করা—বাংলাদেশে এটা বিরাট পরিবর্তন। এর মাধ্যমে নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হলো এবং তারা আত্মনির্ভরশীল হতে লাগল। সংসারের খরচ মেটাতে গরিব ঘরের মেয়েরা উপার্জন করে বাড়িতে টাকা পাঠাচ্ছে। এটা একটা অদ্ভুত ঘটনা। এটি একটি বিরাট পরিবর্তন। এ পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ আজকে পৃথিবীর দ্বিতীয় পোশাক রফতানিকারক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে। বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশের শূন্য থেকে বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে। 

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন এনজিওর ভূমিকা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের কাজ শুরু করল। গ্রামে গ্রামে এনজিওদের কর্মকাণ্ড। যে বিষয়েই যে এনজিও কাজ করছে তা দেশজুড়ে করছে। পরিবর্তন এসেছে। দেশে আগে কলেরার প্রাদুর্ভাব ছিল। আগে মানুষের মধ্যে অভিজ্ঞতা ছিল, কোনো এক গ্রামের মানুষ কলেরায় আক্রান্ত হলে অন্য গ্রামের মানুষ তারাও আক্রান্ত হবে এবং তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তাই দলে দলে গ্রাম থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত। এটা ছিল বাংলাদেশের চেহারা। কলেরা প্রতিরোধের জন্য আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র,  বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) লবণ-পানি-গুড়ের মিশ্রণে ওষুধের একটি ফর্মুলা বের করল, যা ঘরেই সহজে বানানো যায়। এটা খেলে মানুষ সুস্থ হয়ে ওঠে।  স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে মানুষ কলেরা থেকে ধীরে ধীরে মুক্তি পেতে থাকে, যা বিরাট পরিবর্তন। শুরুতে এ ফর্মুলার কোনো প্যাকেট ছিল না, মানুষ নিজেরাই বানাত। পরে তা প্যাকেট করে বাজারজাত করা হয়েছে। 

গ্রামীণ ব্যাংক নারীদের জন্য ঋণ নিয়ে এল। এর আগে কেউ শোনেনি যে ব্যাংক আবার গ্রামের গরিব নারীদের ঋণ দেবে। তাও আবার বিনা জামানতে। প্রথমে মানুষের কাছে অবাক কাণ্ড মনে হলো। তবে এ উদ্যোগকে কেউ কেউ ভালো বলল, আবার কেউ কেউ খারাপ বলল। ঋণ দেয়ার বিষয়টি গ্রামে গ্রামে প্রচার হয়ে গেল। গ্রামীণ ব্যাংক শুধু নারীদের ঋণই দিল না, ব্যাংকের মালিকও করল। প্রথমে ঋণের পরিমাণ ১০০-২০০ টাকা ছিল। এ পরিমাণ ঋণ নেয়ার জন্য মানুষের মধ্যে কী যে আগ্রহ! ঘণ্টার পর ঘণ্টা মানুষ অপেক্ষা করেছে, কী করতে হবে বা কী শিখতে হবে জানতে চেয়েছে। 

আগে বাংলাদেশের গ্রামে ধনী-গরিবের শৌচাগার ছিল না। তারা শৌচাগার ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিল না। ঝোপ-ঝাড়ে মানুষ প্রাকৃতিক কাজ করত। তারপর গ্রামীণ ব্যাংক শৌচাগার বানাতে মানুষকে উৎসাহী করে। কারণ গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হলে আগে শৌচাগার বানাতে হবে। ব্যাংকটি শৌচাগার বানাতে ঋণ দিল। 

তারপর গৃহ ঋণের দিকে গেলাম। আগে যেখানে মেয়েদের বিয়ে দেয়া হবে সেখানে জানতে চাওয়া হতো, ঘর কেমন? সে সময় টিনের চালওয়ালা ঘর মহা দুষ্প্রাপ্য। সে সময় বেশির ভাগ মানুষের ঘরের চাল ও দেয়াল পাটখড়ি দিয়ে বানানো। এ ঘরে না থামে বৃষ্টি, না থামে রোদ। গ্রামীণ ব্যাংক গরিবের পাটখড়ির ঘরকে টিনের ঘরে পরিবর্তন করতে গৃহ ঋণ দিতে শুরু করে। গ্রামীণ ব্যাংক নারীদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে একটি সমস্যা দেখে তা হলো তালাক। তখন আমরা ভাবতে শুরু করলাম, এ সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় কী? তখন গ্রামীণ ব্যাংক নারীদের জানিয়ে দিল, গৃহ ঋণ নিতে হলে জায়গার মালিক হতে হবে। নারীরা বলল, তারা স্বামীর বাড়িতে থাকে, তাদের নামে কোনো জমি নেই। তখন গ্রামীণ ব্যাংক বলেছে, স্বামীকে বলেন জমিটি আপনার নামে দলিল করে দিতে, তারপর আমরা ঋণ দেব। যেহেতু টিনের ঘরের জন্য স্বামীর আগ্রহ রয়েছে, তাই তারা মনে মনে কষ্ট হলেও জমি স্ত্রীর নামে দলিল করে দিয়েছে। যাদের জমি দলিল করে দিয়েছে আমরা তাদের ঋণ দিয়েছি। আমরা যেখানে গৃহ ঋণ দিয়েছি সেখানে আর তালাকের প্রশ্ন ওঠেনি। 

আবার যখন তালাকের প্রসঙ্গ ওঠে তখন স্ত্রী স্বামীকে ঘর ও জমির মালিকানার বিষয়ে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলে, তালাক দিলে কিন্তু তোমাকে  ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। জমি ও ঘরের মালিকানার অধিকার নারীর জন্য এক মস্ত বড় পাওয়া। 

দেশে পোশাক শিল্প গড়ে উঠল, গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হলো এবং মানুষ বিদেশ যাওয়া শুরু করল—বিশাল পরিবর্তন হলো। আগে ঘরকুনো বাঙালি, কেরানি বাঙালি—এ চেহারা পাল্টে গেল। আগে বাংলাদেশের মানুষ ঘরের বাইরে যেত না। ৫০ বছরের বিবর্তনে আজকের যে বাংলাদেশ আমরা দেখতে পাচ্ছি সেটা অভাবনীয়ই বটে।

রেমিট্যান্স ও মেয়েদের কাজে আসা—বাংলাদেশের পরিবর্তনে (ট্রান্সফরমেশন) কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করছে। তারপর ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া ও মেয়েরা শহরে আসতে শুরু করল। ঢাকা শহরে মিটিং-মিছিলে নারীরা অংশ নিচ্ছে। অথচ যেখানে এত মেয়ে এক সঙ্গে হাঁটতে পারবে সেটা কখনো চিন্তাই করা যেত না তখন। মেয়েদের সঙ্গে পুরুষ মানুষ না থাকলেও তাদের ঘর ভাড়া দেয়া বিশাল বিষয়, যা সামাজিক পরিবর্তন। এ পরিবর্তন ভিত্তি রচনা করেছে, যা বহুদূরে চলে যাবে। 

৫০ বছর আগে দক্ষিণ কোরিয়ার অবস্থাও বাংলাদেশ থেকে খুব বেশি আলাদা ছিল না। রাজনৈতিক সংকট ও সামরিক শাসনের মধ্য দিয়ে গেছে। কিন্তু শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বিনিয়োগের মাধ্যমে শিল্প জায়ান্ট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আমরা কী কী জিনিস মিস করলাম, যার কারণে আমরা সে রকম উন্নতি করতে পারলাম না?

আমাদের দেশে আরো অনেক পরিবর্তন আনা যেত। তবে যে পরিবর্তন হয়েছে সেটা বিরাট। এখন ভিত্তিটা তৈরি হয়েছে। এ ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে অনেক দূর যাওয়া যাবে। মালয়েশিয়ার দিকে তাকালে দেখতে পাবেন, সেখানকার মূল বাসিন্দা মালয়রা কিন্তু অত্যন্ত গরিব কৃষক ছিল। মালয়রা ভূমিপুত্র হলেও চীনাদের হাতে ছিল সব টাকা-পয়সা। কিন্তু এ ভূমিপুত্রদের বিভিন্ন সুযোগ ও লেখাপড়ার সুবিধা দিতে দিতে আজকে একটি পর্যায়ে এসেছে, তারা এখন দেশ শাসন করতে পারছে। সব জায়গায় তাদের একটি অবস্থান তৈরি হয়েছে। রাজনীতির কারণে মালয়েশিয়ায় নাটকীয় পরিবর্তন হয়েছে। শিক্ষা, আর্থিক কাঠামো  ও স্বাস্থ্যে মনোযোগ দিয়ে আমরাও কিন্তু সে রকম অনেক সাফল্যের অধ্যায় তৈরি করতে পারব। 

আপনি বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষের ক্ষমতায়নের জন্য গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এখন আপনার বয়স আশি-ঊর্ধ্ব। এ বয়সে এসে দরিদ্র মানুষের ক্ষমতায়নের জন্য নতুন করে কিছু ভাবছেন কি?

আমার পক্ষে যা যা করা সম্ভব, সেসব কাজ আমি করে চলেছি। ব্যাংক খাতের সমস্যা সমাধান থেকে শুরু করে সামাজিক ব্যবসার ধারণা নিয়ে আসা, তরুণ সমাজকে উদ্যোক্তা হতে উৎসাহিত করছি। আমি সবাইকে তিন শূন্যের পৃথিবী নির্মাণের কথা বলছি। আমাদের বর্তমান সভ্যতা একটি আত্মঘাতী সভ্যতা। এটা আমাদের সর্বনাশের পথে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের নতুন সভ্যতা গড়ে তুলতে হবে, যে সভ্যতা হবে তিন শূন্যের পৃথিবী—শূন্য কার্বন নির্গমন, শূন্য সম্পদ কেন্দ্রীভূতকরণ ও শূন্য বেকারত্ব। তরুণদের উদ্বুদ্ধ করে থাকি তিন শূন্য ক্লাব প্রতিষ্ঠা করতে, যেখানে মাত্র পাঁচজন সদস্য থাকবে। তাদের পরামর্শ দিয়ে থাকি যেন তারা তিন শূন্য লক্ষ্য পূরণে কাজ করে এবং তা নিজেদের জীবনেও প্রতিফলিত করে। কেননা অন্যকে কেবল বললেই হবে না, নিজেকেই আগে পরিবর্তনের জন্য কাজ করতে হবে। অর্থাৎ আমি এমন কোনো কাজ করব না, যাতে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বাড়ে। কিংবা আবর্জনা বাড়ে। অথবা সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়। 

বাংলাদেশে উন্নয়নের নামে ব্যাপক মাত্রায় সম্পদের কেন্দ্রীভূতকরণ হয়েছে। দেশের অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকরা সবাই এ কথা বলে এসেছেন, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য এটি বড় সমস্যা হয়ে সামনে আসবে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী।

সম্পদ কেন্দ্রীভূতকরণের সমস্যা পুরো পৃথিবীতেই রয়েছে। তবে বাংলাদেশে এটি বিশেষভাবে হচ্ছে উন্নয়নকে কেন্দ্র করে। কারণ এখন উন্নয়ন মানেই টাকা ধনীদের হাতে চলে যাওয়া। ফলে ধনীরাই শক্তিশালী ও সম্পদশালী হতে থাকবে। যে শক্তিশালী  রাজনৈতিক ক্ষমতা তার হাতে। বিদ্যমান অর্থনৈতিক কাঠামোয় এ প্রক্রিয়া প্রোথিত আছে। তাই কাঠামো পরিবর্তন ছাড়া আমাদের এ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। কাজেই আমাদের কাঠামোর পরিবর্তনে কাজ করতে হবে। কাঠামোর পরিবর্তনের জন্যই সামাজিক ব্যবসার ধারণাটি এসেছে। আমাদের এমন ব্যবসা করতে হবে যেটি সমস্যার সমাধান করবে, কোনো রকমেই মুনাফা অর্জনের ব্যবসা নয়। 

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সামাজিক ব্যবসা কেন্দ্র তৈরি হচ্ছে আমার নামে—ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার স্থাপন হয়েছে ৩৯টি দেশের ১০৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে সামাজিক ব্যবসা শিক্ষার কোর্স পড়ানো হয়। শিক্ষার মাধ্যমে আমরা যেমন ভুল একটি জগৎ তৈরি করেছি, তেমনি শিক্ষার মাধ্যমেই আমাদের সঠিক পথে ফিরে আসতে হবে।  

আশির দশকে বাংলাদেশের তরুণরা মিলে গার্মেন্টস শিল্প প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে তরুণদের মধ্যে দেশ ছাড়ার প্রবণতা বা ব্রেইন ড্রেইন বেড়েছে। বিশেষ করে দেশের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, যেমন বুয়েট থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ব্রেইন ড্রেইনকে আপনি কীভাবে দেখেন? দেশের তরুণরা কি দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা কমিয়ে দিয়েছে? 

আমি তরুণদের বিদেশ গমনকে সমর্থন করি। নয়তো তারা বিশ্বকে জানবে কীভাবে। আমি নিজেও বিদেশে গিয়েছি এবং তাদের যাওয়াকেও ন্যায্য মনে করি। যেকোনো উপলক্ষেই যাক না কেন। দেশের অনেক সাধারণ মানুষ বিদেশ পাড়ি জমিয়েছে, যা দেশে বিরাট পরিবর্তন এনেছে। কেননা বিদেশকে দেখার পর তারা বুঝতে শিখেছে নিজের দেশে কী আছে আর কী নেই বা কী থাকলে ভালো হতো। কিন্তু যদি তারা হতাশার কারণে চলে যাচ্ছে, তাহলে বলব হতাশা তো সবারই আছে। যে হতাশা আছে সেটিকে সবাই মিলে দূর করতে হবে। কাউকে তো দেশে আটকে রাখা হবে না। প্রত্যেক তরুণেরই উচিত একবার অন্তত বিদেশে যাওয়া। তারপর সে ঠিক করবে যে দেশে ফিরবে কিনা। বিদেশ গেলেই সে দেশকে বঞ্চিত করল এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। বিদেশ থেকেও দেশের জন্য কাজ করা যায়। প্রতি মূহূর্তে দেশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা যায়। যারা ফিরে আসে তারা অনেক অভিজ্ঞতা এবং ব্যক্তিগত যোগাযোগ নিয়ে ফিরে আসে। এটা দেশের জন্য অনেক মঙ্গলজনক।

আপনার দৃষ্টিতে কোন কোন বিষয় হতাশা তৈরি করছে বাংলাদেশে? বাংলাদেশের শিক্ষা খাতের সংস্কারে কি করণীয়?

আমরা যত দ্রুত সমাজকে পরিবর্তন করতে পারতাম, সেটি করছি না। আমরা কেবল উন্নয়নের কথা বলছি কিন্তু উন্নয়ন আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে তা বিচার করছি না। যেভাবে চলছে এভাবে চলতে থাকলে হতাশা বাড়বে, সম্পদ মুষ্টিমেয় লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত হবে আর বাকি মানুষ তাদের অধীনে চাকরি করবে। অথচ মানুষের জন্ম হয়েছে সৃষ্টিশীল কাজ করার জন্য, চাকরি করার জন্য নয়। এখন কেউ জন্ম নিয়ে বলা হয়, তাকে গড়তে হবে এমনভাবে যেন বড় হলে একটা চাকরি পায়। আমরা কেন দাসপ্রথায় ফিরে যেতে চাচ্ছি? চাকরি করা একপ্রকার দাস প্রথা অথচ আমরা জন্মাই সৃষ্টিশীল মানুষ হয়ে। প্রত্যেক মানুষের জন্ম হয় উদ্যোক্তা হিসেবে। অথচ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বলা হচ্ছে তাড়াতাড়ি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাও যেন পড়ালেখা শেষ করে দ্রুত চাকরি পাও। কিন্তু এটা মোটেও মানুষের লক্ষ্য হওয়া উচিত না। একজন মানুষের লক্ষ্য হওয়া উচিত তার সব শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে পৃথিবীতে তার দান বা ভূমিকা কী হবে কিংবা কোন স্বাক্ষর সে রেখে যাবে তা নির্ধারণ করা। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী যে শিক্ষা ব্যবস্থা, এটি দাসত্ব প্রথার শিক্ষা ব্যবস্থা। আমাদের সঠিক শিক্ষা ব্যবস্থা আনতে হবে, যেখানে একজন শিক্ষার্থী প্রবেশ করবে উদ্যোক্তা হওয়ার আশা নিয়ে এবং বের হবে উদ্যোক্তা হয়ে। 

বিভিন্ন দেশে আপনি কাজের সুযোগ পাচ্ছেন, বাংলাদেশে কি পাচ্ছেন?

বাংলাদেশে আর সুযোগ পাচ্ছি কোথায়? চারদিক থেকে কেবলই আক্রান্ত হচ্ছি। আদালতে দুয়ারে দুয়ারে সময় কাটাচ্ছি। ভবিষ্যৎকে নিয়ে কাজ করার সুযোগ হচ্ছে না। ফাঁকে ফাঁকে যদি কিছু করার সুযোগ পাই সেটা করি। কিন্তু এরপর হঠাৎ করে আরেকটা ভয়ংকর আক্রমণ শুরু হয়।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫