স্কয়ার ফার্মা

দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতে শ্রেষ্ঠতা

প্রকাশ: জুন ০৩, ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাবার রেখে যাওয়া কোম্পানির সম্পদ প্রায় ৬০০ শতাংশ বেড়েছে এক যুগে

দেশের বিভিন্ন বৃহৎ করপোরেট প্রতিষ্ঠানে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বড় ধরনের ভাঙন দেখা গেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রথম প্রজন্মের গড়ে তোলা পারিবারিক ব্যবসার অংশ নিয়ে দ্বিতীয় প্রজন্মের দ্বন্দ্বের কারণে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। কখনো কখনো তা গড়াচ্ছে আদালত পর্যন্তও। প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তার উত্তরাধিকারীরা মামলা করছেন একে অন্যের বিরুদ্ধে। এক সময় পুরনো প্রতিষ্ঠান ভেঙে তৈরি হচ্ছে ভিন্ন প্রতিষ্ঠান। হুমকিতে পড়ছে প্রাতিষ্ঠানিক ও আর্থিক সক্ষমতা। তবে এ ধারায় একেবারেই ব্যতিক্রম স্কয়ার গ্রুপের ফ্ল্যাগশিপ কোম্পানি স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস পিএলসি। দ্বিতীয় প্রজন্মের হাত ধরে এক যুগে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বৃহৎ এ প্রতিষ্ঠানটির সম্পদ বেড়েছে প্রায় ৬০০ শতাংশ।

কভিড কিংবা বৈশ্বিক ও স্থানীয় অর্থনৈতিক সংকট—যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতেই বিভিন্ন আর্থিক সূচকে দিন দিন আরো সমৃদ্ধ হচ্ছে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস। প্রতি বছরই কোম্পানিটির আর্থিক ভিত শক্তিশালী হওয়ার পাশাপাশি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ব্যবসার আয় ও মুনাফায়। এক্ষেত্রে প্রথম প্রজন্মের ব্যবসায়িক সফলতা ধরে রেখে দ্বিতীয় প্রজন্মের সদস্যরা কোম্পানিটিকে আরো বিস্তৃত করে চলেছেন। নগদ অর্থ ও সংরক্ষিত আয়ের দিক দিয়ে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস হয়ে উঠেছে দেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ কোম্পানিতে। প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন, পেশাদারি মনোভাব ও অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ে লাগাম টানার মাধ্যমেই এ সাফল্য এসেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।



প্রয়াত স্যামসন এইচ চৌধুরীর হাত ধরে ১৯৫৮ সালে যাত্রা শুরু হয় স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের। চার বন্ধু মিলে সে সময় ২০ হাজার টাকার মূলধন, ১২ কর্মী ও তিন হাজার বর্গফুটের জায়গায় শুরু করেন কোম্পানিটির কার্যক্রম। বর্তমানে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস দেশের ওষুধ খাতের শীর্ষ কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। ক্রমেই ব্যবসা বাড়ছে বিদেশের বাজারেও। স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের স্বপ্নদ্রষ্টা স্যামসন এইচ চৌধুরীর প্রয়াণ হয় ২০১২ সালে। এরপর গত এক যুগে কোম্পানিটির সম্পদ, নগদ অর্থ, সংরক্ষিত আয়, বিক্রি ও মুনাফা বেড়েছে বহু গুণ। স্যামসন এইচ চৌধুরীর সন্তান তথা দ্বিতীয় প্রজন্মের সদস্যরা এ অগ্রযাত্রা ও সম্প্রসারণে ভূমিকা রেখে চলেছেন। বর্তমানে কোম্পানিটিতে যুক্ত হয়েছেন তৃতীয় প্রজন্মও। সে হিসেবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ব্যবসার নেতৃত্ব স্থানান্তর ও সাফল্য ধরে রাখার টেক্সট বুক নজির হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস।

প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ব্যবসা টিকিয়ে রেখে এগিয়ে নেয়ার কৌশল প্রসঙ্গে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রথমত, উত্তরসূরিদের প্রস্তুতি প্রয়োজন। আমাদের খুব ভালোভাবে বুঝতে হবে, ব্যবসার দায়িত্ব নেয়ার জন্য উত্তরসূরিরা নিজেরা কতটা প্রস্তুত হয়েছে। লেখাপড়া, প্রশিক্ষণ ও পূর্বসূরিদের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তাদের এ প্রস্তুতি নিতে হবে। অর্গানাইজেশনাল কালচার বা প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা বুঝতে হবে। অনেকের সন্তান এসে প্রথমেই সরাসরি ম্যানেজমেন্টে বসছে। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতায় ব্যবসা পরিচালনার খুঁটিনাটি শিখতে হবে একদম প্রাথমিক পর্যায় থেকে। এতে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার বিভিন্ন দিক বুঝতে সুবিধা হবে।’

যেসব কোম্পানি কাঠামোর মধ্যে আসতে পারেনি, পেশাদারদের দিয়ে ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলেনি; সেগুলোর ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব ও বিরোধ পরিস্থিতি অনস্বীকার্য বলে মন্তব্য করেন তপন চৌধুরী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘যতই পারিবারিক ব্যবসা হোক, একটা পর্যায়ে এসে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তুলতে হয়। মালিকের সন্তান হলেই প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে আসার বিশেষত্ব থাকবে, এমনটা ধরে নেয়ার কোনো কারণ নেই। যথাযথ যোগ্যতার সঙ্গে অভিজ্ঞতাটাও জরুরি। আমাদের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে; যারা এখানেই পেশাদার হিসেবে বেড়ে উঠেছেন, তাদের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। আমাদের গ্রুপের ভিন্ন খাতের সব প্রতিষ্ঠানই পেশাদারদের দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ার সঙ্গে তারা গভীরভাবে সম্পৃক্ত। কাঠামোটি এমনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে যে গুরুত্বপূর্ণ ওই পেশাদারদের অবর্তমানেও প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া যথাযথভাবেই পরিচালিত হচ্ছে। এখন তাদের কাছ থেকে আমাদের পরিবারের সন্তানরা শিখছে, একসঙ্গে কাজ করছে। পরিবারের জ্যেষ্ঠদের থেকে শেখার সুযোগ থাকলেও তারা প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব পালন শিখছে পেশাদারের কাছ থেকে। এটা আমাদের একটা বড় শক্তির ক্ষেত্র।’

স্যামসন এইচ চৌধুরীর প্রয়াণের সময় ২০১১-১২ হিসাব বছরে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের মোট সম্পদ ছিল ২ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা, যা সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে এসে দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ১৮২ কোটি টাকায়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকায়। একইভাবে এ সময়ে কোম্পানিটির সংরক্ষিত আয় ১ হাজার ১০৮ কোটি থেকে ১০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। সেই সঙ্গে মোট বিক্রি ১ হাজার ৮৫৯ কোটি থেকে ৭ হাজার ২৩৪ কোটি টাকা এবং কর-পরবর্তী নিট মুনাফা ২৯০ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা।

সামষ্টিক অর্থনীতির নানামুখী সংকটের প্রভাব পড়েছে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে। একদিকে মূল্যস্ফীতির চাপে ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা সংকুচিত হয়েছে, অন্যদিকে টাকার অবমূল্যায়ন ও ডলার সংকটের কারণে চাহিদা অনুযায়ী কাঁচামালসহ অন্যান্য পণ্য আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তবে এসব সংকটেও তেমন প্রভাব পড়তে দেখা যায়নি দেশের ওষুধ খাতের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবসায়। আয় ও মুনাফা বাড়ার পাশাপাশি আরো স্ফীত হয়েছে কোম্পানিটির নগদ অর্থ ও সংরক্ষিত আয়।

ভবিষ্যতে ব্যবসার প্রয়োজনে তহবিলের চাহিদা মেটাতে কোম্পানিগুলো সংরক্ষিত আয় (রিটেইন্ড আর্নিংস) রেখে থাকে। এতে যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে অর্থ সংস্থান সহজ হয়। কোম্পানির তহবিলে নগদ অর্থ থাকলে সেটি জরুরি প্রয়োজনে কাজে লাগানোর পাশাপাশি তা ব্যাংকে আমানত হিসেবে রেখেও সুদ বাবদ আয় করা যায়। গুরুত্বপূর্ণ এ দুই আর্থিক নির্দেশকে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস পিএলসি। গত পাঁচ বছরে কোম্পানিটির সংরক্ষিত আয় বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। ২০১৮-১৯ হিসাব বছরে স্কয়ার ফার্মার সংরক্ষিত আয় ছিল ৫ হাজার ৫৪৯ কোটি টাকা, যা সর্বশেষ চলতি ২০২৩-২৪ হিসাব বছরের তৃতীয় প্রান্তিক শেষে ১০ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। 

সংরক্ষিত আয় ও নগদ অর্থে সমৃদ্ধ থাকার সুবাদে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস আর্থিকভাবে শক্তিশালী কোম্পানি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। কোনো ধরনের আপৎকালীন পরিস্থিতিতে তাদের তহবিল নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। তাছাড়া হাতে বড় অংকের নগদ অর্থ থাকার কারণে কোম্পানিটিকে ঋণের জন্য ব্যাংকেরও দ্বারস্থ হতে হয় না। প্রতিষ্ঠানটি প্রতি বছরই নিজেদের অর্থে ব্যবসা সম্প্রসারণ করছে। পাশাপাশি নগদ অর্থ ব্যাংকে আমানত রাখায় বড় অংকের সুদ আয়ও হচ্ছে। 

কঠিন পরিস্থিতিতেও বড় অংকের নগদ অর্থ ও সংরক্ষিত আয় কীভাবে ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে জানতে চাইলে তপন চৌধুরী বলেন, ‘ঋণের ওপর নির্ভরশীল না হওয়াটা আমাদের কৌশলগত সিদ্ধান্ত। চেষ্টা করেছি কোম্পানি যেন হেলদি থাকে। কোম্পানি ও শেয়ারহোল্ডারদের ওপর অতিরিক্ত চাপ যেন সৃষ্টি না হয়। এ পরিস্থিতির মধ্যেও আমরা ধারাবাহিকভাবে বিনিয়োগ করে যাচ্ছি। শুধু দেশের মধ্যে না, দেশের বাইরেও বিনিয়োগ করছি। পাশাপাশি ব্যয় করার ক্ষেত্রে স্কয়ার খুবই সচেতন। অনেক কোম্পানি কার্যালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন খাতে অতিরিক্ত ব্যয় করে। কিন্তু আমাদের ব্যয়গুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নতুন পণ্য বাজারে আনার লক্ষ্যে করে থাকি। অনেক সময় ব্যাংকাররা আমাদের ঋণ সাধেন, কিন্তু আমাদের তা প্রয়োজন পড়ে না।’

স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবসা থেকে প্রতি বছরই আয় ও মুনাফা বাড়ছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কোম্পানিটির মোট বিক্রি ছিল ৫ হাজার ৮৭ কোটি টাকা, যা সর্বশেষ ২০২২-২৩ হিসাব বছরে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ২৩৪ কোটি টাকায়। এ সময় কোম্পানিটির কর-পরবর্তী নিট মুনাফা ১ হাজার ১৭২ কোটি থেকে বেড়ে ১ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। দেশের বাজারের পাশাপাশি বিদেশে ওষুধ রফতানি থেকে আয়ও বাড়ছে। ২০২২-২৩ হিসাব বছরে ওষুধ রফতানি করে আয় করেছে ১৯৬ কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যবসা সম্প্রসারণে এরই মধ্যে কেনিয়া ও ফিলিপাইনে বিনিয়োগ করেছে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫