মালয়েশিয়ামুখী কর্মীদের ভোগান্তি

প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে

প্রকাশ: জুন ০৩, ২০২৪

জনশক্তি রফতানির নিরিখে দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। অনিয়ম ও সিন্ডিকেটের কারণে ৩১ মে মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার বন্ধ হয়েছে। এর আগেও একই অভিযোগে দুইবার  তা বন্ধ হয়েছিল। শ্রমবাজার বন্ধের মূল কারণ দুর্নীতি ও সিন্ডিকেট। অন্যদিকে শ্রমিকদের সঙ্গে রিক্রুটিং এজেন্সি ও দালালদের প্রতারণা। এ-সংক্রান্ত সংবাদ প্রতিদিনই সংবাদপত্রে প্রকাশ হচ্ছে। এমনকি নাম ধরেই প্রকাশ হচ্ছে। তার পরও কেন সরকার তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বৈদেশিক কর্মসংস্থানে দেশের অন্যতম শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। বিদেশী কর্মী নিয়োগ বন্ধের খবরে অনেকেই হতাশ হয়েছেন, বিশেষ করে যারা সে দেশে কাজ করতে আগ্রহী। এজন্য শ্রমিকদের অনেকেই তাদের শেষ মূল্যবান সম্বলটুকু বন্ধক রেখে বা বিক্রি করেও মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি। প্রতারণার শিকার হয়েছেন সিন্ডিকেটের কারসাজি ও দুর্নীতির, যা এক ধরনের অপরাধ। অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। তাদের এসব কর্মকাণ্ডে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শ্রমবাজারে। দেশের শ্রমবাজার বাঁচাতে ও ভাবমূর্তি রক্ষায় সরকারকে আরো কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। নয়তো আমাদের দেশের শ্রমবাজার আরো কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। 

চক্র তৈরি করে কর্মী পাঠানোর অনিয়মের অভিযোগে ২০০৯ সালে প্রথম দফায় বন্ধ হয় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। এরপর ২০১৬ সালের শেষে খোলা হয় বাজারটি। তখন বাংলাদেশের ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সি চক্র গড়েছিল। দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে আবার বন্ধ হয়ে যায় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। চার বছর বন্ধ থাকার পর ২০২২ সালে বাংলাদেশীদের জন্য আবার মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলে। তখন আবারো চক্র সৃষ্টি করা হয়। গত মার্চে মালয়েশিয়া জানায়, দেশটি আপাতত আর শ্রমিক নেবে না। যারা অনুমোদন পেয়েছেন, ভিসা পেয়েছেন, তাদের ৩১ মের মধ্যে মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করতে হবে। 

মালয়েশিয়া সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, অনুমোদন পাওয়া বাংলাদেশী কর্মীদের সে দেশে প্রবেশের শেষ দিন ছিল ৩১ মে, শুক্রবার। কর্মী ভিসায় শুক্রবারের পর আপাতত আর কেউ সেখানে প্রবেশ করতে পারবেন না। তাই শুক্রবার ঢাকা বিমানবন্দরে হাজারো মানুষের ভিড় দেখা যায়।

উড়োজাহাজের টিকিট না পেয়ে ঠিক কতজন আটকে গেছেন, তার হিসাব নেই সরকারি সংস্থার কাছে। জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বায়রাও এর হিসাব দিতে পারছে না। তবে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ও জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) সূত্রে জানা গেছে, ভিসা ও অনুমোদন জটিলতায় ৩১ হাজার ৩০৪ জন কর্মী আটকা পড়েছেন। মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর আগে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন নিতে হয়। এবার শ্রমবাজার চালুর পর মালয়েশিয়া যেতে ৫ লাখ ২৪ হাজার ৯৪৬ জন কর্মীর অনুমোদন নেয় ১০১টি এজেন্সি। এর মধ্যে সব কর্মীর জন্য মালয়েশিয়া থেকে চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়া যায়নি। তাই বিএমইটি থেকে শেষ পর্যন্ত সব এজেন্সি মিলে ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৬৪২ কর্মীর ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে। 

শ্রমবাজার বন্ধের দিনে প্রায় ৩২ হাজার মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছুক কর্মী দালাল-এজেন্সির প্রতারণায় দেশটিতে যেতে পারেননি। এ বিদেশগামী প্রত্যেকটি মানুষ ঋণ করে ৫-৬ লাখ টাকা দালাল ও এজেন্সিকে দিয়েছেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর এসেছে। তারা নিরুপায় হয়ে বিমানবন্দর থেকে হতাশা নিয়ে গ্রামে ফিরেছেন। এ মানুষগুলো এখন কীভাবে ঋণ শোধ করবেন, তার উত্তর নেই কারো কাছে। আবার কত বছর পর দ্বার খুলবে এ শ্রমবাজারের, তারও নিশ্চয়তাও নেই। তবে ঝুলে যাওয়া কর্মীদের বিষয়ে সরকার উদ্যোগী হলে সমাধান হতে পারে। একই সঙ্গে প্রতারক ও সিন্ডিকেট চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করাও জরুরি। 

গত দুই বছরে অভিবাসী শ্রমিকদের অর্ধেকের গন্তব্য ছিল সৌদি আরব। এরপর সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কাতার, কুয়েত, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর। এসব শ্রমবাজারে শ্রমিকের সংখ্যার সঙ্গে সঙ্গে দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহও বাড়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে একেবারেই বিপরীত চিত্র দেখা গেছে। এর প্রধান কারণ দালাল-সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। যাদের প্রতারণায় বিদেশগামীরা কয়েক লাখ টাকা খরচ করে দেশ ছাড়লেও পর্যাপ্ত কাজ পাচ্ছেন না। হয়রানির শিকারও হচ্ছেন। এমনকি অনেকে কাজ না পেয়ে হতাশা নিয়ে দেশে ফিরছেন। দেশে ফিরে দেনার দায়ে তাদের জীবন আরো দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। ফলে রেমিট্যান্স কমছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) সৌদি আরব থেকে মাত্র ১৯৬ কোটি ৬৯ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩৭৬ কোটি ৫৩ লাখ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪৫৪ কোটি ১৯ লাখ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫৭২ কোটি ১৪ লাখ ডলার রেমিট্যান্স আসে দেশটি থেকে। এতে প্রতি বছর ধারাবাহিকভাবে কমেছে রেমিট্যান্স প্রবাহ।

মালয়েশিয়ায় যাওয়া বাংলাদেশী শ্রমিকদের দুরবস্থা নিয়ে বাংলাদেশ কোনো ব্যবস্থা না নিলেও জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। প্রত্যেক শ্রমিকের ন্যূনতম অধিকার ও মানবিক মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব স্বাগতিক দেশের। সেই দায়িত্ব মালয়েশিয়া কিংবা অন্যান্য দেশ কতটা পালন করেছে, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। এসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা রোধে বাংলাদেশেরও করণীয় আছে বলে মনে করি। অন্তত সমস্যাগুলো নিয়ে স্বাগতিক দেশগুলোর সঙ্গে সরকার আলোচনা করতে পারে।

মালয়েশিয়া কেন বিদেশী কর্মী নিয়োগ বন্ধ করল, তার প্রকৃত কারণ খতিয়ে দেখা দরকার। বস্তুত সিন্ডিকেটের কারণে অতীতে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রিক্রুটিং এজেন্সি বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও উঠেছে দুর্নীতির অভিযোগ। বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, দেশের অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এ-সংক্রান্ত সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত। এ সিন্ডিকেটের কারণে দেশের সব এজেন্সি মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর সুযোগ পায় না; সুযোগ পায় কিছুসংখ্যক এজেন্সি। তারাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। এদের কারণে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে জনপ্রতি ব্যয় হয় সরকার নির্ধারিত ব্যয়ের চেয়ে অনেক গুণ বেশি। দেখা গেছে, মালয়েশিয়ায় যাওয়ার সরকার নির্ধারিত জনপ্রতি ব্যয় যেখানে ৭৯ হাজার টাকা, সেখানে গড়ে একজন বাংলাদেশী কর্মী খরচ করেছেন প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টাকা। অথচ মালয়েশিয়ায় গিয়ে অনেক শ্রমিকই বেকার থাকছেন। কাজেই এই সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। তা না হলে বিদেশে যেতে আগ্রহী কর্মীরা বারবার প্রতারণার শিকার হবেন। সিন্ডিকেটের কারণে বিদেশে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে।

বিদেশী শ্রমবাজার আমাদের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে ডলার সংকটের সময় এর গুরুত্ব আরো বেড়েছে। তাই এ বাজার যাতে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে সরকারকে বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নতুন শ্রমবাজার খোঁজার পাশাপাশি চলমান শ্রমবাজারগুলোয় নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে হবে। অথচ এক্ষেত্রে আমরা ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছি, যা মোটেই কাম্য নয়।

এতে একদিকে যেমন বিদেশ গমনে আগ্রহীদের মনে ক্ষোভ, হতাশা দানা বাঁধছে, অন্যদিকে বিপুল অংকের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ। তাছাড়া বৈধভাবে বিদেশ যাওয়ার পথ অনেক ক্ষেত্রে রুদ্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেকেই নানা মাধ্যমে অবৈধ উপায়ে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এতে মানুষ নানাভাবে প্রতারণা ও হয়রানির শিকার হচ্ছে। প্রতারকদের কবলে পড়ে বিদেশ গমনেচ্ছুরা কেবল সর্বস্বান্তই হচ্ছে না, এর ফলে দেশও অপরিমেয় ক্ষতির মুখে পড়ছে।

শ্রমিক পাঠানো নিয়ে সৃষ্ট সংকট মোকাবেলায় সরকার ছয় সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এ বিষয়ে শুধু কমিটি গঠন করলেই হবে না বরং এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। 

অবৈধভাবে গমনের কারণে বহির্বিশ্বের সম্ভাবনাময় অনেক শ্রমবাজার এ দেশীয় শ্রমিকদের জন্য নিষিদ্ধ জোনেও পরিণত হয়েছিল। এ বাস্তবতা সামনে রেখে দক্ষ জনবল গড়ে তোলার পাশাপাশি সব ধরনের প্রটোকল বজায় রেখে জনশক্তি রফতানি নিশ্চিত করতে হবে। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার যাতে দ্রুত পুনরুদ্ধার হয়, 

সেজন্য সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নেবে, এটাই কাম্য।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫