নোয়াব সম্মাননা পেল ছয় সংবাদপত্র - সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিতের দাবি সম্পাদক ও নোয়াব সদস্যদের

প্রকাশ: জুন ০২, ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশের ছয় দৈনিককে সম্মাননা দিয়েছে সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব)। ৫০ বছর পেরোনো চারটি ও ২৫ বছর পেরোনো দুটি সংবাদপত্রকে গতকাল এ সম্মাননা দেয়া হয়। এর মধ্যে ৫০ বছর পেরোনো চার সংবাদপত্র হলো সংবাদ, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক আজাদী ও দৈনিক পূর্বাঞ্চল। ২৫ বছর পেরোনো দুই সংবাদপত্র হলো মানবজমিন ও প্রথম আলো। 

রাজধানীর গুলশান ক্লাবের দ্য ক্রিস্টাল প্যালেস হলে এ সম্মাননা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। বিশেষ অতিথি ছিলেন তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত। অনুষ্ঠানে ৫০ বছর পূর্ণ করা পত্রিকার মধ্যে সংবাদের পক্ষে ব্যারিস্টার নিহাদ কবির, ইত্তেফাকের পক্ষে সম্পাদক তাসমিমা হোসেন, দৈনিক আজাদীর পক্ষে নির্বাহী সম্পাদক শিহাব মালেক সম্মাননা গ্রহণ করেন। আর ২৫ বছর পূর্ণ করা দৈনিক মানবজমিনের পক্ষে প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী ও সম্পাদক মাহবুবা চৌধুরী এবং প্রথম আলোর পক্ষে সম্পাদক মতিউর রহমান সম্মাননা গ্রহণ করেন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, ‘সংবাদপত্র শিল্পের বিকাশে এর মালিকদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। জনমত গঠন করা, সামাজিক দায়িত্ব পালন করার মতো মৌলিক দায়িত্ব থেকে সংবাদপত্র যেন দূরে সরে না যায়।’ 

এ সময় সংবাদপত্রের অতীত ও বর্তমান ভূমিকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘জাতির পিতার ২৩ বছরের সংগ্রাম ও আন্দোলন এবং সেই উত্তাল সময়ে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ’৬৬-এর ছয় দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ—সব পথই পত্রিকাগুলো পার করে এসেছে এবং তারা সে সময়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। আজকের দিনেও তাকালে দেখা যাবে এলডিসি থেকে উত্তরণ, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার পথেও সব পত্রিকা সঙ্গে আছে। বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, সে অগ্রগতিতে তারাও অবদান রাখছে। সেজন্য তাদের অভিনন্দন।’ 

স্পিকার বলেন, ‘জনমত গঠনসহ সংবাদপত্রের যে মৌলিক দায়িত্ব, তা থেকে আমরা যেন সরে না যাই।’

এ সময় সম্মাননা পাওয়া ছয় সংবাদপত্রকে অভিনন্দন জানান স্পিকার। এ ধরনের উদ্যোগ নেয়ার জন্য নোয়াবকেও অভিনন্দন জানান তিনি।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত। তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনো ইচ্ছা সরকারের নেই। আপনারা স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করুন। মুক্ত গণমাধ্যম আমাদের জন্য খুবই দরকার। একই সঙ্গে দরকার অপতথ্য বন্ধ রাখা। আমরা সমালোচনা শুনতে চাই। আমরা চাই এ ধরনের পরিবেশ বজায় থাকুক। এটা যেন অব্যাহত থাকে। আমাদের কোনো ভুল নেই, এমন কথা শুনতে চাই না। সমালোচনার মাধ্যমে আমরা নিজেদের শুধরাতে চাই। সমালোচনাকে সরকার স্বাগত জানায়। আপনারা সমালোচনা করেন, তবে তা যেন বস্তুনিষ্ঠ হয়।’

প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে যেসব র‍্যাংকিং প্রকাশ হয়, সেগুলোয় ত্রুটি আছে। আমি র‍্যাংকিং পড়েছি। সেখানে দেখেছি, র‍্যাংকিংয়ে যেসব তথ্য নেয়া হয়, সেখানে অনেক ভুল রয়েছে। মুক্ত সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীতে। তবে আমরা এখানে চ্যালেঞ্জের কথা অস্বীকার করব না।’

অনুষ্ঠানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার দাবি তোলেন সম্পাদক ও নোয়াব সদস্যরা। তাদের বক্তব্যে উঠে আসে, সংবাদপত্রকে আইনের মধ্যে আটকে না রাখলেই সাংবাদিকদের পক্ষে স্বাধীন ও যথাযথভাবে তথ্য উপস্থাপনের সুযোগ তৈরি হবে। 

সূচনা বক্তব্যে নোয়াব সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সংবাদপত্র শিল্প নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ছে। প্রযুক্তির নতুন নতুন দিক উন্মোচিত হচ্ছে। এসব প্রযুক্তির অনেক সুবিধা এখনো গ্রহণ করার বাকি আছে। প্রযুক্তির কারণে কিছু সমস্যাও তৈরি হচ্ছে। আরেকটি সমস্যা তৈরি করেছে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট। গত বছর ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট (ডিএসএ) সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টে (সিএসএ) রূপ পেয়েছে। নোয়াব ও সম্পাদক পরিষদ এরই মধ্যে এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আমরা আশা করছি সরকার এসব উদ্বেগ বিবেচনা করবে এবং প্রেস কাউন্সিল সাংবাদিকতার সমস্যা সমাধানে একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হিসেবে কাজ করবে।’ 

এ কে আজাদ বলেন, ‘নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়লেও আমাদের উদযাপনের অনেক কিছু রয়েছে। আমাদের কয়েকটি সংবাদপত্র ছয়-সাত দশক ধরে জনগণের মুখপত্র হিসেবে কাজ করছে। পাঁচ দশক ধরে বিদ্যমান একটি জাতির জন্য এটি বেশ বড় কীর্তি।’ 

সম্মাননাপ্রাপ্ত সংবাদপত্রগুলোর মধ্যে ইত্তেফাক সম্পাদক তাসমিমা হোসেন বলেন, ‘অনেকেই মনে করেন ইত্তেফাক বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো পত্রিকা। কিন্তু বিষয়টি সত্য নয়। ইত্তেফাকের আগে ১৯৫১ সালে সংবাদ যাত্রা করে এবং ১৯৫৩ সালে ইত্তেফাকের যাত্রা। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে সংবাদপত্র আরো এগিয়ে যাবে।’ 

দৈনিক আজাদীর নির্বাহী সম্পাদক শিহাব মালেক বলেন, ‘আমার দাদা যে উদ্দেশ্যে আজাদীর প্রকাশনা করেছিলেন, আমরা তা এগিয়ে নেয়ার প্রত্যাশা করি।’ 

মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘মানবজমিন যখন যাত্রা করে, তখন অনেক সংশয় ছিল, এটি টিকবে কি টিকবে না। আমাদের মতো রক্ষণশীল সমাজে ট্যাবলয়েড পত্রিকা প্রকাশনা খুবই কঠিন। এ পত্রিকা একজন নারীর সম্পাদনায় শুরু হয়েছে, তিনি মাহবুবা চৌধুরী। যিনি এখনো আমাদের সঙ্গে আছেন।’

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে তিনি বলেন, ‘সংবাদপত্রের যাত্রা কঠিন, লড়াইটা আরো কঠিন। বাংলাদেশেও অনেক কিছু বলা যায়, আবার অনেক কিছুই বলা যায় না। বলতে গেলেও সমস্যা, না বললেও হয় না। সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলতে পারলেই ভালো। আইন-কানুন করে সেটা কঠিন করা হয়েছে। সংবাদপত্রকে এসব আইনের মধ্যে না রাখলে কাজ করা সহজ হয়, আমাদের হাত খুলে যায়। আমরা লিখতে পারব, না লিখলে আমাদের পাঠকরা আমাদের গ্রহণ করবেন না।’ 

প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, ‘সাংবাদিক হিসেবে আমরা এক জীবনে একটি দেশের মানুষকে জেগে উঠতে দেখলাম, রাষ্ট্রের সৃষ্টির সঙ্গে যুক্ত থাকলাম। একটি রাষ্ট্রকে নতুন করে উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে সামনে এগোতে দেখলাম। সারা বিশ্বেই এখন স্বাধীন ও দলনিরপেক্ষ সাংবাদিকতা করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের জন্যও এটা সত্য। এটি একটি কঠিন সত্য। নানা অসুবিধা ও বাধা-বিপত্তির মধ্যে স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।’ 

তিনি বলেন, ‘১৯৬২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম ধর্মঘটের স্লোগান ছিল সামরিক শাসন মানি না, গণতন্ত্র চাই, নির্বাচন চাই, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চাই, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা চাই। আজ ৬২ বছর পরও আমাদের একই দাবি করতে হচ্ছে, করে চলেছি।’ 

ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, ‘বাংলাদেশের গণমাধ্যম সাধারণত স্বাধীনতা যুদ্ধের যত মূল্যবোধ আছে, তার পক্ষের। বঙ্গবন্ধুর পক্ষের শক্তিই আমরা ধারণ করি। তার পরও এখন পর্যন্ত নয়টি আইন রয়েছে, যেগুলো সরাসরি গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে অবস্থান করে। আরো তিনটি এখন প্রক্রিয়াধীন। কিন্তু অর্থ পাচার কিংবা মাদক চোরাচালানের জন্য নয়টি আইন নেই। গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে কেন নয়টি আইন?’ 

সংবাদের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ও এমসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি নিহাদ কবির বলেন, ‘বাংলাদেশের অনেক খ্যাতিমান সাংবাদিক ও সম্পাদকের মধ্যে আমার বেড়ে ওঠার সুযোগ হয়েছে। সংবাদপত্র এখন নানা ধরনের চাপের মুখে রয়েছে। অর্থনৈতিক সংকট, সেন্সরশিপ আরোপ, অনলাইন নিউজ সাইটের সম্প্রসারণ ও ভুল নিউজের উদাহরণসহ নানামুখী চাপের মুখে রয়েছে সংবাদপত্র শিল্প। এ পরিবেশের মধ্যে আমাদের গ্রাহকদের প্রকৃত সংবাদ সরবরাহ করতে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। এ ধারা আমরা অব্যাহত রাখব।’ 

অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন এমপি, সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও শিল্পপতি তপন চৌধুরী, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন, সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, ইনকিলাব সম্পাদক এএমএম বাহাউদ্দীন, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ওমর ফারুক, প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি সৈয়দ শুকুর আলী শুভ, শেলটেক গ্রুপের চেয়ারম্যান কুতুবউদ্দিন আহমেদ, বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ, আইসিসি বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান, রামরুর সভাপতি অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী, নির্বাহী পরিচালক ড. সি আর আবরার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু আহমেদ, অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর, গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, ঢাকা ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল হাই সরকার, আইএফসি বাংলাদেশ অফিসের উপদেষ্টা খন্দকার রাশেদ মাকসুদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর মোহাম্মদ এ (রুমি) আলী, এমসিসিআই সভাপতি কামরান টি রহমান, ঢাকা চেম্বার সভাপতি আশরাফ আহমেদ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি, সৌদি আরবের রাষ্ট্রদুত ঈসা বিন ইউসুফ আল দুহাইলান, ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত ক্রিশ্চিয়ান ব্রিকস মোলার, সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত রেটো রেঙ্গলি, দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত পার্ক ইয়ং-সিক প্রমুখসহ বিভিন্ন পর্যায়ের গণ্যমান্য ব্যক্তি।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫