বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) সভাপতি মোহাম্মদ
ইমরান হোসেন অভিযোগ করেছেন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ডা. মোহাম্মদ
রেয়াজুল হক খামারিবান্ধব নন। তিনি খামারিদের কোনো সহযোগিতা করছেন না। তার কার্যক্রমে
বোঝাচ্ছেন দেশের দুধ উৎপাদনে তাদের ডাক্তার ও মিল্ক প্রসেসিং কোম্পানিগুলোই সব কাজ
করছে।
শনিবার (১ জুন) সকালে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে
তিনি এ অভিযোগ করেন।
কোরবানিতে চোরাইপথে গরু আসা বন্ধ, রেমালে ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের সহায়তা
ও গুঁড়ো দুধের শুল্ক বাড়ানোর দাবিতে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
বিডিএফএর সভাপতি মো. ইমরানের হোসেনের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন সহসভাপতি
আলী আজম শিবলী, সাধারণ সম্পাদক মো. শাহ ইমরান, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এ কে এম নাজীব
উল্লাহ, আলী আজম রহমান শিবলী, অর্থ সম্পাদক জাফর আহমেদ পাটোয়ারী প্রমুখ।
জামাল হোসেন নামে এক প্রান্তিক খামারি বলেন, আমি ডিজির সঙ্গে দেখা
করতে গেলে তিনদিন পর দেখা করার জন্য সময় দেন। গরু অসুস্থ হলে ডাক্তারদের সহযোগিতা পাওয়া
যাচ্ছে না।
মোহাম্মদপুরের আদাবরের খামারি রাশিদা বেগুন জানান, তার ২০টি গাভীর
মধ্যে ১৫টি মারা গেছে। গরু অসুস্থ হলে ডাক্তারকে ফোন দিলে ১০ হাজার টাকা চায়। একদিন
পর খামারবাড়ি থেকে ডাক্তার গেছে।
রাশেদা বেগম বলেন, গরু যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন ডাক্তারদের ফোন দিলে
১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা দিতে হবে বলে দাবি জানায়। বাধ্য হয়ে ৮ হাজার টাকা দেয়া হয়। তিনি
বলেন, ডাক্তারের সামনেই দুটি গাভী মারা গেছে। কী রোগ হয়েছিল তা জানতে তারা পরীক্ষার
জন্য আলামত নিলেও এখনো রিপোর্ট দেয়নি। আমি এখন নিঃস্ব।
এ সময় বিডিএফএ সভাপতি ইমরান হোসেন বলেন, আগে ডাক্তাররা মোটরসাইকেলে
করে আসত তাদের ২০০-৩০০ টাকা দিলেই হতো। বর্তমানে ৫০০ থেকে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। এসব ঘুস
ছাড়া সেবা পাওয়া যাচ্ছে না।
গুঁড়ো দুধের ওপর আমদানি শুল্ক বৃদ্ধির দাবি জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে
বলা হয়, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বাংলাদেশের তথ্যানুযায়ী, দেশে বছরে ১ কোটি ৫৮ লাখ ৫০
হাজার মেট্রিক টন দুধের প্রয়োজন। তবে উৎপাদন হচ্ছে ১ কোটি ৪০ লাখ ৬৮ হাজার টন। পুষ্টির
চাহিদা দেশের দুগ্ধ খামারের মাধ্যমেই সম্ভব।
বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ থাকলেও বেশ কিছু বাধার কারণে দুধের উৎপাদন বাড়ছে
না। এসব বাধা দূর করলে দেশ দুগ্ধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে। আমরা মনে করি দুধ উৎপাদনের
প্রধান বাধা আমদানিকৃত দুধ। আমদানি করা গুঁড়ো দুধ আমাদের সাংঘাতিক ক্ষতি করছে। এসব
দুধের মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। মেয়াদ উত্তীর্ণের কাছাকাছি বস্তা আকারে বাল্ক ফিল্ড মিল্ক
নামক গুঁড়ো দুধ এনে নতুন মোড়কে বাজারজাত করে জনগণের সঙ্গে প্রতারণার ঘটনা ঘটে। গুঁড়ো
দুধ আমদানির মাধ্যমে দেশের দুগ্ধ শিল্প এক ধরনের বাধার মুখে পড়েছে।
ইমরান হোসেন বলেন, গুঁড়ো দুধ আমদানিতে কঠোরতা আরোপ করে সঠিক ও কার্যকর উদ্যোগ নিলে দুই বছরের মধ্যে দুধে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারবে বাংলাদেশ। আমদানিতে অধিক হারে শুল্কারোপ করে দেশীয় কোম্পানিগুলোকে প্রতিযোগিতা সক্ষম করে তুলতে হবে। মানুষের খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে খামারিদের উৎপাদিত তরল দুধ সংগ্রহ করে দেশেই গুঁড়ো দুধ তৈরি করতে পারলে বিদেশ থেকে গুঁড়ো দুধ আমদানিতে বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয় হবে, দেশীয় শিল্প রক্ষা হবে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। নানা অজুহাতে বিদেশ থেকে বাল্ক ফিল্ড নামের গুঁড়ো দুধ আমদানি বাংলাদেশের দুগ্ধ খামার শিল্পের জন্য হুমকিস্বরূপ। শিশুখাদ্যের নামে বাল্ক ফিল্ড মিল্ক নামক গুঁড়ো দুধ আমদানি কখনোই পুষ্টির যোগান নিশ্চিত করতে পারে না। শিশুখাদ্য সেরেলাক বাংলাদেশে তৈরি হয় না।বিডিএফএ শিশু খাদ্য নয়, বাল্ক ফিল্ড মিল্ক আমদানির বিপরীতে শুল্ক বাড়িয়ে দেশীয় শিল্পকে আরো বেগবান করার আহবান জানাচ্ছে। আর ফর্মুলা দুধের শুল্ক শূন্য করে দেয়ার দাবি জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, শিশু খাদ্য হিসেবে ফর্মুলা দুধ শুল্কমুক্ত করে দেয়া হোক।
বাল্ক ফিল্ড মিল্কে কোনো ফ্যাট থাকে না। সেখানে ভেজিটেবল ফ্যাট দেয়া হয়। বেশিরভাগই
মেয়াদোত্তীর্ণ দুধ। এটা করতে আমদানিতে কোটা তৈরি, শুল্ক বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া
জরুরি।
প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমালে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার আহ্বান জানিয়ে মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, বাংলাদেশে আঘাত হানা প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’ দেশের প্রাণিসম্পদ খাতে বড় ক্ষত তৈরি করেছে। বিশেষ করে কোরবানির হাটের উদ্দেশ্যে যারা গবাদি পশু লালন করেছে তারা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে। দুর্গত অনেক এলাকায় পশুর প্রয়োজনীয় খাবার নেই। অনাহারে কিংবা পচা খাদ্য খেয়ে অনেক পশু নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। মারাও পড়ছে। চারণভূমি ডুবে যাওয়ায় পাওয়া যাচ্ছে না সবুজ ঘাস। ১৯ জেলায় ১০৭টি উপজেলায় গবাদি পশু ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত হয়েছে। অন্তত ২৫ লাখ গবাদি পশু ঝড়ের কবলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন এলাকা থেকে মৃত্যুর খবর আসছে। প্লাবিত হয়েছে গবাদি পশুর ৯ হাজার ৭৫৯ একর চারণভূমি। ফলে প্রাকৃতিক খাবারের বড় ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে। এ মুহূর্তে চিকিৎসা, গরুর ঘর তৈরি করে দেয়া ও আর্থিক প্রণোদনা প্রয়োজন। খামারিদের ব্যাংক ঋণ মওকুফ করতে হবে। সহজ শর্ত ও সুদবিহীন কৃষিঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। খামারিদের ক্ষতি নিরূপণ করতে হবে দ্রুত। দক্ষিণ অঞ্চলের ছোট গরুগুলোকে ঘাস খাইয়ে প্রস্তুত করা হয়। সরকারকে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় আনতে হবে এবং গবাদি পশুর জন্য ঘাসের বিকল্প খাবারের ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকারি ডাক্তাররা পশুখামারিদের কোনো সহায়তা করছে না। সরকার প্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সেখানকার সমস্যা দ্রুত সমাধান করা হোক। সরকারকে আপদকালীন খাদ্যের (সাইলেজ) ব্যবস্থা করতে হবে। অনেকের গরু মারা গেছে। তাদের ঋণ মওকুফ করতে হবে। খামারিদের ঘর তৈরি করে দিতে হবে।
চোরাইপথে গরু আসছে অভিযোগ করে সংবাদ সম্মেলনে ইমরান হোসেন বলেন, ২০১৪
সালে ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেখান থেকে বাংলাদেশে গরু আসা বন্ধ করে দেয়।
চাহিদা মেটানোর জন্য বাংলাদেশে গবাদি পশুর লালন-পালন বেড়ে যায়। আর সেটাই এখন বাংলাদেশকে
স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছে। একদিকে কয়েক বছর ধরে গবাদি পশু আমদানি বন্ধ, অন্যদিকে কোরবানির
ঈদে প্রতিবছর উদ্বৃত্ত থাকে ২০ লাখের বেশি পশু। এবারো চাহিদার চেয়ে ২৩ লাখ বেশি পশু
প্রস্তুত আছে।
তবু ঈদুল আজহা সামনে রেখে নানা কৌশলে ভারত ও মিয়ানমার সীমান্ত গলিয়ে
ঢুকছে গরু-মহিষ। কিছু সীমান্তে কড়া নজরদারি থাকলেও বেশ কয়েকটি এলাকা দিয়ে অন্য বছরের
চেয়ে বেশি পশু ঢুকছে এবার। কখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে, আবার
কখনো প্রশাসনের সঙ্গে যোগসাজশে আনা হচ্ছে গরু। চোরাপথে আসা এসব পশু বিক্রি হচ্ছে প্রকাশ্যে,
রীতিমতো সীমান্ত এলাকায় হাট বসিয়ে। এসব হাট থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে
পড়ছে পশু। কোরবানি উপলক্ষে ভারত ও মিয়ানমার থেকে গরু আসবে না- সরকারের এমন ঘোষণায় আশায়
বুক বেঁধেছিলেন দেশী খামারিরা। এখন সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে গরু ঢোকায় লোকসানের শঙ্কায়
তারা নিরাশ। এমন পরিস্থিতিতে সীমান্ত পথে গরু আসা বন্ধে কঠিন নজরদারি করতে হবে।
এ সময় কুমিল্লার খামারি সজীব হোসেন বলেন, কক্সবাজারের উখিয়া সীমান্ত
দিয়ে মিয়ানমারের অসুস্থ গরু আমদানি হচ্ছে। এসব গরু লবণপানি ও খড় ছাড়া কিছুই খায় না।
এসব গরু আমদানি করে দেশীয় গবাদিপশুকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়া হয়েছে।