উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব রাখছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি

বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম সহনীয় পর্যায়ে না রাখলে মূল্যস্ফীতি আরো চড়াও হবে

প্রকাশ: জুন ০১, ২০২৪

উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে নাভিশ্বাস উঠেছে সাধারণ মানুষের। টানা ২২ মাস ধরে মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের ওপরে। খাদ্য এবং খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ও সেবা খাতের পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে মূল্যস্ফীতি এতটা স্ফীত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে মূল্যস্ফীতির (হেডলাইন) গড় হার ছিল ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। এ মূল্যস্ফীতিতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির অবদান ছিল ৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ। গত বছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে গড় হেডলাইন মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬ শতাংশ, যেখানে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির অবদান ছিল ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ।

দেশে গত দুই বছরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বেড়েছে দফায় দফায়। এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়েছে মূল্যস্ফীতিতে; খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূতসহ সব ধরনের পণ্য ও সেবার উৎপাদন খরচ বেড়েছে। উৎপাদন ব্যয় বাড়ায় দ্রব্যের দামও বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সম্প্রতি আবার জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। এছাড়া গ্যাসের দামও গ্রাহক পর্যায়ে গত দুই বছরে বাড়ানো হয়েছে দুবার। আর শিল্প খাতে ক্যাপটিভে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম চলতি বছরে দুই দফা বাড়ানো হয়েছে। আবার বিদ্যুতের দাম গত বছর বেড়েছে তিন দফা। এরপর চলতি বছরের মার্চে তা আরো এক দফা বাড়ানো হয়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দামের এ ঊর্ধ্বমুখিতা চলমান থাকলে কখনই উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টানা যাবে না, বরং এ শোচনীয় অবস্থা্ আরো চড়াও হবে। এরই মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে আবাসন ও শিল্প খাতে নানা সংকট দেখা দিয়েছে। যেহেতু দৈনন্দিন জীবন ও উৎপাদন ব্যবস্থা এ উপকরণের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তাই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখা অত্যন্ত জরুরি। এক্ষেত্রে সরকারকে আরো বিবেচক হতে হবে। 

সরকারি ভাষ্যমতে, বিদ্যুৎ খাতে অপ্রতিহত লোকসান এবং ভর্তুকি কমাতে দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে এবং সে মোতাবেক কাজ পরিচালিত হচ্ছে। গত বছর তিন দফা খুচরা পর্যায়ে মোট ১৫ শতাংশের কিছু বেশি দাম বাড়ানো হয়। এছাড়া ২০২২ সালের নভেম্বরে পাইকারি পর্যায়ে দাম বাড়ানো হয় মোট ২৯ দশমিক ৫৯ শতাংশ। এক বছরের মাথায় এ বছরের মার্চে আবারো বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। এক্ষেত্রে গ্রাহক পর্যায়ে প্রতি ইউনিটের দাম বেড়েছে গড়ে সাড়ে ৮ শতাংশ, যা কার্যকর হয়েছে গত ফেব্রুয়ারি থেকেই। বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি একেবারে উঠিয়ে দিলে দাম সর্বোচ্চ ৮০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। এছাড়া বলা হচ্ছে, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, জীবনযাত্রার ব্যয় এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শ মেনেই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি প্রদান থেকে পর্যায়ক্রমে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। ভর্তুকির চাপ এড়াতে ২০২২ সালের আগস্টে গড়ে ৪২ শতাংশ বাড়ানো হয় জ্বালানি তেলের দাম। গ্যাসের দামও গত দুই বছরে কয়েক দফায় বাড়ানো হয়েছে।

বণিক বার্তার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ২০২৩ সালজুড়ে গড়ে ৯ শতাংশে ছিল। এর এক-চতুর্থাংশই এসেছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যস্ফীতির কারণে। পাশাপাশি রেস্টুরেন্ট, হোটেল, বিনোদন কার্যক্রম, স্বাস্থ্য ও ব্যক্তিগত সেবা এখানে ভূমিকা রেখেছে। ২০২৪ পঞ্জিকাবর্ষের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকেও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল ঊর্ধ্বমুখী, যার হার ৯ দশমিক ৩ শতাংশ। এক্ষেত্রে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। এছাড়া রেস্টুরেন্ট, তামাক, গহনা, ভ্রমণসংশ্লিষ্ট পণ্যও এখানে অবদান রেখেছে। গত মার্চে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোয় ওই মাসে মূল্যস্ফীতিতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের অবদান ২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ২ দশমিক ৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

এ কথা অনস্বীকার্য যে টাকার অবমূল্যায়ন, ডলার সংকট ও ডলারের দরবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির প্রভাবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দামও বেড়েছে। তবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির চলমান সংকটগুলো দূর করবে না, উল্টো সংকটগুলোকে আরো তীব্র করে তুলবে। 

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, জ্বালানি আমদানির জন্য ২০২২-২৩ অর্থবছরে অতিরিক্ত ১৩ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়। এছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বহুগুণে বেড়ে গেছে, কিন্তু বিপরীতে সক্ষমতা কমেছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্যানুযায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ টাকা ৮৬ পয়সা। ফলে দিন দিন পিডিবির অর্থ সংকটও তীব্র হচ্ছে। আবার গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বড় অংশ বসে থাকায় বিদ্যুৎ চাহিদা ও উৎপাদনে অন্তত আড়াই থেকে তিন হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং করতে হয়েছে বিতরণ কোম্পানিগুলোকে। এসব বিবেচনায় পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো ব্যতীত ভিন্ন পথ অবলম্বন করা মুশকিল হলেও দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের পথ খুঁজে বের করা দরকার।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ব্যয় কমিয়ে এবং দুর্নীতি ও অপব্যয় রোধ করার মাধ্যমে ভর্তুকি থেকে সরে আসা সম্ভব। এতে দাম না বাড়িয়েও পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উৎপাদন নিশ্চিত করা সম্ভব। এছাড়া আমদানিনির্ভরতা থেকে সরে আসতে হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি এ সমস্যা দূর করতে পারে। 

আমাদের বিদ্যুৎ খাত মূলত নির্ভরশীল গ্যাসের ওপর। পরিসংখ্যান বলছে, চাহিদার তুলনায় বর্তমানে গ্যাসের উৎপাদন অতি নগণ্য। গত ১০ বছরে বড় কোনো মজুদ আবিষ্কার করা যায়নি। অর্থাৎ নতুন গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার না করে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে আমদানিনির্ভর। সঙ্গে আছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্যাপাসিটি চার্জ। যদিও বিদ্যুৎ খাতে সরকার বছরে ৪০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে থাকে। তার পরও এ সংকট কেন কিংবা এ ভর্তুকি কোথায় যায় সেটি খতিয়ে দেখা দরকার ও ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। পাশাপাশি মানুষকেও সচেতন হতে হবে জ্বালানি ব্যবহারে যেন অপচয় না হয়। 

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় উৎপাদন খাত ও রফতানি বাণিজ্য, যার প্রভাব পড়ে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দামে। কিন্তু এ সমস্যার সমাধান করতে দাম বাড়ানো আদৌ খুব বেশি সুফল বয়ে আনবে না। আশঙ্কা আছে, তা মূল্যস্ফীতিকেই উসকে দেবে। তাই দীর্ঘমেয়াদে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সমস্যা দূর করতে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে ও তা বাস্তবায়ন আবশ্যক। এ খাতের দুর্নীতি দূর করা এখন অতি আবশ্যক। এছাড়া বিদ্যুৎ সংকট সমাধানে সহায়ক হতে পারে গ্যাসের উত্তোলন বৃদ্ধি। সেক্ষেত্রে গ্যাস ক্ষেত্র অনুসন্ধানে আমাদের তৎপরতা বাড়াতে হবে। এতে বিদ্যুতের উৎপাদন যেমন বাড়ানো সম্ভব হবে, তেমনি গ্যাস সংকটও দূর হবে। তবেই হয়তো জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের লোকসান দূর হবে এবং সরকারের ভর্তুকির দায়ও কমে আসবে। এতে সাধারণ মানুষকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে কিছুটা হলেও বাঁচানো সম্ভব হবে। 


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫