গ্লকোমা

গ্লকোমা অন্ধত্বের অন্যতম কারণ

প্রকাশ: মে ২০, ২০২৪

ডা. জামসেদ ফরিদী (জামি)

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবমতে সারা বিশ্বে প্রায় সাড়ে চার কোটি লোক অন্ধ। তার মধ্যে ৮০ শতাংশ অন্ধত্ব নিরাময়যোগ্য। কিন্তু গ্লকোমাজনিত অন্ধত্বের কোনো প্রতিকার নেই, প্রতিরোধই একমাত্র উপায়। অন্ধত্ব একটি অভিশাপ। তাই এ গ্লকোমাজনিত অন্ধত্ব সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান সবার থাকা প্রয়োজন। বিশ্বে গ্লকোমাজনিত অন্ধ লোকের সংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ। এর এক বিরাট অংশ রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায়। গ্লকোমা রোগ সম্পর্কে সচেতনতার অভাবে এক বিরাট জনগোষ্ঠী অপরিবর্তনযোগ্য অন্ধত্বের শিকার হয়, যা প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয় করতে পারলে প্রতিরোধ করা সম্ভব।

গ্লকোমা

অধিকাংশ সময় চোখের অভ্যন্তরীণ তরলের চাপ বাড়ার কারণে গ্লকোমা চোখের একটি জটিল রোগ হিসেবে আবির্ভূত হয়, যাতে চোখের স্নায়ু (অপটিক নার্ভ) ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ধীরে ধীরে চোখের দৃষ্টি কমে যায়। এমনকি এতে একসময় রোগী অন্ধত্ব বরণ করতে বাধ্য হয়। তবে সময়মতো চিকিৎসা করলে এ অন্ধত্বের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

গ্লকোমা সম্পর্কে জানা জরুরি কেন?

 পৃথিবীব্যাপী এবং আমাদের দেশে অন্ধত্বের দ্বিতীয় প্রধান কারণ হলো চোখের গ্লকোমা। 

 বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ রোগের লক্ষণ রোগী বুঝতে পারে না বা পারার আগেই চোখের স্নায়ু অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

 এ রোগে কেন্দ্রীয় দৃষ্টিশক্তি অনেক দিন ঠিক থাকে কিন্তু দৃষ্টির পরিসীমা বা ব্যাপ্তি ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আসে বিধায় রোগী তার রোগের ব্যাপারে সতর্ক থাকে না বলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে অনেক দেরি করে ফেলে।

 গ্লকোমা চোখের অনিরাময়যোগ্য অন্ধত্ব তৈরি করে। তাই একবার দৃষ্টি যতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তা আর কখনো ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।

 চোখের গ্লকোমা রোগ হলে রোগীকে নিয়মিত বিরতিতে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকতে হয়। অনেকেই শেষ পর্যন্ত চিকিৎসকের সংস্পর্শে থাকে না বা ঠিকমতো ওষুধ ব্যবহার করে না। ফলে এ রোগ নীরবে ক্ষতি করে রোগীকে অন্ধত্বের দিকে নিয়ে যায়।

কারণ

এ রোগের সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ অদ্যাবধি খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে চোখের অভ্যন্তরীণ তরলের চাপ বাড়াই এ রোগের প্রধান কারণ বলে ধরে নেয়া হয়। তবে চোখের অভ্যন্তরীণ তরলের স্বাভাবিক চাপেও এ রোগ হতে পারে।

সাধারণত চোখের অভ্যন্তরীণ তরলের চাপ বাড়ার কারণে ধীরে ধীরে চোখের স্নায়ুকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং দৃষ্টি ব্যাহত করে। তবে কিছু কিছু রোগের সঙ্গে এ রোগের গভীর সম্পর্ক লক্ষ করা যায় এবং অন্যান্য কারণেও এ রোগ হতে পারে। যেমন—

 পরিবারের অন্য কোনো নিকটাত্মীয়র (মা, বাবা, দাদা,  দাদি, নানা, নানি, চাচা, মামা, খালা, ফুপু) এ রোগ থাকা

 ঊর্ধ্ব বয়স (চল্লিশ বা তদূর্ধ্ব)

 ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ

 মাইগ্রেন নামক মাথাব্যথা

 রাত্রিকালীন উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ সেবন

 স্টেরয়েড নামক ওষুধ দীর্ঘদিন সেবন

 চোখের ছানি অপারেশন না করলে বা দেরি করলে

 চোখের অন্যান্য রোগের কারণে

 জন্মগত চোখের ত্রুটি ইত্যাদি

এগুলোর মধ্যে কেবল চোখের উচ্চ চাপই ওষুধ দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, যা গ্লকোমা রোগের প্রধান কারণ বলে মনে করা হয়।

লক্ষণ

অনেক ক্ষেত্রেই রোগী এ রোগের কোনো লক্ষণ অনুধাবন করতে পারে না। চশমা পরিবর্তনের সময় কিংবা নিয়মিত চক্ষু পরীক্ষার সময় হঠাৎ করেই চিকিৎসক এ রোগ নির্ণয় করে থাকেন। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিম্নের লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে। যেমন—

ঘন ঘন চশমার গ্লাস পরিবর্তন হওয়া।

চোখে ঝাপসা দেখা বা আলোর চারপাশে রংধনুর মতো দেখা।

ঘন ঘন মাথাব্যথা বা চোখে ব্যথা হওয়া।

দৃষ্টিশক্তি ধীরে ধীরে কমে আসা বা দৃষ্টির পারিপার্শ্বিক ব্যাপ্তি কমে আসা। অনেক সময় চলতে গিয়ে দরজার পাশে বা অন্য কোনো পথচারীর গায়ে ধাক্কা লাগা।

মৃদু আলোতে কাজ করলে চোখে ব্যথা অনুভূত হওয়া।

গ্লকোমার জন্য কাদের চক্ষু পরীক্ষা করা জরুরি?

 যাদের পরিবারে নিকটাত্মীয়র এ রোগ আছে।

 চল্লিশোর্ধ্ব প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক, বিশেষ করে যাদের ঘন ঘন চশমা পরিবর্তন করতে হচ্ছে।

 চোখে যারা মাঝে মাঝে ঝাপসা দেখে বা ঘন ঘন চোখ ব্যথা কিংবা বা লাল হওয়া অনুভব করে।

 যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, মাইগ্রেন ইত্যাদি রোগ আছে।

 যারা চোখে দূরের জন্য মাইনাস গ্লাস ব্যবহার করে।

চিকিৎসা

গ্লকোমা রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব, কিন্তু নিরাময় সম্ভব নয়। ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপের মতো এ রোগের চিকিৎসা সারা জীবন করে যেতে হবে। এ রোগে দৃষ্টি যতটুকু কমেছে তা আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তবে দৃষ্টি যাতে আর কমে না যায় তার জন্য আমাদের চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে।

এ রোগে প্রচলিত তিন ধরনের চিকিৎসা রয়েছে—

 ওষুধের দ্বারা চিকিৎসা

 লেজার চিকিৎসা

 শল্য চিকিৎসা বা সার্জারি

রোগীর করণীয়

চিকিৎসক রোগীর চক্ষু পরীক্ষা করে তার চোখের চাপের মাত্রা নির্ণয় করে তা নিয়ন্ত্রণের জন্য যে ওষুধের মাত্রা নির্ধারণ করে দেবেন তা নিয়মিত ব্যবহার করা।

 দীর্ঘদিন একটি ওষুধ ব্যবহারে এর কার্যকারিতা কমে যেতে পারে বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যেতে পারে। তাই নিয়মিত বিরতিতে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া।

সর্বোপরি মনে রাখতে হবে, এটি ডায়াবেটিস, প্রেসারের মতো সমগ্র জীবনের চিকিৎসা। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ঠিকমতো ওষুধ ব্যবহার করলে ও নিয়মাবলি মেনে চললে একজন গ্লকোমা রোগী তার স্বাভাবিক দৃষ্টি নিয়ে বাকি জীবনটা সুন্দরভাবে অতিবাহিত করতে পারে।

পরিশেষে বলা যায়, মনে রাখতে হবে গ্লকোমা অন্ধত্বের অন্যতম কারণ, যার কোনো প্রতিকার নেই। প্রতিরোধই গ্লকোমা অন্ধত্ব নিরাময়ের একমাত্র উপায়। চল্লিশোর্ধ্ব বয়সে নিয়মিত বিরতিতে চক্ষু চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে আপনার চক্ষু পরীক্ষা করিয়ে চোখের চাপ জেনে নিন এবং অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হোন আপনার বা পরিবারের কারো গ্লকোমা আছে কিনা। 

লেখক: আবাসিক সার্জন, শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান, গোপালগঞ্জ

ই-মেইল: [email protected]


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫