দুঃসহ স্মৃতি পেরিয়ে দেশে ফিরে উচ্ছ্বসিত এমভি আবদুল্লাহর নাবিকরা

প্রকাশ: মে ১৫, ২০২৪

রাশেদ এইচ চৌধুরী I চট্টগ্রাম ব্যুরো

বেলা ২টা থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে অপেক্ষা করছিলেন এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের চতুর্থ প্রকৌশলী তানভীর আহমদের মা জ্যোৎস্না বেগম। বিকাল ৪টায় ছোট জাহাজ ‘জাহান মনি’ এসে নোঙর ফেলে বন্দরের এনসিটি জেটিতে। জাহাজ থেকে নামার পর ছেলেকে জড়িয়ে ধরেন মা। আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন, ‘ফিরে এসেছিস বাবা। আমার আর কষ্ট নেই।’

সোমালীয় জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার এক মাস পর গতকাল বিকাল ৪টায় চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনালে এসে পৌঁছেন ২৩ নাবিক। জাহাজ থেকে নামামাত্র জড়িয়ে ধরেন কারো মা, কারো বাবা, ভাই, বোন কিংবা সন্তানেরা।

জ্যোৎস্না বেগমের ছেলে তানভীর আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জলদস্যুদের আচরণ ছিল খুবই ভয়ংকর। বন্দিত্ব থেকে মুক্ত হলেও রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারিনি। আজকের মুহূর্তটার জন্যই অপেক্ষায় ছিলাম। মায়ের বুকে মাথা রেখেছি। এর চেয়ে বড় আনন্দ আর কী হতে পারে?’

গতকাল জাহাজ তীরে পৌঁছার আগেই দুই হাত নেড়ে অভিবাদন জানানো হয় নাবিকদের। এ সময় কারো হাতে ছিল ফুল, কারো হাতে কেক, কারো হাতে আবার বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা।

আরেক নাবিক আইনুল ইসলাম জাহাজ থেকে নামামাত্র মা লুৎফে আরা বেগম সন্তানকে জড়িয়ে ধরেন। মা বলেন, ‘‌জিম্মিদশা থেকে প্রায় এক মাস আগে মুক্ত হয়েছে ছেলে। সেলফোনে যোগাযোগও হয়েছে অনেকবার। কিন্তু তার পরও কেন যেন মনে ভয় কাজ করছিল। যত যা-ই হোক, ছেলেকে বুকে জড়িয়ে না ধরা পর্যন্ত কোনোভাবে স্বস্তি পাচ্ছিলাম না।’

এমভি আবদুল্লাহর প্রধান কর্মকর্তা ছিলেন আতিকুল্লাহ। দুই মেয়েকে নিয়ে স্বামীকে বরণ করতে এসেছেন স্ত্রী মিনা আজমিন। জাহাজ থেকে নেমেই দুই মেয়ে ইয়াশরা ফাতেমা ও উনাইজা মেহবিনকে বুকে টেনে নেন বাবা। একের পর এক চুমুতে বাবার দুই গাল ভরিয়ে দেয় মেয়েরা। মেয়ে ইয়াশরা ফাতেমা বলে, ‘‌আজ আমাদের শুধুই আনন্দের দিন। বাবাকে নিয়ে এখন শুধু ঘুরব।’

এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের চিফ কুক শফিকুল ইসলাম। সোমালিয়ার দস্যুরা যখন জাহাজটি জিম্মি করেছিল তখন সন্তানসম্ভবা ছিলেন শফিকুল ইসলামের স্ত্রী সাজিয়া আলম। জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার দুদিন পর কন্যাসন্তানের বাবা হন তিনি। মেয়ের নাম রাখা হয় রাফিয়া ইসলাম রাফা। এছাড়া জাহাজটি ছিনতাই করার সময় শফিকুলের মা অসুস্থ ছিলেন। মা যাতে দুশ্চিন্তা না করেন সেজন্য ঘটনাটি আড়াল করে রাখা হয় পরিবারের পক্ষ থেকে। চট্টগ্রামের সিমেন্ট ক্রসিং এলাকায় আরশিনগরের বাসায় শফিকুল ইসলাম ফিরলে মাকে সবকিছু জানানো হয়। তখনই ঘটে এক আবেগঘন পরিবেশের। মুক্ত জীবনে ফিরে গতকালই কন্যাকে কোলে তুলে নেন বাবা। শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘‌আজ আমার খুশির সীমা নেই।’

এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের ক্যাপ্টেন ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আব্দুর রশিদ জাহাজ থেকে নামার পরই কেএসআরএম গ্রুপের কর্মকর্তাদের জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ‘দস্যুরা জাহাজে উঠেই ব্রিজে চলে আসে। আমি আর সেকেন্ড অফিসার আমাদের হিডেন রুমেও যেতে পারিনি। সেকেন্ড অফিসার আটক হওয়ার পর আমি গিয়ে দেখি তার দিকে একে-৪৭ তাক করা। আমি যেতেই আমার দিকেও একে-৪৭ তাক করে। আমি হাত তুলে সারেন্ডার করে বললাম, আমরা বাংলাদেশী, আমরা মুসলিম। আমরা রোজা আছি। কিন্তু তারা সবাইকে ডাকতে বলে। আমি মানসিকভাবে যে পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম সেটি আবার বুঝতে দিচ্ছিলাম না। দস্যুরা সবাই চলে আসে সেখানে। আমরা সবাই সেখানেই ব্রিজের মধ্যে সারা দিন সারা রাত ছিলাম। আমাদের নাবিকদের কেউ কেউ তখন কান্নাকাটি করছিল। আমিও জীবনে প্রথম এমন পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম। চেষ্টা করতে থাকি সবাইকে হ্যান্ডল করে যেন আমাদের কোনো ক্রুর কোনো ক্ষতি না হয়। প্রথম দিন থেকেই জীবনের নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিয়েছি।’

এমভি আবদুল্লাহর নাবিক শামসুদ্দিন মোহাম্মদ বলেন, ‘ভাবতে পারেন? অর্ধশতাধিক জলদস্যুর হাতে একে-৪৭। তারা যেমনটা বলত তেমনটাই শুনতে হতো।’

নিকটাত্মীয় নূপুরের সঙ্গে আক্‌দ অনুষ্ঠান করেই এমভি আবদুল্লাহ জাহাজে উঠেছিলেন সাজ্জাদ। কথা ছিল দুবাই থেকে জাহাজে ফেরার পর হবে তাদের বিয়ের অনুষ্ঠান। কিন্তু সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়ায় পর নেমে আসে বিষাদের ছায়া। প্রতিটা মুহূর্ত কাটে উৎকণ্ঠায়। তবে এ খারাপ পরিস্থিতির অবসান ঘটেছে। সাজ্জাদের বাবা জানান, ছেলে ফিরেছে। এবার বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার পালা।

আড়াই বছরের ছেলে সাদ বিন নূরকে নিয়ে নুর উদ্দিনকে বরণ করতে এসেছিলেন স্ত্রী জান্নাতুল। বন্দরের জেটিতে নেমে ছেলেকে কোলে তুলে চুমু খান নুর উদ্দিন।

এমভি আবদুল্লাহ জাহাজটির মালিকপক্ষ কেএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহানসহ প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা নাবিকদের উষ্ণ অভ্যর্থনার মাধ্যমে বরণ করে নেন। শাহরিয়ার জাহান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ দিনটার জন্য দিন-রাত কাজ করেছি। প্রতিটা পর্যায়ে সরকারের দারুণ সহযোগিতা পেয়েছি।’

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় এ অভ্যর্থনার আয়োজন করা হয়। এ সময়ে সিটি মেয়র রেজাউল করিম, চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েলসহ বন্দরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

গত ১২ মার্চ ভারত মহাসাগর থেকে কেএসআরএম গ্রুপের এমভি আবদুল্লাহ জাহাজটি জিম্মি করেছিল সোমালিয়ার দস্যুরা। মুক্তিপণ দিয়ে ৩৩ দিনের মাথায় গত ১৩ এপ্রিল রাতে জাহাজটি মুক্ত করা হয়। এরপর জাহাজটি প্রথমে আমিরাতের আল হামরিয়া বন্দরে পৌঁছায়। সেখানে পণ্য খালাস শেষে আরেকটি বন্দর থেকে চুনাপাথর বোঝাই করে চট্টগ্রামের পথে রওনা হয়েছিল। গতকালই চট্টগ্রামে ফিরলেন নাবিকেরা।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫