গরমে সতর্কতা

হিট ক্র্যাম্পে শারীরিক অক্ষমতা বা মৃত্যুও হতে পারে

প্রকাশ: মে ০৬, ২০২৪

ডা. কিশলয় সাহা

স্বাভাবিকভাবে গরমে কিছু বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া উচিত। গরমে ঘরের বাইরে গেলে সাদা ছাতা বা ক্যাপ পরা উচিত সবাইকে। রোদ এড়িয়ে চলতে বলা হয়। শরীরের পানিশূন্যতা যাতে না হয় তার জন্য স্যালাইন, প্রচুর লিকুইড খাবার বা তরল খাবার খাওয়া লাগবে। বিশেষ করে সময় শিশু বা গর্ভবতী মায়েদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। এছাড়া যারা বাইরে যায় বা চাকরিজীবী তাদের একাধিকবার গোসল করার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়। সাধারণত সময় রঙিন কাপড় পরতে নিষেধ করা হয় এবং পাতলা সুতি পোশাক পরতে বলা হয়। সময় নিয়ম মেনে চলাটা হচ্ছে জরুরি। একদিনে তো তাপমাত্রা বদলানো যাবে না। তাই এখন সবার অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিতে হবে।

গরমে অনেক সময় দেখা যায় কেউ সামান্যতম খাবার খেলেও সমস্যা হয়। চাকরিজীবীরা সাধারণত সকালে রান্না করে বিকালে খান। কিন্তু গরমে তাপমাত্রায় খাবার নষ্ট হয়ে যায়। এতে সহজে ডায়রিয়া হয়। বিশেষ করে বাচ্চাদের/ বড়দেরও হতে পারে। অসুস্থ ব্যক্তিদের। যে কারো ডায়রিয়া হতে পারে। এজন্য খাবার স্যালাইনটা ঘরের কাছে রাখা। বাড়িতে রাখা। প্রয়োজনে খাবার পানি সেটা সঙ্গে নিয়ে যাওয়া। কয়েক প্যাকেট স্যালাইনও সঙ্গে রাখা। এছাড়া চিড়ার পানি, ডাবের পানি খাওয়া। তাছাড়া মসুরের ডাল রান্না করে ডালের পানিটা খাওয়া যায়।

ছোট বাচ্চাদের যারা বুকের দুধ খায়, অন্য খাদ্য খেতে পারে না, তাদের ভাতের মাড় দেয়া যায়। চালের গুঁড়ো দিয়ে জাউ রান্না করে দেয়া যায়। বুকের দুধ তো খাবেই, তবে ডায়রিয়া যদি বেশি হয় তাহলে অবশ্যই নিকটস্থ হাসপাতালে নেয়া লাগবে।

তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়াকে হাইপারথাইমিয়া বলা হয়। এটাকে হিট ক্র্যাম্প বা হিট এক্সেশন বলা হয়। যখন অতিরিক্ত গরমে শরীরের তাপ নির্গমনের চেয়ে উত্তোলন বেশি হয়, তখন শরীরের তাপমাত্রা অনেক বেশি হয়ে যায়। এটার জন্য যদি দ্রুতগতিতে চিকিৎসা না দিই তাহলে শারীরিক অক্ষমতা বা মৃত্যুরও কারণ হতে পারে। এটা হিট ক্র্যাম্প বা হিট এক্সেশনের জন্য হতে পারে।

হিট ক্র্যাম্প বোঝার উপায়

অতিরিক্ত গরমে যখন শরীরের অঙ্গ বা পেশি পানিশূন্য হয়ে যায় তখন শরীরের চর্বি ইত্যাদি সেল থেকে পানি টেনে নেয়। তখন শরীরের রক্তচাপ বজায় রাখার জন্য আমাদের হার্টবিট অনেক বেড়ে যায়।

সময় রোগী খুব ক্লান্ত বোধ করবে, অত্যধিক ঘামবে, হালকা মাথা ব্যথা, মাথা ঘোরা বা ক্ষুধামান্দ্য হতে পারে। রকম লক্ষণ দেখা দেয়। এখানে একটা জরুরি জিনিস হচ্ছে অত্যধিক ঘাম হওয়া। ধরনের লক্ষণ দেখা দিলে সরাসরি ব্যক্তিকে রোদ থেকে ছায়ায় নিয়ে যাওয়া লাগবে। ঠাণ্ডা, ভেজা তোয়ালে বা গামছা স্বাভাবিক পানিতে ভিজিয়ে ব্যক্তির শরীর মুছে দিতে হবে। একটু ঠাণ্ডা পানি খাবার খেতে হবে। শরীর থেকে অতিরিক্ত কাপড়-চোপড় সরিয়ে নিতে হবে। গরম বা ভারী খাবার যেমন বিরিয়ানি, বার্গার, ফাস্টফুড এড়িয়ে চলতে হবে।

একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে, রকম রোগীকে কখনো মাথায় ঠাণ্ডা পানি ঢালা বা সরাসরি ঠাণ্ডা পানিতে ডুবিয়ে দেয়া যাবে না, তাহলে হিতে বিপরীত হবে।

আরেকটা ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে হিট স্ট্রোক, যখন হিট ক্র্যাম্প বা হিট এক্সেশনটা দীর্ঘমেয়াদে চলতে থাকে অর্থাৎ সে যদি তখন কোনো প্রাথমিক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে, তাহলে তার শরীরে ঘামের সঙ্গে সঙ্গে লবণগুলো অর্থাৎ ইলেকট্রোলাইট কমে যাবে। তখন রোগী ধীরে ধীরে অচেতনের দিকে যাবে এবং একসময় অজ্ঞান হয়ে যাবে। এর ঠিক আগ মুহূর্তে রোগীর প্রচণ্ড মাথাব্যথা থাকবে। হিট ক্র্যাম্পে বলা ছিল সামান্য মাথাব্যথা হবে, এখানে প্রচণ্ড মাথাব্যথা হবে। হিট ক্র্যাম্পে বলা ছিল প্রচণ্ড ঘামবে, তবে এখানে একদমই ঘাম হবে না। তবে রোগী বমি করতে পারে। গায়ের চামড়া লাল হয়ে যাবে কিন্তু শরীর শুকনা থাকবে এবং রোগী অজ্ঞান হয়ে যাবে।

হিট স্ট্রোকের চিকিৎসা

রকম রোগীর দীর্ঘমেয়াদে যদি অচেতন হয়ে থাকে তবে তার মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল কমে যাবে। যেটা কম হওয়ার জন্য মস্তিষ্কে একটা স্থায়ী ক্ষতি হবে। শরীরের যেকোনো একটা অঙ্গহানি হয়ে যেতে পারে। এজন্য এটাকে বলা হয়ে থাকে স্ট্রোক। গরম আবহাওয়া দ্রুত শীতলীকরণ হিসেবেও বলা যায়। অবস্থায় একজন চিকিৎসক বা রোগের সঙ্গে জড়িত কারো শরণাপন্ন হওয়া লাগবে। সম্ভব হলে ওই ব্যক্তিকে ছায়ায় নিয়ে যাওয়া লাগবে, কাপড় যতটুকু পারা যায় তা খুলে নিতে হবে।

তবে মাথায় পানি ঢালা যাবে না। ঘাড়ের নিচ থেকে পানি ঢালতে হবে। সেটার তাপমাত্রা হতে হবে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যতটা সম্ভব পানি আমরা ব্যবহার করতে পারি। প্রায় ৪০ থেকে ৮০ লিটার পানি ঢালা যাবে। অতি দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে এবং প্রয়োজনে শিরায় স্যালাইন দিতে হবে।

গরমে আরেকটি রোগের প্রকোপ বেশি তাকে, তা হলো জন্ডিস। জন্ডিসকে চিকিৎসাশাস্ত্রে হেপাটাইটিস বলা হয়। পানি খাবারবাহিত জন্ডিস যেটা হয় সেটা দুইটা ভাইরাস থেকে হয়। একটা হেপাটাইটিস  হেপাটাইটিস ই। হেপাটাইটিস বি  সি লিভারে ক্ষতি করে। এটা মূলত খাবার পানির মাধ্যমে ছড়ায়। গরমে অনেক সময় দেখা যায়, অনেক রাস্তাঘাট থেকে শরবত খায়, রাস্তাঘাট থেকে পানি খায়, বাইরের হোটেলে খাবার খায়, যেটা ভোরবেলা রান্না করা হয়। এগুলোর মাধ্যম ভাইরাস ছড়ায়। ভাইরাস ছড়ানোর ছয়-সাতদিন পর হালকা জ্বর জন্ডিস দেখা দেয়। সেটা আবার ঠিকও হয়ে যায়। এটা ঠিক হতে দুই-তিন সপ্তাহ সময় লাগে। কারো কারো ক্ষেত্রে বেশি সময় লাগে। বাচ্চাদের গর্ভবতী মায়েদের যদি হেপাটাইটিস ই সংক্রান্ত জন্ডিস হয়, সে অবস্থায় শিশু যদি জন্ম নেয়, তাহলে মা শিশুর অবস্থা আশঙ্কাজনক থাকে। শিশুর মৃত্যুঝুঁকিও থাকে। নরমাল ডেলিভারি তখন করা সম্ভব হয় না। আবার প্রাইমারি লেভেলের হাসপাতালগুলোয়ও রোগীর ডেলিভারি করা সম্ভব হয় না। তখন তাদের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেয়া লাগে। মায়েরও মৃত্যুঝুঁকি থাকে। তাই সময়ে বাইরের খাবার যতটুকু সম্ভব এড়ানো উচিত। খাবারের পানিও ঘর থেকে নিয়ে যাওয়া উচিত। কোনোভাবে খোলা জায়গার খাবার-পানি খাওয়া যাবে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যেকোনো সময় ইমার্জেন্সি কল দেয়া যায়। সেখানকার নির্দিষ্ট কিছু নাম্বার আছে। তাছাড়া স্থানীয় সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদেরও হটলাইন নাম্বার আছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হটলাইনের নাম্বার হচ্ছে ১৬২৬৩। এখানে জরুরি প্রয়োজনে যেকোনো সেবা চাইলে তারা দেবে।

যারা নিয়মিত বাইরে যায় তাদের প্রতি নির্দেশনা হচ্ছে হালকা সুতির কাপড় পরা, ছাতা, পানি রাখা। বাসা থেকে পানি খাবার স্যালাইন নিয়ে যাওয়া। একাধিকবার গোসল করা। ভারী খাবার এড়ানো। মৌসুমি ফল, শাকসবজি খাওয়া। চোখে রোদচশমা বা সানগ্লাস ব্যবহার করা। আর যাদের চর্মরোগ আছে বা ত্বক পোড়ায় তাদের সানক্রিম ব্যবহার করতে হবে।

লেখক: উপজেলা স্বাস্থ্য পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, গোয়াইনঘাট, সিলেট


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫