যেভাবে শুরু হলো এসির ব্যবহার

প্রকাশ: এপ্রিল ৩০, ২০২৪

মুহম্মদ আল মুখতাফি

এয়ার কন্ডিশনার বা এসির গল্প শুরু হয় মূলত খাবার সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা থেকে। সাধারণ তাপমাত্রায় রাখা খাবার ব্যাকটেরিয়ার কারণে সহজে নষ্ট হয়ে যায়। তবে তাপমাত্রা কমিয়ে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ৪০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের নিচে নিয়ে যেতে পারলে ব্যাকটেরিয়ার আশঙ্কা কমে যায়। ১৮২৪ সালে আবিষ্কার হয় রেফ্রিজারেশনের নীতি। ফলে তরল অ্যামোনিয়া বাষ্পীভবনের মাধ্যমে বাতাসকে শীতল করা সম্ভব হয়। এ নীতির আবিষ্কার অনেক দিক দিয়েই বৈপ্লবিক ছিল। এর ওপর ভর দিয়েই ১৮৪২ সালে জন গরি নামের একজন চিকিৎসক কম্প্রেসর ব্যবহার করে রেফ্রিজারেটর তৈরি করেন। ১৯৪০ সাল থেকেই পদার্থবিদ ও চিকিৎসক জন গরি উচ্চ তাপমাত্রা থেকে নগরবাসীকে বাঁচাতে ফ্লোরিডার শহরগুলোকে শীতল করার ধারণা প্রস্তাব করেন। তার মত ছিল, ম্যালেরিয়ার মতো রোগ নিরাময়ের একমাত্র সমাধান হতে পারে শীতলীকরণ পদ্ধতি। কৃত্রিম শীতলীকরণ পদ্ধতির ধারাবাহিকতায় জন গরি কমপ্রেসর ব্যবহার করে রেফ্রিজারেটর তৈরি করলেও পেটেন্ট নিতে ব্যর্থ হন।

আধুনিক এসি বলতে যা বোঝানো হয়, তার জনক হিসেবে আলোচনায় সর্বপ্রথম আসে আমেরিকান প্রকৌশলী হ্যাভিল্যান্ড ক্যারিয়ারের নাম। ১৯০২ সালে তিনি প্রথম বৈদ্যুতিক এয়ার কন্ডিশনার আবিষ্কার করেন। এসিটি মূলত তৈরি হয়েছিল শিল্প ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য। হ্যাভিল্যান্ড ছাপাখানায় কাজ করতেন। সেখানকার বাতাসের আর্দ্রতা ও তাপমাত্রার কারণে ঠিকঠাক কাজ করা সম্ভব হচ্ছিল না। উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য মূলত এ যন্ত্রের নকশা করা হয়েছিল। ছাপা কাগজের আকার ও কালির যথার্থ ব্যবহার ঠিক রাখতে বাতাসের আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ দরকার ছিল। এসি ব্যবহার শুরু হয়েছিল এভাবেই। ১৯০৬ সালে হ্যাভিল্যান্ড তার আবিষ্কৃত এসির জন্য আমেরিকান সরকারের পেটেন্ট পান। এর আগে বেশকিছু বছর কৃত্রিম শীতলীকরণ ব্যবস্থার কাজ বন্ধ ছিল। হ্যাভিল্যান্ডের এ আবিষ্কারের পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯১৫ সালে ক্যারিয়ার ও ছয় প্রকৌশলী মিলে বিশ্বের বৃহত্তম এসি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ক্যারিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন প্রতিষ্ঠা করেন। তার প্রতিষ্ঠানের প্রচেষ্টার মধ্য দিয়েই ১৯২৬ সালে আবাসিক গৃহে এসির ব্যবহার শুরু হয়। 

তবে তখনো একটা সীমাবদ্ধতা কাটেনি। এসিতে ব্যবহৃত হতো অ্যামোনিয়া, প্রপেন ও মিথাইল ক্লোরাইডের মতো বিষাক্ত গ্যাস। ফলে বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত ছিলেন অনেকেই। এর সমাধান নিয়ে ১৯২৮ সালে এগিয়ে আসেন টমাস মিগলি জুনিয়র। তিনি ফ্রেয়ন আবিষ্কারের মাধ্যমে আবাসিক, শিল্প ও বাণিজ্যিক কাজে মানুষের জন্য নিরাপদ এসি ব্যবহার সহজ করেন। এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। ১৯৩০ সালে হোয়াইট হাউজ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত করা হয়। পাশাপাশি পরিবর্তন আসে আকারেও। ক্যারিয়ারের উদ্ভাবিত এসি এতটাই বিশাল ছিল যে এটি রাখতে একটা পৃথক ঘরের প্রয়োজন হতো। ফলে বড় বড় কারখানা ছাড়া এসি তেমন একটা ব্যবহার করা যেত না। ১৯৪৫ সালে রবার্ট শেরম্যান পোর্টেবল এসি আবিষ্কার করেন, যা জানালার পাশে রেখে ব্যবহার করা যেত। এ এসি ঘরের বাতাসকে ফিল্টার করার পাশাপাশি গরমের দিনে ঘর ঠাণ্ডা রাখত এবং শীতের দিনে ঘর গরম রাখত। 

১৯৫০ সালের ৭ অক্টোবর হ্যাভিল্যান্ড ক্যারিয়ার মারা গেলেও থেমে থাকেনি ক্যারিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং। চলতে থাকে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ১৯৪৬ সাল থেকেই বাণিজ্যিকভাবে এসি উৎপাদনের চাহিদা বাড়ে। সে বছর ৩০ হাজার এসি উৎপাদন হয়। ১৯৫৩ সালে তা ছাড়িয়ে যায় ১০ লাখ। এরপর প্রতি বছরই উৎপাদন বেড়েছে কম-বেশি। যুক্ত হয়েছে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন। নতুন ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবন নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে এসি। আন্তর্জাতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে সেই প্রযুক্তি বিশ্বের বহু দেশ কম-বেশি গ্রহণ করেছে। ১৯৭৯ সালে আমেরিকার ‘ইউনাইটেড টেকনোলজিস’ ক্যারিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং কিনে নিলেও ব্র্যান্ডের নাম বদলানো হয়নি। ১৭০টি দেশে ক্যারিয়ার এসি বাজারজাত করে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৭৫ শতাংশ বাড়িতে এয়ার কন্ডিশনার রয়েছে। বাংলাদেশেও বিভিন্ন ব্র্যান্ডের এসি পাওয়া যাচ্ছে কম মূল্যে। বাড়ছে এসি ব্যবহারকারীর সংখ্যা। এভাবে গত দুই শতকের নানা পরিবর্তন ও বিচিত্র গল্প নিয়ে বর্তমান দুনিয়ার অনিবার্য অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে এসি।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫