ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থী

বাবার অনুপ্রেরণায় প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন বুনেছেন দীপংকর

প্রকাশ: এপ্রিল ২২, ২০২৪

নাঈম আহমদ শুভ

রাঙ্গামাটির লংগদু উপজেলায় কাট্টলী গ্রামে জন্ম দীপংকর চাকমার। বর্তমানে অধ্যয়ন করছেন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি)। ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের ভর্তি হন। পড়ালেখায় এতদূর আসতে তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে শত প্রতিকূলতা। তবুও দমে যাননি তিনি। 

পড়াশোনা করতে অনেক প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলা করতে হচ্ছে দীপংকরকে। তবে ছোটবেলা থেকেই তার বাবা দিয়েছেন উৎসাহ, অনুপ্রেরণা ও সমর্থন। স্বপ্ন দেখাতেন ডাক্তার, প্রকৌশলী কিংবা বিসিএস ক্যাডার হওয়ার। দীপংকরের বাবা সব সময় বলতেন, ‘‌ইচ্ছা থাকলে যেকোনো কিছু হওয়া সম্ভব।’ অবশেষে বাবার অনুপ্রেরণায় প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন বুনে দীপংকর এগিয়ে যাচ্ছেন স্বপ্ন পূরণের পথে।  

দীপংকর তার প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন কাট্টলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পরে কাট্টলী উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে ভর্তি হন বরুণা ছড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে এসএসসি পাস করে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন ঢাকার মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজে। কলেজের পাঠ চুকিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেন দীপংকর। পরিবারের আর্থিক অবস্থা শোচনীয় থাকায় ভর্তি প্রস্তুতিতে নানা বাধার সম্মুখীন হন তিনি। ভর্তি হতে পারেননি কোনো কোচিংয়ে। এলাকায় নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা না থাকায় অনলাইনে ভর্তি প্রস্তুতি নেয়ারও কোনো সুযোগ ছিল না। প্রথম চেষ্টায় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাননি তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ না পেলেও দীপংকর পরিবারের সমর্থন সব সময় পেয়ে আসছিলেন।  

দীপংকর বলেন, ‘‌প্রথমবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চান্স পাইনি। তবে আমার পরিবার আমাকে সমর্থন দিয়ে আসছিল। আর্থিকভাবে আমাকে কোনো সহযোগিতা করতে না পারলেও মানসিকভাবে প্রচুর সাপোর্ট দিয়েছে। দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার জন্য গ্রাম ছেড়ে আমি রাঙ্গামাটি শহরে চলে আসি। তবে আর্থিক সমস্যা থাকায় কোনো কোচিংয়ে ভর্তি হতে পারিনি। নিজ থেকে চেষ্টা করে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছি। তবে বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে প্রকৌশলী হওয়ার লক্ষ্যে শাবিপ্রবির ইইইতে ভর্তি হই।’ শত প্রতিকূলতা মাড়িয়ে এতদূর এগিয়ে এলেও এখনো প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে জীবন চালাতে হচ্ছে দীপংকরকে। সারা দিন ক্লাস করে সন্ধ্যায় বেরিয়ে পড়তে হয় টিউশনিতে। যেখানে পরিবারের নিত্যদিনের খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন দীপংকরের বাবা, সেখানে পরিবার থেকে অর্থসহায়তা পাওয়া তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। দীপংকরের পাশাপাশি তার ছোট ভাইও বিজ্ঞান বিভাগে ইন্টারমিডিয়েটে অধ্যয়ন করছে। তাকেও টাকা দিয়ে সহায়তা করতে হয়। এজন্য পরিবারের কাছে টাকা চাইতে পারেন না দীপংকর। 

দীপংকর এখন স্বপ্ন দেখছেন একজন সৎ, দক্ষ ও দায়িত্ববান প্রকৌশলী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলে দেশ ও জাতিকে ভালো কিছু উপহার দিতে। তবে নিজেকে নিয়ে যেভাবে স্বপ্ন দেখছেন সেভাবে এগোতে পারছেন না তিনি। ভাষাগত জটিলতা ও ল্যাপটপ না থাকায় অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে পড়ছেন তিনি।  দীপংকর বলেন, ‘‌বিশ্ববিদ্যালয়ে সব বই ইংরেজিতে পড়তে হচ্ছে। আমাদের মাতৃভাষা চাকমা, মাতৃভাষা প্রথমে শিখতে হয়, তারপর বাংলা, ইংলিশ। তাই ইংলিশে বই পড়ে বোঝা কঠিন। আর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কোর্সগুলো অনলাইনে বাংলায় পাওয়া যায় না। ফলে অনেক সমস্যা পোহাতে হয়। একটা ল্যাপটপ দরকার কিন্তু আর্থিক সমস্যার কারণে ল্যাপটপ কিনতে পারছি না। প্রোগ্রামিং,  কোডিং,  অটোক্যাড ও  ম্যাথ ল্যাব প্রভৃতি কাজ ল্যাপটপ ছাড়া করা সম্ভব হয় না। তাই সেভাবে এগোতে পারছি না।’

বাংলা মাতৃভাষা না হওয়ায় এর সঠিক উচ্চারণের ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়তে হয়েছে তাকে। বাংলা উচ্চারণ স্পষ্ট না হওয়ার কারণে অনেকেই হাসাহাসি করেন। কখনো কখনো বিভ্রান্তিকর প্রশ্নেরও সম্মুখীন হতে হয়েছে দীপংকরকে। দীপংকরের ভাষায়, ‘‌চেহারা নিয়েও অনেক সময় ঝামেলা পোহাতে হয়। অনেকেই এমনভাবে তাকিয়ে থাকে, যা খুবই বিব্রতকর। এভাবে ভাষা, নাম, চেহারা এসব নিয়ে নানা রকম ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও হাসি-তামাশার শিকার হতে হয়। তবুও মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করি।’

নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আসা রাজমিস্ত্রী সুখ মঙ্গল চাকমা ও গৃহিণী দেবঙ্গিনী চাকমা দম্পতির সন্তান দীপংকর নিজেকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে এলাকার শিক্ষার্থীদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার স্বপ্ন দেখেন। দীপংকর বলেন, ‘‌আমি আমার এলাকার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী। আমার এলাকায় অনেক শিক্ষার্থী আছে যারা আমার মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখছে। আমার পক্ষে যতটুকু সম্ভব তাদের সহযোগিতা করার চেষ্টা করব।’  

শাবিপ্রবিতে নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের সংগঠন ‘অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিজিনাস স্টুডেন্টস, সাস্ট’র সাধারণ সম্পাদক সুধীর খীসা বলেন, ‘‌উচ্চশিক্ষায় আদিবাসী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা আমরা করে যাচ্ছি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ মার্কস-সংক্রান্ত একটি নিয়ম করায় এখন এর সংখ্যা কমছে। আমরা চাই দীপংকরের মতো সংগ্রাম করে আসা শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে দেশ ও সমাজের জন্য কল্যাণ বয়ে আনুক।’


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫