ঈদের পর ফের বাড়তে শুরু করেছে ভোগ্যপণ্যের বাজারদর

প্রকাশ: এপ্রিল ১৯, ২০২৪

সুজিত সাহা I চট্টগ্রাম ব্যুরো

ঈদের ছুটির পর আবার ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠেছে ভোগ্যপণ্যের বাজারদর। দেশের পাইকারি ও খুচরা বাজারে গত এক সপ্তাহে দাম বেড়েছে আলু, পেঁয়াজ, আটা, ময়দা, রসুন ও বিভিন্ন মসলাপণ্যের। এর মধ্যেই আবার ঘোষণা এসেছে বোতলজাত ভোজ্যতেলের (সয়াবিন তেল) দাম বাড়ানোর। যদিও কয়েক দিন আগে থেকেই ভোজ্যতেলের বাজারে দেখা যাচ্ছে অস্থিতিশীলতা। প্রতি বছর ঈদের পর চাহিদা কমে ভোগ্যপণ্যের বাজারদর কিছুটা নিম্নমুখী হতে দেখা গেলেও এবার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত। এজন্য প্রধানত বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার তীব্রতা বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করছেন আমদানিকারক ও ট্রেডাররা। 

তাদের ভাষ্যমতে, রিজার্ভ সংকট, ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি, ব্যাংকে এলসি ও তারল্য সংকট এবং ব্যবসায়ীদের অতিমুনাফা প্রবণতার কারণে বাংলাদেশে বেশ কিছুদিন ধরে নাজুক অবস্থানে রয়েছে ভোগ্যপণ্যের বাজার। এ পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে শুরু হওয়া উত্তেজনা। 

চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, আটা, ময়দা, এলাচ, ভোজ্যতেলসহ আরো বেশ কয়েকটি নিত্যপণ্যের দাম এখন বাড়তির দিকে। সরকারের নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কেজিতে ১০-১৫ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে আলু। খুচরা বাজারে এখন প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৪৫-৫০ টাকায়। এক সপ্তাহ আগেও তা ছিল ৩৫-৪০ টাকা। গত এক সপ্তাহে রসুনের দাম বেড়েছে কেজিতে ১০-২০ টাকা। বাজারে এখন প্রতি কেজি রসুন মানভেদে ১৩০ থেকে ১৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পেঁয়াজের দাম বেড়েছে কেজিতে ৫ টাকা। খুচরা বাজারে এখন পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে কেজি ৬০-৭০ টাকা দরে। একই সময়ে প্রতি কেজি আটার দাম ৫২-৫৫ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫-৬০ টাকায়। 

ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতি বছর রবি মৌসুমে আলু ও পেঁয়াজের দাম কমে আসতে দেখা যায়। কিন্তু এ বছর উৎপাদনের ভরা মৌসুমেও পণ্য দুটির দাম ছিল অন্যান্য বছরের চেয়ে বেশি। অন্যদিকে আমদানি বন্ধ থাকায় উৎপাদন মৌসুমেও দেশী পেঁয়াজের দাম তেমন একটা কমেনি। ঈদের পর ভারত থেকে আমদানি শুরু হলেও ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে দেশী ও আমদানীকৃত পেঁয়াজের দাম। সরবরাহ স্বাভাবিক করতে না পারলে নিত্যপণ্য দুটির দাম বিগত বছরগুলোর দামকে ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে খাতুনগঞ্জভিত্তিক এক ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক ব্যবসায়ী বলেন, ‘‌বৈশ্বিক ভূরাজনীতির সংকট ও উত্তেজনা এখন কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তীব্রতা পেয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় সরবরাহ চ্যানেলের প্রতিবন্ধকতা, দেশে জ্বালানি ও আর্থিক সংকট আমাদের সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়ে আশঙ্কা তৈরি করেছে। আবার বাংলাদেশকে এখন আলুর মতো কৃষিজ পণ্যও আমদানি করতে হচ্ছে। পণ্যবাজারে দামের এসব উত্থান-পতন ঠেকাতে হলে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি সরবরাহে স্বচ্ছতা ও মজুদে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি।’

মসলাপণ্যের বাজারে সাধারণত ঈদের পর চাহিদা কমে মূল্যহ্রাস পেতে দেখা গেলেও এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। অধিকাংশ মসলাপণ্যের বাজারদর এখন বেশ অস্থিতিশীল। গত দুই সপ্তাহে পাইকারি বাজারে এলাচের দাম বেড়েছে কেজিতে ৭০০ টাকা। ধনিয়ার দাম কেজিতে ৩০ টাকা বেড়ে লেনদেন হচ্ছে ১৬৫ টাকায়। হলুদের দাম কেজিতে ২০-২৩ টাকা বেড়ে লেনদেন হচ্ছে ২৫৩-২৫৫ টাকায়। ১৫-২৫ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি শুকনা মরিচ ৩০০-৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া কেজিতে ৮০ টাকা বেড়ে কিশমিশ ৫৩০ টাকায় ও টক আলুবোখারা ৪৯০ টাকায় কেনাবেচা হচ্ছে। মিষ্টি আলুবোখারার দাম কেজিতে ২০-২৫ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২৫ টাকায়। তবে সরবরাহ বাড়ায় দীর্ঘদিন ঊর্ধ্বমুখী থাকার পর জিরা, দারচিনিসহ কয়েকটি মসলাপণ্যের দাম এখন কিছুটা কমতির দিকে। 

আমদানিকারক ও ট্রেডিং ব্যবসায়ীদের ভাষ্যমতে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর লোহিত সাগরে চলমান সংকট সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশে গম, ভুট্টাসহ কয়েকটি খাদ্যশস্যের সরবরাহ চেইনে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। এখন ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের আশঙ্কার মধ্যে হরমুজ প্রণালিকেন্দ্রিক জ্বালানি ও পণ্য সরবরাহ নিয়ে বড় ধরনের সংশয় তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের মতো আমদানিকারক দেশগুলো সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়বে। ব্যবসায়ীরা মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংকটকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণে রেখেছেন। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামভিত্তিক খাদ্যশস্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, হুথি বিদ্রোহীদের কারণে বৈশ্বিক পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলে নৌ-রুট সীমিত হয়ে পড়েছে। এখন ইরান-ইসরায়েল সংঘাতময় পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যে এ সংকট আরো ভয়াবহ আকার নেয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এখনো এর প্রভাব শুরু না হলেও ব্যবসায়ীদের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। দেশের অভ্যন্তরীণ সংকটগুলো কাটিয়ে ওঠার আগেই ইরানের ইসরায়েল আক্রমণ কিংবা ইসরায়েল যদি ইরানে আক্রমণ শুরু করে তবে আমাদের আমদানি বাণিজ্যে কোনো না কোনোভাবে প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে ভোগ্যপণ্যের বাজার নিয়ে ব্যবসায়ীদের শঙ্কা এখন সবচেয়ে বেশি।’ 

প্রধান খাদ্যশস্য চালের দাম কিছুটা বাড়লেও শিগগিরই তা কমে আসবে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। গত এক সপ্তাহে খুচরা বাজারে চালের (মাঝারি আকারের) মূল্য বেড়েছে কেজিতে ২-৩ টাকা। এক সপ্তাহ আগেও বাজারে এ আকৃতির চাল বিক্রি হয়েছে জাতভেদে প্রতি কেজি ৫২ থেকে ৫৬ টাকা দরে। গতকালের বাজারে এর মূল্য ছিল ৫৫-৫৮ টাকা। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চাক্তাই চাল মিল মালিক ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর আজম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌বিশ্ববাজারে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে চালের দাম এখন বেশি। বর্তমানে দেশে বোরো ধানের উত্তোলন মৌসুম চলছে। এবার ফলন ভালো হওয়ায় চালের দাম শিগগিরই নিম্নমুখী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের চাল আমদানির প্রয়োজন না হলেও বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে দেশে এর কিছু প্রভাব দেখা যেতে পারে। ঈদের আগে ও ঈদ-পরবর্তী সময়ে চালের দাম যেটুকু বেড়েছে, তার প্রধান কারণ ছিল পণ্যবাহী যানবাহনের সংকট। তবে এ দাম এখনো কমেনি।’ 

আন্তর্জাতিক ভোজ্যতেলের দাম দীর্ঘদিন ধরেই কমতির দিকে। যদিও দেশের বাজারে তা কমানো হয়নি। দেশে ট্যারিফ কমিশনের সহায়তায় ভোজ্যতেলের বাজারদর নির্ধারণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আমদানি ও উৎপাদন পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে গত ৭ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সয়াবিন তেলের দাম কমানো হয়েছিল লিটারে ১০ টাকা। এ ভ্যাট অব্যাহতির মেয়াদ শেষ হয় গত সোমবার। এর পরিপ্রেক্ষিতে মিলাররা ভোজ্যতেলের দাম আগের দামে ফিরিয়ে নেয়ার ঘোষণা দেয়। ওই দিন সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১০ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠায় ভোজ্যতেল পরিশোধন ও উৎপাদনকারীদের সংগঠন ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন।

সচিবালয়ে গতকাল এক ব্রিফিং চলাকালে বোতলজাত সয়াবিন তেলের (১ লিটারের) দাম লিটারে ৪ টাকা বাড়িয়ে ১৬৭ টাকা করার ঘোষণা দিয়েছেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী। আর পাঁচ লিটারের বোতলের দাম ৮০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮১৮ টাকা করার ঘোষণা দেন তিনি। তবে একই সঙ্গে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম ২ টাকা কমিয়ে ১৪৭ টাকা ও আর পাম অয়েলের (খোলা) দাম সর্বোচ্চ ১৩৫ টাকা নির্ধারণেরও ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। যদিও বাজারে এখনো ঘোষিতের চেয়ে বেশি মূল্যে ভোজ্যতেল বিক্রি হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।  

ঈদের এক সপ্তাহ আগে ও ঈদের পর পাম অয়েলের পাইকারি বাজার বেড়েছে মণপ্রতি অন্তত ৫০০ টাকা। আবার একই সময়ে সয়াবিনের পাইকারি দাম বেড়েছে মণে ২৫০ থেকে ২৮০ টাকা। ঈদের আগে-পরের দুই সপ্তাহে খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে ভোজ্যতেলের (পাম অয়েল ও সয়াবিন অয়েল) দাম বেড়েছে মণপ্রতি (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) ২৫০ থেকে প্রায় ৫০০ টাকা। খাতুনগঞ্জের পাইকারি ও ডিও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক পরিমণ্ডলে অস্থিরতার তীব্রতায় আমদানি সংকটের আশঙ্কায় অতিপ্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যটির দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছেন তারা। 


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫