গ্যাসের স্থানীয় জোগান নিয়ে চিন্তিত পেট্রোবাংলা এখন পরিত্যক্ত কূপে নজর দিচ্ছে

প্রকাশ: এপ্রিল ১৭, ২০২৪

আবু তাহের

স্থানীয় পর্যায়ে উত্তোলিত গ্যাসের জোগান চাহিদার চেয়ে অনেক কম। সরবরাহ সংকটে নির্ভরতা বাড়ছে আমদানিতে। আবার বৃহৎ গ্যাস ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে কয়েকটির মজুদ প্রায় শেষ পর্যায়ে। গ্যাসের সরবরাহ নিয়ে চাপ বাড়ছে পেট্রোবাংলার ওপর। এ পরিস্থিতিতে খনন ও সংস্কারের (ওয়ার্কওভার) মাধ্যমে পরিত্যক্ত গ্যাসকূপগুলোকে উত্তোলনে ফিরিয়ে আনায় মনোযোগ দিয়েছে সংস্থাটি। এ বিষয়ে গঠিত পেট্রোবাংলার এক কমিটির সমীক্ষা প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, দেশের বিভিন্ন গ্যাস ক্ষেত্রের আওতাধীন অন্তত ৯৮টি কূপ এখন পরিত্যক্ত ও সাময়িক বন্ধ অবস্থায় রয়েছে। যথাযথ সংস্কারের মাধ্যমে কূপগুলো থেকে নতুন করে দৈনিক ২২০-২৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া সম্ভব। 

বিদ্যুৎ কেন্দ্র, শিল্প ও আবাসিকে এখন দৈনিক সরবরাহ হচ্ছে চাহিদার তুলনায় প্রায় এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট কম। গ্যাস সংকটে বসিয়ে রাখতে হচ্ছে প্রায় অর্ধেক সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র। ব্যাপকভাবে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে শিল্প-কারখানায়। আবাসিকেও গ্যাস সংকটের কারণে নতুন কোনো সংযোগ দেয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে বৃহৎ গ্যাস ক্ষেত্রগুলোর মজুদও প্রায় শেষ পর্যায়ে। এ পরিস্থিতিতে আমদানির পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে উৎপাদন বাড়াতে জ্বালানি বিভাগের নির্দেশনার ভিত্তিতে ওই কমিটি গঠন করে পেট্রোবাংলা। কমিটির সদস্যরা বন্ধ ও পরিত্যক্ত কূপ সংস্কারের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে গ্যাসের সম্ভাব্য বাড়তি জোগানের পরিমাণ নির্ণয়ে অনুসন্ধান কার্যক্রম চালান। এসব কূপে চালানো সমীক্ষার ভিত্তিতে চলতি ২০২৪ সালের মার্চে পেট্রোবাংলা বরাবর একটি প্রতিবেদনও জমা দিয়েছেন তারা।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশে এ যাবত ২৫৩টি কূপ খনন করা হয়েছে। এর মধ্যে উৎপাদনে রয়েছে ৭০টি। বিভিন্ন কারণে সাময়িক বন্ধ ও পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে ৯৮টি কূপ। এর মধ্যে ৬৭টি ওয়ার্কওভারের মাধ্যমে উৎপাদনে আনা সম্ভব। বাকি ৩১টিতেও বড় পরিসরে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। বন্ধ ও পরিত্যক্ত এসব কূপ সঠিক উপায়ে ওয়ার্কওভার বা পুনঃখনন করা গেলে জাতীয় গ্রিডে দৈনিক আরো ২২০-২৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত করা সম্ভব হবে। 

দেশের বৃহৎ গ্যাস ক্ষেত্রগুলোর মজুদ এরই মধ্যে অনেকটাই ফুরিয়ে এসেছে। এর অন্যতম মার্কিন প্রতিষ্ঠান শেভরনের পরিচালনাধীন বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্র। জাতীয় গ্রিডে গ্যাসের স্থানীয় জোগানের ৩৯ শতাংশ সরবরাহ হচ্ছে বিবিয়ানা থেকে। পেট্রোবাংলার ২পি রিজার্ভ এস্টিমেশন (উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মোট আবিষ্কৃত ও সম্ভাব্য মজুদ) অনুযায়ী, ক্ষেত্রটিতে গ্যাসের মজুদ ফুরিয়েছে তিন মাস আগেই। সংস্থাটি এখানে গ্যাসের মজুদ হিসাব করেছিল ৫ হাজার ৭৫৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন বিসিএফ। আর জ্বালানি বিভাগের হাইড্রোকার্বন ইউনিটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ডিসেম্বরের মধ্যেই গ্যাস ক্ষেত্রটি থেকে ৫ হাজার ৭৯৫ দশমিক ২ বিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হয়ে গেছে। সে অনুযায়ী, ক্ষেত্রটিতে তিন মাস আগেই গ্যাসের হিসাবকৃত মজুদ ফুরিয়ে আরো অতিরিক্ত ৪০ বিলিয়ন ঘনফুট উত্তোলন করা হয়েছে। 

জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলার দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বড় গ্যাস ক্ষেত্রের মজুদ শেষ হয়ে আসছে। কয়েক বছরের মধ্যে জাতীয় গ্রিডে বড় আকারে গ্যাসের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। তাই আমদানির পাশাপাশি পুরনো ও পরিত্যক্ত কূপগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মূলত পরিত্যক্ত ও বন্ধ থাকা কূপগুলো খতিয়ে দেখা, কী পরিমাণ বিনিয়োগ করা গেলে সম্ভাব্য গ্যাস পাওয়া যেতে পারে, সে বিষয়গুলো নিয়ে এরই মধ্যে প্রাথমিক কাজ শেষ হয়েছে। এখন সময় ও প্রকল্প করে এসব কূপে কাজ করা হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে পরিত্যক্ত ও বন্ধ কূপগুলোর বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এটি গ্যাস খাতের উন্নয়ন কার্যক্রমেরই অংশ।’ 

পেট্রোবাংলার গ্যাস মজুদের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দেশে আবিষ্কৃত গ্যাস ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে উৎপাদনে চারটি। এগুলোয় মজুদ রয়েছে ৬৭৩ বিলিয়ন কিউবিক ফুট (বিসিএফ) গ্যাস। এর মধ্যে ১৯৭৭ সালে আবিষ্কৃত কক্সবাজারের কুতুবদিয়া গ্যাস ক্ষেত্রে মজুদ রয়েছে ৪৫ বিসিএফ, ভোলা নর্থ-১-এ মজুদ রয়েছে ৪৩৫ বিসিএফ, সিলেটের জকিগঞ্জে ৫৩ বিসিএফ ও ইলিশা ক্ষেত্রে মজুদ রয়েছে ১৪০ বিসিএফ গ্যাস। এসব গ্যাস ক্ষেত্রে নতুন নতুন কূপ খননের মাধ্যমে গ্যাসের জোগান বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে পেট্রোবাংলা ও বাপেক্স।

এর বাইরে বিভিন্ন সময়ে উৎপাদনে থাকা ও দুর্ঘটনার শিকার হওয়া গ্যাস ক্ষেত্রের সংখ্যা পাঁচটি। এসব ক্ষেত্রে মজুদ রয়েছে ৬৬২ বিসিএফ গ্যাস। এর মধ্যে রূপগঞ্জ গ্যাস ফিল্ড পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এ ক্ষেত্রটিতে মজুদের পরিমাণ ৩২ বিসিএফ। সুনামগঞ্জের ছাতকে ৪৪৭ বিসিএফ, কামতা গ্যাস ফিল্ডে ২৯, ফেনী গ্যাস ফিল্ডে ৬২ ও সাগরে পরিত্যক্ত একমাত্র গ্যাস ক্ষেত্র সাঙ্গুতে ৮৯ বিসিএফ গ্যাস মজুদ রয়েছে।

পেট্রোবাংলার কর্মকর্তাদের ভাষ্য, এসব গ্যাস ক্ষেত্রের অনেকগুলো কূপে ওয়ার্কওভারের সুযোগ রয়েছে। জ্বালানি বিভাগের সম্মতি পেলে সরকার ও গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের অর্থ ব্যবহার করে সেখান থেকে বড় আকারের গ্যাস পাওয়া সম্ভব।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরাও মনে করেন পুরনো ও পরিত্যক্ত কূপগুলো সংস্কার করে গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। তবে এসব কূপ নিয়ে আরো আগেই পেট্রোবাংলার কাজ করার সুযোগ ছিল। এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরূল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অনেকগুলো গ্যাস ফিল্ড দীর্ঘদিন বন্ধ রয়েছে। এসব গ্যাস ফিল্ডের আওতায় রয়েছে অনেকগুলো কূপ, যেখানে গ্যাসের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। গ্যাসের এ সংকটে আরো আগ থেকে কূপগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া গেলে পেট্রোবাংলা তার সংকটকালীন বড় সাপোর্ট পেত। কোম্পানিগুলো এ বিষয়ে আরো আগেই উদ্যোগ নিতে পারত। কিন্তু কূপ সংস্কার ও ওয়ার্কওভারের বিষয়ে শুধু সময়ক্ষেপণই হয়েছে। এখন কূপগুলো সংস্কার করতে হলেও তো অন্তত দু’তিন বছর সময় লেগে যাবে।’

দেশে গ্যাসের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে পেট্রোবাংলা বর্তমানে ৪৮টি গ্যাস কূপ খনন ও ওয়ার্কওভার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে ২৩টি কূপ খনন করা হচ্ছে বাপেক্সের রিগ দিয়ে এবং বাকিগুলো আউটসোর্সিং করে খনন সম্পন্ন করবে পেট্রোবাংলা। এসব কূপ খননের মাধ্যমে ২০২৫ সালের মধ্যে জাতীয় গ্রিডে দৈনিক ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত করার লক্ষ্য রয়েছে সংস্থাটির।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ১১টি কূপ খনন করা হয়েছে। কূপগুলো থেকে দৈনিক ১২৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়ার নিশ্চয়তা পেয়েছে পেট্রোবাংলা। যদিও এখন পর্যন্ত গ্রিডে এর ৩৩ মিলিয়ন ঘনফুট যুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে। বর্তমানে কৈলাসটিলা-৮, তিতাস-১৪ ও রশিদপুর-৫ কূপের ওয়ার্কওভার কার্যক্রম চলমান রয়েছে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫