স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র: বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান

প্রকাশ: এপ্রিল ১০, ২০২৪

আবু তাহের খান

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণার অব্যবহিত পরবর্তী যুদ্ধপ্রস্তুতি, এর মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্ত স্বাধীন দেশে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রথম বছর—এ তিন পর্যায় ও ক্ষেত্রে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’-এর যে গুরুত্ব ও ভূমিকা, তা শুধু অসামান্যই নয়—বস্তুত এটিই ছিল ওই তিন সময়ের জন্য বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূল পথনির্দেশক, রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি। এমনকি আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর নতুন সংবিধান কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত এটিই ছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধান, যেটিকে পরবর্তী সময়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে মূল সংবিধানের তফসিল হিসেবেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ এটিই হচ্ছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রথম সংবিধান, যার আওতায় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বছর নমাস এ দেশ পরিচালিত হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে এত গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয় নিয়ে গত ৫২ বছরে খুবই কম পঠন-পাঠন, প্রচার ও আলোচনা হয়েছে এবং একই ধারাবাহিকতা মেনে হয়নি তেমন কোনো গবেষণাও। অথচ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আগ্রহী শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও গবেষকদের কাছে এটি একটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ও রেফারেন্সযোগ্য গবেষণাক্ষেত্র হয়ে ওঠতে পারত।



মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বস্তুনিষ্ঠ তথ্যের ভিত্তিতে ও সবিস্তারে তুলে ধরার কথিত লক্ষ্যে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট পাঠ্যপুস্তকগুলোকে বারবার পরিবর্তন, পরিমার্জন ও সংশোধন করা হয়েছে। আর তা করতে গিয়ে হেফাজতে ইসলামের সুপারিশে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে যেমন কোনো কোনো লেখা বাদ দেয়া হয়েছে—যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শের সম্পূর্ণ পরিপন্থী—তেমনি আবার এমন কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও যুক্ত করা হয়েছে, যেগুলো নিরপেক্ষ বিবেচনায় সেখানে অন্তর্ভুক্ত না করলেও চলত। কিন্তু এত কিছু করার পরও হতাশজনকভাবে লক্ষণীয় যে, বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান তথা ১৯৭১-এর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র নিয়ে উল্লিখিত পাঠ্যপুস্তকগুলোয় পর্যাপ্ত পরিসরে তো নয়ই, এমনকি সাধারণ পরিসরেও তেমন কোনো আলোচনা নেই। ফলে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা উল্লিখিত ঘোষণাপত্র সম্পর্কে প্রায় তেমন কিছুই জানে না বা জানতে পারছে না এবং এ না জানাটা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তাদের জ্ঞানকে খুবই খণ্ডিত করে রাখছে। অন্যদিকে এ ঘোষণাপত্রই যে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ, যুদ্ধ পরিচালনা ও স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম বছরে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সংবিধান বা রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নির্দেশিকা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, সে সম্পর্কে সাধারণের মধ্যেও ব্যাপকভিত্তিক কোনো স্পষ্ট ধারণা গড়ে ওঠেনি বা ওঠতে পারেনি।


২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উদযাপনের সময়ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। এমনকি ওই সময়ে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে যেসব বইপত্র প্রকাশ হয়েছে, সেগুলোর মধ্যেও এ বিষয় তেমন একটা লক্ষ করা যায়নি। যদিও এ সময়ে এমন অনেক হালকা ধাঁচের কথাবার্তা ও অপ্রয়োজনীয় স্তুতিমূলক বক্তব্য সংবলিত গ্রন্থাদিও প্রকাশ হয়েছে, যেগুলোর মধ্যে ৫০ বছরের অর্জন-অনর্জন, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি ও সাফল্য-ব্যর্থতার বস্তুনিষ্ঠ কোনো মূল্যায়নই নেই। আর এ ঘোষণাপত্রের যারা মুসাবিদা করেছিলেন (অধ্যাপক রেহমান সোবহান প্রমুখ) এবং প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন (ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম প্রমুখ) তারাও এ সময়ে কোনো অজ্ঞাত কারণে এ বিষয়ে কোনো লেখালেখি করেননি বা কথাবার্তা বলেননি। বস্তুতই স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উদযাপনের সময়কার বিভিন্ন আয়োজনের মধ্যে যেসব অসম্পূর্ণতা ছিল, তারমধ্যে এটি ছিল একটি বড় মাপের অসম্পূর্ণতা যে, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও তার ভূমিকা নিয়ে সেখানে ব্যাপকভিত্তিক কোনো আলোচনা হয়নি।

 

সে যাই হোক, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী অত্যন্ত বর্বরোচিত কায়দায় এ দেশের সাধারণ মানুষের ওপর আক্রমণ ও গণহত্যা শুরু করলে বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারলেন বটে, কিন্তু পরমুহূর্তে পাকিস্তানি বাহিনী তাকে গ্রেফতার করেও নিয়ে গেল। এ অবস্থায় দেশের অবশিষ্ট রাজনৈতিক নেতাদের আশু কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় ঘোষিত স্বাধীনতাকে বাস্তবে রূপদান, অর্থাৎ পাকিস্তানকে পরাজিত করে বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক ও ভৌগোলিক সার্বভৌমত্ব অর্জন। পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের মুখে তাৎক্ষণিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার বিষয়টি যেমনি একটি কঠিন সিদ্ধান্ত ছিল, তেমনি কঠিন ছিল স্বাধীনতা ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে তাৎক্ষণিকভাবে এ বিষয়ে পরবর্তী করণীয় ঠিক করাটাও। জাতি আজ সেই সময়কার সেই রাজনীতিকদের কাছে গভীরভাবে কৃতজ্ঞ যে, কাজটি তারা সর্বোচ্চ বিচক্ষণতা ও দক্ষতার সঙ্গেই সেদিন করতে পেরেছিলেন—কোনো ভুল করেননি। আর এ কাজে সফল নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, যিনি বঙ্গবন্ধুর নামেই নেতৃত্বদানের এ দায়িত্ব পালন করেছিলেন। 


উল্লিখিত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে একেবারে প্রথমেই তারা অর্থাৎ ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী সদস্যরা পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে (অধিবেশন আহ্বানের মতো বাস্তব পরিস্থিতি তখন ছিল না) একটি গণপরিষদ গঠন করেন এবং ওই গণপরিষদের পক্ষ থেকেই প্রণয়ন করা হয় স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। এটি প্রথমে ১০ এপ্রিল এবং পরে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণের দিনে গণপরিষদের পক্ষ থেকে পুনরায় প্রচার করা হয়। মুক্তিযুদ্ধকালে যুদ্ধ পরিচালনা (অস্ত্র সংগ্রহ, সামরিক প্রশিক্ষণ ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদিসহ), আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কূটনৈতিক যোগাযোগ স্থাপন, শরণার্থীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা, দেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত জনগণের নিরাপত্তা বিধান ইত্যাদি সবকিছুই তখন সম্পন্ন হয়েছিল এ ঘোষণাপত্র অনুযায়ী এবং আকৃতির দিক থেকে এটি সংক্ষিপ্ত হলেও বিষয়বস্তুর বিন্যাস ও মানগত দিক থেকে এটি এতটাই পূর্ণাঙ্গ ছিল যে স্বাধীনতা-পরবর্তী পুরো এক বছর ধরে এ ঘোষণাপত্রের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে কোথাও এতটুকু কোনো সমস্যা হয়নি। আর মাত্র এক বছরেরও কম সময়ের ব্যবধানে যে নতুন সংবিধানটি প্রণীত হতে পেরেছিল তারও একটি বড় কারণ এই যে, এর ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছিল আগে থেকেই তৈরি হয়ে থাকা এ ঘোষণাপত্র। ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানটি বস্তুত ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল প্রণীত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রেরই বর্ধিত সংস্করণ।


কী ছিল বা আছে স্বাধীনতার এ ঘোষণাপত্রে? একেবারে প্রথমেই বলা আছে যে, ‘জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ প্রতিষ্ঠার জন্য’ই (ঘোষণাপত্রের অনুচ্ছেদ-৬) ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। তো, কৃষক-শ্রমিক ও অন্যান্য মেহনতি মানুষের সশস্ত্র অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সংঘটিত নমাসের যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আইনানুগ প্রতিষ্ঠার কাজটি সফলভাবে সম্পন্ন হলেও জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার কাজটি কি এ ৫৩ বছরেও এতটুকু এগিয়েছে? আমরা কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারছি যে, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে জনগণের অংশগ্রহণের পরিধি ও মাত্রা ১৯৭১ সালের তুলনায় একরত্তি হলেও বেড়েছে? বরং অধিক সত্য তো এটাই যে, ১৯৭১-এ পাকবাহিনীর শত অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেও একটি প্রবাসী সরকারের আওতায় একটি নির্মম যুদ্ধাবস্থার মধ্যেও দেশের মানুষের মনে যে নাগরিক অহংকার ও মর্যাদাবোধের যে জায়গাটি ছিল, আজ যুদ্ধমুক্ত দেশে অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে আসার পরও সে জায়গাটি এখনো অর্জন করা সম্ভব হলো না এবং সহসা যে সম্ভব হবে তেমন কোনো লক্ষ্মণও চোখে পড়ছে না।


ঘোষণাপত্রে আরো বলা আছে যে, ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থেএ ঘোষণাপত্র সমর্থন ও অনুমোদন করা হলো (ঘোষণাপত্রের অনুচ্ছেদ-১১)। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, উল্লিখিত সাম্যের পরিবর্তে বৈষম্য, মানবিক মর্যাদার পরিবর্তে অমানবিকতা ও সামাজিক সুবিচারের পরিবর্তে সামাজিক অনাচারই কি এখন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূল বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়নি? তাহলে এত মানুষের রক্তঝরা ত্যাগ ও সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা আমাদের কী দিল? এক্ষেত্রে হতাশ না হয়ে বরং একটি কথা যোগ করতে চাই যে, ওই নিঃস্বার্থপরায়ণ ত্যাগী মানুষ আমাদের একটি স্বাধীন দেশ দিয়ে গেছেন বলেই না আজ এ ক্ষোভটুকু আমরা প্রকাশ করতে পারছি যে, রাষ্ট্রপরিচালকদের লোভ, লিপ্সা এবং মানবিক অনুভূতি ও দূরদৃষ্টিবিহীন সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের চেতনা ও অঙ্গীকার থেকে ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছি। 


এমনি পরিস্থিতিতে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের এ ৫৩তম বার্ষিকীতে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে দেশের সব মানুষের কাছে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে এ মর্মে একটি আবেদন রাখতে চাই। আসুন, জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এ দেশের যে অকুতোভয় মানুষ তাদের বুকের রক্ত ঢেলে দেশকে স্বাধীন করে গেছেন, তাদের সে আত্মত্যাগ ও স্বপ্নাকাঙ্ক্ষার দিকে তাকিয়ে হলেও চলমান ধারার আত্মকেন্দ্রিকতা বিসর্জন দিয়ে লুপ্তপ্রায় প্রতিবাদী সত্তাকে পুনর্গজারিত করে তোলার মাধ্যমে সব অন্যায়, অবিচার, অমানবিকতা ও অগণতান্ত্রিকতাকে ঐক্যবদ্ধভাবে না’ বলি। তবে এ কাজে স্বার্থের টানাপড়েনে ব্যস্ত বয়সী মানুষের কাছ থেকে সাড়া পাওয়া কঠিন। সে তুলনায় বরং নতুন প্রজন্মের পিছুটানবিহীন তরুণরাই হতে পারেন সেই মানুষ, যারা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সেই আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের আকাঙ্ক্ষাকে সাহসের সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হবেন। আমরা ওই অকুতোভয় সাহসী-সম্ভাবনাময় তরুণদের দিকেই একরাশ আশা নিয়ে তাকিয়ে রইলাম।

আবু তাহের খান: লেখক ও গবেষক 


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫