আলোকপাত

নৈতিক ক্ষোভ: বয়কট থেরাপি চলুক

প্রকাশ: মার্চ ২৯, ২০২৪

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান

বয়কট বা বর্জন শব্দের অর্থ, প্রতিবাদ করা বা শাস্তি দেয়ার উদ্দেশ্য, কোনো দেশ, সংগঠন বা ব্যক্তির সঙ্গে বাণিজ্যিক বা সামাজিক সম্পর্ক ছিন্ন করা। এটি একটি অহিংস ও স্বেচ্ছামূলক পদক্ষেপ যা নৈতিক, সামাজিক বা পরিবেশগত বিবেচনায় গ্রহণ করা হয়ে থাকে। বর্জনের উদ্দেশ্য হলো চিহ্নিত দেশ, সংগঠন বা ব্যক্তির আর্থিক ক্ষতিসাধন করা বা নৈতিক ক্ষোভ প্রকাশ করা যাতে বর্জনের লক্ষ্যবস্তু তার আপত্তিকর কার্যক্রম থেকে বিরত থাকে। 

বয়কটরা তিন ভাই: সরকার কর্তৃক আইন দ্বারা অনুমোদিত হলে বয়কট স্যাংশন বা নিষেধাজ্ঞায় পরিণত হয়। এ ধরনের পদক্ষেপের ব্যাপকতম রূপ হচ্ছে একসঙ্গে বর্জন, বিনিয়োগ প্রত্যাহার ও নিষেধাজ্ঞা (বয়কট, ডাইভেস্টিচার ও স্যাংশনস)। সব বয়কট আন্দোলনই সফল হয়নি। দুটি সফল বয়কট আন্দোলনের কথা নিচে উল্লেখ করছি, যা ইতিহাস বদলে দিয়েছে।

রোজা পার্কস: মন্টগোমারি বাস বয়কট আন্দোলন: ১৯৫৫ সালে, কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা রোজা পার্কস, তখনকার নিয়মানুযায়ী একজন শ্বেতাঙ্গ বাসযাত্রীকে সিট ছেড়ে দেয়ার কথা থাকলেও তা দিতে অস্বীকার করেন। এ অপরাধে তাকে বন্দি ও জরিমানা করা হয়। প্রতিবাদে শুরু হয় মন্টগোমারি বাস বয়কট আন্দোলন। এ আন্দোলনে যোগ দেন তরুণ যাজক মার্টিন লুথার কিং। যিনি পরবর্তীতে মার্কিন নাগরিক অধিকার আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে ওঠেন। ১৩ মাস আন্দোলনের পর মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট মন্টগোমারিকে পাবলিক বাসে গাত্রবর্ণের ভিত্তিতে বসার ব্যবস্থাকে বেআইনি ঘোষণা করে এবং তাদের বাস ব্যবস্থাকে একীভূত করার নির্দেশ দেন।

দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী বয়কট আন্দোলন: ১৯৫৯ সালে আলবার্ট লুথুলি বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম লন্ডনে দক্ষিণ আফ্রিকার পণ্য বর্জনের আহ্বান জানান। প্রথমে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আমদানীকৃত ফল, শেরি ও সিগারেট বর্জনের ডাক দেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে আন্দোলনকারীরা বর্জনীয় পণ্যের তালিকা হালনাগাদ করতে থাকে, লোকজনকে মোড়ক পড়তে এবং টেস্কো ও সেইন্সবারির মতো বড় সুপারমার্কেটগুলোকে দক্ষিণ আফ্রিকার পণ্য না রাখতে ও বিক্রি করতে এসব দোকানের সামনে ধরনা দেয়। ফলে বর্ণবাদী সরকারের পৃষ্ঠপোষক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের সমর্থন সত্ত্বেও ব্রিটেনে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে কাপড় আমদানি ৩৫ শতাংশ কমে যায়। 

এর পরের ঘটনাপ্রবাহ বাণিজ্যিক বয়কট খেলা, একাডেমিক, এমনকি বিনিয়োগ প্রত্যাহারে গড়ায়। ১৯৬৮ সালে ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলে দক্ষিণ আফ্রিকার বংশোদ্ভূত অশ্বেতাঙ্গ খেলোয়াড় ব্যাসিল ডি’অলিভেরাকে অন্তর্ভুক্ত করা হলে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী প্রধানমন্ত্রী প্রথমে ডি’অলিভেরাকে ঘুস দিয়ে তাকে টিম থেকে নাম প্রত্যাহারের জন্য চাপ দেয়। তিনি অস্বীকৃতি জানালে দক্ষিণ আফ্রিকা সফর বাতিল করে দেয়। পরবর্তী সময়ে চাপের মুখে দক্ষিণ আফ্রিকাকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বহিষ্কার করা হয়। একইভাবে ১৯৬৫ সালে জ্যাক সাইমন্স ও এডি রু নামে দুজন অধ্যাপকের ওপর তাদের বর্ণবাদবিরোধী বক্তব্যের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ৩৪টি ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৯৬ জন অধ্যাপক ও প্রভাষক শিক্ষাক্ষেত্রে দক্ষিণ আফ্রিকাকে বয়কটের দাবি জানায়, যা পরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে জাতিসংঘ ১৯৮০ সালের ডিসেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অন্যান্য বয়কটের প্রস্তাব পাস করে। 

এরপর আশির দশকের মাঝামাঝি মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এন্ডাওমেন্ট ফান্ডের বিনিয়োগ প্রত্যাহারের দাবি ওঠে। ভাসার কলেজ থেকে শুরু হওয়া আন্দোলনে কলম্বিয়া, মিশিগান স্টেট, হার্ভার্ড, স্মিথ কলেজসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠান যোগ দেয়। ছাত্রদের প্রতিবাদ ও চাপের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইসরায়েল থেকে তাদের এন্ডাওমেন্ট ফান্ডের বিনিয়োগ আংশিক বা সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে। 

দক্ষিণ আফ্রিকার ভেতরে নেলসন ম্যান্ডেলা, ডেসমন্ড টিটো, স্টিভ বিকো প্রমুখের আন্দোলন ও আত্মত্যাগের ফলে বর্ণবাদবিরোধী জনতার বয়কট সাফল্য লাভ করে। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৩ সালে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে বর্ণবাদের অবসান ঘটলে বয়কট তুলে নেয়া হয়। 

ইসরায়েল ও তার সমর্থক কোম্পানির পণ্য বয়কট: সাম্প্রতিক বয়কট আন্দোলনের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি দখলদারত্ব ও গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে শুরু ইসরায়েল সমর্থক কোম্পানির পণ্য বর্জন। যার মধ্যে রয়েছে মার্কিন কোম্পানি ম্যাকডোনাল্ডস, স্টারবাকস, কোকা-কোলা, পিজা হাট, ডমিনোস পিজা প্রভৃতি। বয়কটের ফলে এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও এসব কোম্পানির পণ্যের বিক্রি কমেছে। এমনিতেই প্রায় দুই দশক থেকে ইসরায়েলি দখলদারত্বের বিরুদ্ধে বয়কট, বিনিয়োগ প্রত্যাহার ও নিষেধাজ্ঞা (বিডিএস) আন্দোলন চলছে। এ আন্দোলনের তিনটি উদ্দেশ্য হলো—১. গাজা ও পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি দখলদারত্বের অবসান; ২. প্রাচীর তুলে অবাধ যাতায়াতের ব্যবস্থা করা ও ৩. ইসরায়েলে অবস্থানরত প্যালেস্টাইনিদের সমানাধিকার ও বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের প্রত্যাবর্তনের সুযোগ প্রদান। 

টাইমস হায়ার এডুকেশনের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী শিক্ষাবিদরা ইসরায়েল কর্তৃক গাজায় ‘শিক্ষা হত্যা’ (এডুসাইড)-এর অভিযোগ এনেছে। সেখানে ৯০ শতাংশ স্কুল ধ্বংস করা হয়েছে; বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে; ৯৪ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ ২৩১ জন শিক্ষক ও শিক্ষা প্রশাসককে হত্যা করা হয়েছে। এর প্রতিবাদে শিক্ষাবিদরা ইসরায়েলের সঙ্গে শিক্ষা সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি জানিয়েছেন। 

দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইসরায়েল, তার সমর্থক কোম্পানির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার সুস্পষ্ট পার্থক্য হলো যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, কতিপয় ইউরোপীয় দেশের ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতি প্রকাশ্য এবং সৌদি আরব, মিসর ও আরব আমিরাতের ন্যায় দেশের গোপন সমর্থন। এসব দেশ বয়কট সফল না হতে দেয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আবার ইসরায়েলের জায়নবাদী সমর্থকরা চলমান বয়কট, বিনিয়োগ প্রত্যাহার ও নিষেধাজ্ঞা আন্দোলনকে ‘অ্যান্টি-সেমিটিক’ অবিহিত করে বাধা দিচ্ছে। 

স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, ইসরায়েলে বসবাসকারী ফিলিস্তিনিদের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা ও অবাধ যাতায়াতের ব্যবস্থা, শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত চলমান আন্দোলন সফল হয়েছে বলা যাবে না। 

বাংলাদেশে বয়কট আন্দোলন: বাংলাদেশে বয়কট আন্দোলনের তিনটি ধারা রয়েছে। 

এক. ইসরায়েল ও তার সমর্থক কোম্পানির পণ্য বয়কটের বৈশ্বিক আন্দোলনের সঙ্গে বাংলাদেশীরা সংহতি প্রকাশ করেছে। বাটাসহ বিভিন্ন ইসরায়েলি ও ইসরায়েল সমর্থক কোম্পানির পণ্য যেমন কোকা-কোলা বয়কট চলছে। 

দুই. বাংলাদেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ, অসম বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক, সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা, দেশের নদীগুলোর মরুকরণ ও ভারতে মুসলিমবিরোধী তৎপরতার প্রতিবাদে বাংলাদেশীদের একাংশ ভারতীয় পণ্য, যেমন সার্ফ এক্সেল, প্যারাস্যুট নারিকেল তেল, ভারতীয় পেঁয়াজ প্রভৃতি পণ্য কেনা থেকে বিরত থেকে অন্যদের ভারতীয় পণ্য বর্জনের দাবি জানাচ্ছে। অন্যদিকে সরকার ও তার সমর্থকরা এ আন্দোলনকে বাজারকে অস্থিতিশীল করার পাকিস্তানি চক্রান্ত বলে অবিহিত করে এর প্রতিবাদ জানিয়েছে ও বর্জনকারীদের বর্জনের দাবি জানিয়েছে। 

তিন. বয়কটের ধারায় বাংলাদেশে নতুন সংযোজন হলো, সিন্ডিকেটের পণ্য বর্জন। সম্প্রতি তরমুজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে ক্রেতারা তরমুজ কেনা থেকে বিরত থাকে। ফলে পচনশীল এ পণ্যের দাম কমে আসে। আমদানীকৃত খেজুরের ক্ষেত্রেও এ প্রচেষ্টা আংশিক সফল হয়েছে। এছাড়া যেকোনো পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি হলে ক্রেতারা এর ব্যবহার ও কেনা কমিয়ে দিয়ে সিন্ডিকেটের সাফল্যের পথের কাঁটা হয়েছে।

বয়কট সফল হবে কিনা তা নির্ভর করে এর ব্যাপকতা ও দেশের ভেতরে-বাইরে এর প্রতিক্রিয়ার ওপর। ফলাফল যা-ই হোক না কেন, অন্যায়ের প্রতিবাদ হিসেবে সাধারণ জনগণ ও ক্রেতার হাতের এ সর্বশেষ অস্ত্র, বয়কট থেরাপির ব্যবহার চলতে থাকুক এবং অন্যায়কারীরা এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুক ও তাদের আচরণ শুধরে নিক। 

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: অর্থনীতিবিদ ও সাবেক সচিব


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫