ব্যাংকের সিএসআর ব্যয়ের ৪৪ শতাংশই ‘অন্যান্য’ খাতে

প্রকাশ: মার্চ ২৮, ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশের ব্যাংকগুলোর করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) খাতে ব্যয়ের বড় অংশজুড়েই ছিল শিক্ষা। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় হতো শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবৃত্তি প্রদানে। সিএসআর ব্যয়ের ধরনে এখন বেশ পরিবর্তন এসেছে। বেশির ভাগই ব্যয় হচ্ছে ‘অন্যান্য’ খাতে; যার মধ্যে রয়েছে আয়-উৎসারী কার্যক্রম, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো উন্নয়ন, ক্রীড়া ও সংস্কৃতিসহ আরো বেশকিছু কর্মকাণ্ড। 

সিএসআর খাতে গত বছর ব্যাংকগুলো ব্যয় করেছে ৯২৪ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। এর মাত্র ১৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ গেছে শিক্ষায়। সবচেয়ে বড় খাতটি ছিল ‘অন্যান্য’, যেখানে ৪৪ শতাংশেরও বেশি অর্থ ব্যয় করেছে ব্যাংকগুলো। সিএসআর কার্যক্রম-সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, মোট সিএসআর ব্যয়ের প্রায় ৯৭ শতাংশই করেছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। এ খাতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অংশগ্রহণ ১ শতাংশেরও অনেক কম। আর বিদেশী ব্যাংকগুলোর ব্যয়ও নামমাত্র। ২০২৩ সালে সিএসআর ব্যয়ের দিক থেকে শীর্ষস্থানে ছিল ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি। দেশের বৃহত্তম এ ব্যাংকটি গত বছর ৯৯ কোটি ৭৮ লাখ টাকা ব্যয় করেছে এ খাতে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৯৩ কোটি ৭৪ লাখ টাকা ব্যয় করে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক। তৃতীয় স্থানে থাকা যমুনা ব্যাংকের ব্যয় ছিল ৫৬ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। এ খাতে ব্যয়ের দিক থেকে শীর্ষ দশে থাকা অন্য ব্যাংকগুলো হলো মার্কেন্টাইল, শাহ্‌জালাল, আল-আরাফাহ্‌, এক্সিম, সাউথইস্ট, ইউসিবি ও ব্যাংক এশিয়া।

সিএসআর হলো এক ধরনের ব্যবসায়িক শিষ্টাচার বা রীতি, যা সমাজের প্রতি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালনকে নিয়মের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পরিচালিত কার্যক্রমের ফলে উদ্ভূত বিভিন্ন ধরনের পরিবেশগত বিরূপ প্রভাব দূর করা ও সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে বিদ্যমান ক্ষোভ, অসমতা ও দারিদ্র্য কমানোর উদ্দেশ্যেই এর প্রবর্তন। বর্তমানে সারা বিশ্বেই এ খাতে ব্যয়কে করপোরেট প্রতিষ্ঠানের অন্যতম দায়িত্ব হিসেবে দেখা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো প্রজ্ঞাপন জারি করে সিএসআর খাতে ব্যয়ের জন্য ব্যাংকগুলোকে দিকনির্দেশনা দেয়। তারপর একাধিকবার প্রজ্ঞাপন জারি করে এর খাত ও বিধিমালা দেয়া হয়। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ২০২২ সালের ৯ জানুয়ারি জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের মোট সিএসআরের ৩০ শতাংশ শিক্ষায়, ৩০ শতাংশ স্বাস্থ্যে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রশমন ও অভিযোজন খাতে ২০ শতাংশ এবং অন্যান্য খাতে ২০ শতাংশ অর্থ ব্যয় করার নির্দেশনা দেয়া হয়। একই বছরের ২৯ নভেম্বর এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বলা হয়, মোট সিএসআর ব্যয়ের ৫ শতাংশ অনুদান হিসেবে দিতে হবে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট তহবিলে। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এসব নির্দেশনা যদিও ব্যাংকগুলো মেনে চলেনি। সিএসআর ব্যয়ের ৩০ শতাংশ শিক্ষায় ব্যয় করার কথা থাকলেও গত বছর এ খাতে গেছে মাত্র ১৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ অর্থ। স্বাস্থ্যে ৩১ দশমিক ২৬ শতাংশ অর্থ ব্যয় হলেও পরিবেশ ও জলবায়ু খাতে মাত্র ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ ব্যয় হয়েছে। অন্যান্য খাতে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ ব্যয়ের কথা থাকলেও এ খাতে গেছে ৪৪ দশমিক ১৫ শতাংশ অর্থ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর ব্যাংকগুলো দেশের শীতার্ত ও দরিদ্র মানুষের মধ্যে কম্বল বিতরণের জন্য ‘প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল’-এ ৬৯ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে। ক্রীড়া ও সংস্কৃতি উপখাতে ব্যয় করেছে ১৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা। বঙ্গবন্ধুর জীবনী নিয়ে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য জাতির জনক বিএসএমআর মেমোরিয়াল ট্রাস্ট, অনূর্ধ্ব-১৬ টুর্নামেন্ট আয়োজনে শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদ, শেখ কামাল দ্বিতীয় বাংলাদেশ ইয়ুথ গেমস উদযাপনে বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন এবং ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ম্যারাথন-২০২৪ টুর্নামেন্ট’ উদযাপনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অনুকূলে এ অর্থ অনুদান হিসেবে দেয়া হয়েছে। 

শিক্ষা খাতে ব্যয় করা অর্থে বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান, শিক্ষা উপকরণ ও অবকাঠামো নির্মাণের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষাসহায়তা ট্রাস্টে অনুদান দেয়া হয়। স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের একটি অংশ দেয়া হয়েছে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নির্মাণে। পরিবেশ ও জলবায়ু খাতে ব্যয়ের কিছু অংশ ‘প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্প-২’ তহবিলে দেয়া হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সিএসআর খাতে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ও যমুনা ব্যাংকের পরই সর্বোচ্চ ব্যয় করেছে মার্কেন্টাইল ব্যাংক, ৫৫ কোটি ৯২ লাখ টাকা। এ ব্যয়ের দিক থেকে শীর্ষ দশে থাকা অন্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে শাহ্‌জালাল ইসলামী ব্যাংক ৫৩ কোটি ৬১ লাখ, আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংক ৫১ কোটি ৩১ লাখ, এক্সিম ব্যাংক ৪৩ কোটি ৯৩ লাখ, সাউথইস্ট ব্যাংক ৩৯ কোটি ৬৯ লাখ, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) ৩৮ কোটি ৪০ লাখ ও ব্যাংক এশিয়া ৩২ কোটি ৬২ লাখ টাকা ব্যয় করে।

সিএসআর ব্যয়ে শীর্ষে থাকা ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই সিএসআর খাতে সর্বোচ্চ অর্থ ব্যয় করে আসছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেখানো ব্যয়ের বাইরেও এ খাতে আমাদের অনেক অর্থ ব্যয় হয়। বিশেষ করে ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের আওতায় সারা দেশে হাসপাতাল পরিচালিত হচ্ছে। হাসপাতালগুলোয় স্বল্প মূল্যে চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়।’

বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে গত বছর এনসিসি ব্যাংক ৩১ কোটি ৫৪ লাখ, ইস্টার্ন ব্যাংক ২৯ কোটি ৩৯ লাখ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ২৭ কোটি ৯৬ লাখ, ইউনিয়ন ব্যাংক ২৭ কোটি ৫৪ লাখ, দ্য প্রিমিয়ার ব্যাংক ১৯ কোটি ৮ লাখ, প্রাইম ব্যাংক ১৯ কোটি, পূবালী ব্যাংক ১৭ কোটি, ঢাকা ব্যাংক ১৫ কোটি ৫৪ লাখ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ১২ কোটি ৫৫ লাখ ও আইএফআইসি ব্যাংক ১২ কোটি ২৭ লাখ টাকা সিএসআরে ব্যয় করেছে। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের এমডি মো. কামরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা সিএসআরের অর্থ ব্যয় করছি। আমাদের ব্যাংকের শিক্ষাবৃত্তি বেশ জনপ্রিয়। আবার কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে পাওয়ার টিলারসহ কৃষিযন্ত্র ও সার বিতরণও করা হচ্ছে। সিএসআরের অর্থে আমরা একটি হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছি। এরই মধ্যে রাজউকের পক্ষ থেকে উত্তরায় এক বিঘা জমি বরাদ্দ পেয়েছি।’

একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী যদিও জানান, আগে দেশের ১৫-২০টি বেসরকারি ব্যাংক শিক্ষাবৃত্তি দিত। এসব বৃত্তির মাধ্যমে দরিদ্র ও মেধাবী অনেক শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পেরেছে। কিন্তু ২০১৯ সালের পর থেকে বেশির ভাগ ব্যাংকেরই শিক্ষাবৃত্তি বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণে সংকুচিত হয়ে এসেছে দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষার পথ।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫