আলোকপাত

খেলাপি ঋণ আদায়ে নতুন নীতিমালা এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২৯, ২০২৪

ড. শহীদুল জাহীদ 

সম্প্রতি ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমানোর নিমিত্তে কিছু নীতিমালা প্রণয়ন করেছে এবং তা ঘটা করেই সম্প্রচার করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে এ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা বাংলাদেশ ব্যাংক যে নীতিমালা ঘোষণা করেছে তা এর আগে প্রণীত বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের ‘রোডম্যাপ’, যা ২০২৬ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, তারই অংশবিশেষ। রোডম্যাপে ২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ব্যাংক খাতে সুনির্দিষ্ট কিছু সংস্কার এবং বিদ্যমান খেলাপি ঋণের হার ৮ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে। 

ঘোষিত খেলাপি ঋণ কমানোর নীতিমালায় বেশকিছু শর্ত শিথিলের কথা বলা হয়েছে। প্রধানতম শর্ত হচ্ছে, এখন থেকে যেকোনো বাণিজ্যিক ব্যাংকের মন্দ ঋণ অবলোপনের সময়সীমা কমানো। বলা হয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক তাদের হিসাবে দেখানো ‘মন্দ ও ক্ষতিজনক মানে খেলাপি ঋণ’ টানা দুই বছর পর অবলোপন হিসাবে স্থানান্তর করতে পারবে। বলা বাহুল্য, ব্যাংকগুলো এর আগে টানা তিন বছর কোনো ঋণ মন্দ ও ক্ষতিজনক থাকলে অবলোপন করতে পারত। আপাতদৃষ্টিতে শুধু সময়ের মাপকাঠি কমানোর কথা বলা হলেও এর সুদূরপ্রসারী অর্থ এবং হিসাবের মারপ্যাঁচ আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্রমতে, ঋণ অবলোপনের শুধু সময়সীমা কমানোর মাধ্যমেই ব্যাংক খাতে সামগ্রিকভাবে খেলাপি ঋণ কমবে প্রায় ২ শতাংশ, যা টাকার অংকে প্রায় ৪৩ হাজার ৫০০ কোটিরও ওপরে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ঋণ অবলোপনের সময়সীমা তিন বছর থাকায় কোনো ব্যাংকের খেলাপি বা কু-ঋণের হার যদি হয় ১০ শতাংশ, বর্তমানের দুই বছরের সময়সীমা অনুযায়ী ব্যাংকের কু-ঋণের হার দাঁড়াবে ৮ শতাংশ। অর্থাৎ আক্ষরিক অর্থে কোনো প্রচেষ্টা ছাড়াই ব্যাংক তাদের কু-ঋণ কমাতে সক্ষম হবে শতকরা ২ ভাগ। হিসাববিদ্যার আশ্চর্য তেলেসমাতি ছাড়া এ এক প্রচেষ্টাসাধ্য বিষয়। 

খেলাপি ঋণ আদায়ে ঘোষিত নতুন নীতিমালায় ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় কিছু কড়াকড়ি এবং কিছু প্রণোদনার কথাও উল্লেখ আছে। যেমনটি বলা হয়েছে যে প্রত্যেক বাণিজ্যিক ব্যাংক খেলাপি ঋণ আদায়ে নিজ নিজ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) নেতৃত্বে ‘অবলোপনকৃত ঋণ আদায় ইউনিট’ গঠন করবে। ওই অবলোপনকৃত ঋণ আদায় ইউনিটে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পারফরম্যান্স বা দক্ষতার ভিত্তিতে তাদের নিয়োগ বা পুনর্নিয়োগের বিষয়টি প্রাধান্য পাবে মর্মে নীতিমালায় বলা হয়েছে। নীতিমালায় ব্যাংক ব্যবস্থাপকদের প্রণোদনার বিষয়টি সুস্পষ্ট। অবলোপনকৃত ঋণের আদায়কৃত অংশ ব্যাংক একাধারে আয় হিসেবে দেখাতে পারবে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তারা ৫ শতাংশ হারে প্রণোদনা পাবেন। ৫ শতাংশ প্রণোদনার একটি সুনির্দিষ্ট অংশ ব্যবস্থাপনা পরিচালকের জন্য কোটা হিসেবে সংরক্ষিত থাকবে। খেলাপি ঋণ আদায়ে ঘোষিত নীতিমালার আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ব্যাংক কর্তৃপক্ষ অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের মন্দ ঋণ আদালতে মামলা ছাড়াই কু-ঋণ হিসাবে অবলোপন করতে পারবে। মামলাজট থেকে বেরিয়ে এমন নির্দেশনার কারণে ৫ লাখ টাকা বা তার কম অংকের মন্দ ঋণগুলো অবলোপনের নীতিমালায় ব্যাংক ব্যবস্থাপনার অবস্থানকে প্রকারান্তরে শক্তিশালী করা হয়েছে। 

বাংলাদেশে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হার আশঙ্কাজনক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্রমতে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর নাগাদ খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকারও বেশি, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে যা ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। গত এক বছরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা, যা শতাংশের হিসাবে প্রায় ২০ শতাংশের বেশি। এ দেশে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির হার ক্রমবর্ধমান। প্রতিবেশী দেশ ভারতে খেলাপি ঋণের হার ৩ দশমিক ৯ শতাংশ এবং পাকিস্তানে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। কথিত ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশ শ্রীলংকায় এ হার ১০ শতাংশের একটু বেশি। সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের হার গত ডিসেম্বরে ৯ শতাংশের কথা বলা হলেও অন্যান্য তথ্যমতে এ হার ১১ শতাংশের মতো। 

খেলাপি ঋণের হার বা তার পরিসংখ্যানগত তারতম্য থাকলেও খেলাপি ঋণ যে ব্যাংক খাতের ঘুণে পোকা, তা নিয়ে কারোরই কোনো সন্দেহ নেই। বাণিজ্যিক ব্যাংকের বিনিয়োগ তথা ঋণ ও অগ্রিম তহবিলের প্রধান উৎস হচ্ছে আমানত। বাণিজ্যিক ব্যাংক বিভিন্ন ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তাদের বর্তমান ভোগের অতিরিক্ত অর্থ আমানত হিসেবে সংরক্ষণ করে থাকে। আমানতকৃত অর্থের সুরক্ষা প্রদান ব্যাংকের অন্যতম মূলনীতি এবং পবিত্র দায়িত্ব। ব্যবসার প্রয়োজনে বাণিজ্যিক ব্যাংক আমানত হিসেবে সংরক্ষিত অর্থ ঋণ হিসেবে বিনিয়োগ করে থাকে। আমাদের সমাজেরই বিভিন্ন অংশীজন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিভিন্নভাবে অর্থনীতিতে অবদান রেখে থাকেন। শিল্প-বাণিজ্যের বিকাশের পাশাপাশি অনেকে ভোক্তা ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে ব্যক্তি এবং সামাজিক ও জাতীয় জীবনে তাদের চাহিদা পূরণ করে থাকেন। ঋণ গ্রহণের জন্য তাই গ্রহীতা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে ব্যাংকের দ্বারস্থ হন। অনেক সময় ঋণপ্রাপ্তির জন্য ঋণগ্রহীতা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার পাশাপাশি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কাছে বিভিন্নভাবে তদবিরও করে থাকেন। 

প্রশ্ন হলো, প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ এসব ঋণ নেয়ার পর ঋণগ্রহীতার ঋণ পরিশোধে বিমুখিতার কারণ কী? সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে, ঋণগ্রহীতাদের চার ভাগে ভাগ করা যায়। ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য ও ঋণ পরিশোধের ইচ্ছানুপাতের নিরিখে এ বিভাজন করা হয়ে থাকে। প্রথম ভাগের ঋণগ্রহীতাদের ইচ্ছা থাকলেও উপায় নেই। অর্থাৎ এসব ঋণগ্রহীতা জনগণের কাছে সজ্জন বলে পরিচিত। যেকোনো কারণে তাদের ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য নেই। ব্যক্তি বা তার প্রতিষ্ঠান এমনকি সামষ্টিক অর্থনীতির মন্দ প্রভাবে এ ধরনের ঋণগ্রহীতা ইচ্ছা থাকলেও সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হন। সময়ের আবর্তে এসব ঋণ খেলাপি ঋণ হিসাবে তালিকাভুক্ত হয়।

দ্বিতীয় ধরনের ঋণগ্রহীতা এমন যে তাদের ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য আছে, কিন্তু তারা ঋণ পরিশোধে ইচ্ছুক নন। এসব ঋণগ্রহীতা গৃহীত ঋণ পরিশোধ করতে বিভিন্ন টালবাহানা করে থাকে। অনেক সময় তারা তাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং রাজনৈতিক পদ-পদবি ও অবস্থান, পেশিশক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করে না। এসব ঋণগ্রহীতা কখনো কখনো ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে অশুভ আঁতাতের মাধ্যমেও ঋণ পরিশোধে বিরত থাকে। এসব ঋণ প্রকারান্তরে মন্দ ঋণ হিসেবে স্থানান্তরিত হয়ে থাকে। 

তৃতীয় ধরনের ব্যাংক ঋণ গ্রহীতা এমন যে তাদের ঋণ পরিশোধের ইচ্ছা ও সামর্থ্য কোনোটিই নেই। এসব ঋণগ্রহীতা ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক দুর্যোগ এবং অব্যবস্থাপনার কারণে অর্থনৈতিকভাবে মন্দাবস্থায় পতিত হন। ব্যক্তি ও সামাজিকভাবে তাদের অবস্থান যা-ই হোক না কেন, তারা ব্যাংকের কাছে কোনোভাবেই কাম্য ঋণ গ্রাহক নন এবং তাদের গৃহীত ঋণও একটা পর্যায়ে খেলাপি ঋণের তালিকায় পড়ে। 

চতুর্থ ধরনের ঋণগ্রহীতা যারা তাদের ব্যাংক ঋণ পরিশোধের সামর্থ্যের পাশাপাশি ঋণ পরিশোধের ইচ্ছাও বিদ্যমান থাকে। এসব ঋণগ্রহীতা সময়মতো ঋণের কিস্তি পরিশোধের পাশাপাশি প্রয়োজনে ব্যাংকের কাছ থেকে অতিরিক্ত ঋণ নেয় এবং সুদে-আসলে পরিশোধ করে। একমাত্র এ ধরনের ঋণগ্রহীতারা ব্যাংকের কাছে কাঙ্ক্ষিত কাস্টমার হিসেবে পরিগণিত হয়। বলা বাহুল্য, এ ধরনের ঋণগ্রহীতার সংখ্যা সমাজে খুব বেশি নয়। 

এ বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে যে বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রতি চারজন কাস্টমার তথা ঋণগ্রহীতার মধ্যে তিনজনই মন্দ বা অনাকাঙ্ক্ষিত কাস্টমার বা ঋণগ্রহীতা। শতকরা হিসেবে প্রায় ৭৫ শতাংশ ঋণগ্রহীতাই ব্যাংকের কাছে ঝুঁকিপূর্ণ। কেবল ২৫ শতাংশ ঋণগ্রহীতা সময়মতো ঋণের সুদ এবং আসল পরিশোধে সক্রিয় থাকেন।

সুতরাং বিতরণকৃত ঋণের ৭৫ শতাংশই ঝুঁকিপূর্ণ বিধায় ব্যাংক ব্যবস্থাপকদের এমনিতেই অনেক সতর্ক থাকতে হয়। সতর্কতার পাশাপাশি ব্যাংক ব্যবস্থাপকরা ঋণ আদায়ে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকেন। সব ব্যাংকের সব পদক্ষেপ সব ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ হয়ে থাকে এমনও নয়। এ কারণেই কোনো কোনো ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার তুলনামূলক বেশি। বেসরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর তুলনামূলক চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার বেসরকারি ব্যাংকের তুলনায় বেশি। ব্যাংকের উচ্চ খেলাপি ঋণের কারণ হিসেবে তাই ব্যাংক ব্যবস্থাপকদের নৈতিক বিপত্তি তথা ‘মোরাল হ্যাজার্ড’ ও অদক্ষতাকে অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে খেলাপি ঋণ কমানোর নিমিত্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষিত নীতিমালা কতটুকু কার্যকর এবং তার সুফল আদতে ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান তথা সামগ্রিক অর্থনীতিতে পড়বে কিনা? খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য ঘোষিত নীতিমালায় বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্দেশ্য মহৎই বলতে হবে। ঘোষিত ‘রোডম্যাপ’ অনুযায়ী ২০২৬ সাল নাগাদ এ দেশে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হার ৮ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে পারলে ব্যাংক খাতের প্রতি জনগণের আস্থা আরো দৃঢ় হবে। ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সামষ্টিক অর্থনীতির ভিত্তি দৃঢ়তর হবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ধরনের সফলতা বলেই তা বিবেচিত হবে। কিন্তু খেলাপি ঋণ কমানোর ঘোষিত নীতিমালায় প্রথমেই যে প্রশ্নটির আলোচনা এবং তার নিষ্পত্তির প্রয়োজন তা হলো, ব্যাংক খাতে খেলাপি বা কু-ঋণের কারণগুলো সঠিকভাবে নির্ণয় করা হয়েছে কিনা? সঠিকভাবে কারণগুলো নির্ণয় না করলে এ প্রচেষ্টা খুব বেশি ফলপ্রসূ হবে বলে মনে হয় না। 

ড. শহীদুল জাহীদ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫