আফ্রিকার চিত্রকলায় আত্মপরিচয়ের অন্বেষণ

প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২৪

আহমেদ দীন রুমি

সভ্যতার সূতিকাগার আফ্রিকা। মানবজাতির দীর্ঘ যাত্রাপথের বহুমাত্রিক স্বাক্ষর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সেখানে। প্রাকৃতিক কারণেই সেখানকার শিল্পচর্চার ধারাও বৈচিত্র্যপূর্ণ। আধুনিক সময়ে ঐতিহ্যের সঙ্গে সংমিশ্রণ ঘটেছে উদ্ভাবনের। বিখ্যাত শিল্পী হোক কিংবা উদীয়মান তরুণ—শৈল্পিক অভিব্যক্তি প্রতিনিয়ত ছাড়িয়ে যাচ্ছে শিল্পের তথাকথিত গণ্ডি। আধুনিক কৌশলের সঙ্গে শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যকে মিশিয়ে শিল্পীরা নতুন সংজ্ঞা দিচ্ছেন ল্যান্ডস্কেপকে। মুগ্ধ করছেন বিশ্বব্যাপী শিল্পামোদী ও বোদ্ধাদের। তাদের হাত ধরেই সমসাময়িক আফ্রিকান শিল্প হয়ে উঠেছে গল্প বলার এবং সাংস্কৃতিক সংরক্ষণের এক শক্তিশালী মাধ্যম।

আফ্রিকার ঐতিহ্যবাহী ফর্ম শিল্পীদের অনুপ্রাণিত ও প্রভাবিত করে চলেছে আজ অব্দি। এ রকম একটি শিল্প নাইজেরিয়ান টেক্সটাইল আর্ট, যা প্রাণবন্ত রঙ ও জটিল নিদর্শনের জন্য পরিচিত। Adire নামে পরিচিত রেজিস্ট-ডাইং কৌশল প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসছে সেখানে। আধুনিক শিল্পীরা তা গ্রহণ করেছেন এবং যুক্ত করেছেন আধুনিক নকশা ও নান্দনিকতা। ফলে একদিকে যেমন ঐতিহ্য সংরক্ষণের সুযোগ তৈরি হয়েছে, পাশাপাশি জন্ম নিয়েছে উত্তেজনাপূর্ণ কিছু তৈরির সুযোগ। এ রকম আরেকটি উদাহরণ হতে পারে দক্ষিণ আফ্রিকার পুঁতির কাজ। সেখানকার সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে পুঁতির কাজ ব্যবহার হয় পোশাকে। যদিও হাল আমলে আফ্রিকার শিল্পীরা তাদের ভাস্কর্য ও ইনস্টলেশনের মধ্যেও পুঁতির কাজ অন্তর্ভুক্ত করছে। দৃশ্যত অত্যাশ্চর্য এবং সাংস্কৃতিকভাবে উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্ম দূর করেছে অতীত ও বর্তমানের মধ্যকার ব্যবধান। সমসাময়িক শিল্পে ঐতিহ্যের এমন তাসির নাইজেরিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার বাইরেও বিস্তৃত। ঘানার আকান জনগণের কাঠের খোদাই থেকে শুরু করে কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের কুবা জনগণের ঝুড়ি বুনন কৌশল পর্যন্ত মহাদেশজুড়ে ঐতিহ্যবাহী শিল্পের রূপগুলোকে হালের শিল্পীরা নতুনভাবে কল্পনা ও পুনর্ব্যাখ্যা করছেন, যা বহু পুরনো অভ্যাসের মধ্যে নতুন প্রাণ ফুকে দিচ্ছে।

সাম্প্রতিক দিনগুলোয় আফ্রিকান শিল্পীরা তাদের প্রতিভা ও সৃজনশীলতা দ্বারা বিশ্বব্যাপী শিল্পপ্রেমীদের মুগ্ধ করেছে। প্রতিষ্ঠিত প্রতিভা থেকে উদীয়মান মুখ পর্যন্ত এ প্রবণতা বিস্তৃত। তাদের অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি ও শৈল্পিক দক্ষতার জন্য স্বীকৃতি অর্জন করেছে। এমনই একজন শিল্পী হলেন ঘানার এল আনাতসুই। ফেলে দেয়া বোতলের ক্যাপ থেকে তৈরি তার শিল্পকর্ম আন্তর্জাতিক প্রশংসা অর্জন করেছে। শিল্পকর্মে তিনি সমবেত করেছেন আত্মপরিচয়ের নানা সূত্র। সারা বিশ্বের বিখ্যাত গ্যালারি ও জাদুঘরে প্রদর্শিত হচ্ছে। দক্ষিণ আফ্রিকার জেনেল মুহোলির কথাও আনা যেতে পারে এক্ষেত্রে। মুহোলির কাজ লন্ডনের টেট মডার্ন ও নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টসহ বিখ্যাত শিল্পপ্রতিষ্ঠানে প্রদর্শিত হয়। তার কাজেও উঠে এসেছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর। মাল্টিমিডিয়া ইনস্টলেশন থেকে শুরু করে বিমূর্ত পেইন্টিং পর্যন্ত, আফ্রিকান শিল্পীরা তাদের গল্প বলার জন্য ধরাবাঁধা সীমানাকে অতিক্রম করে যাচ্ছে। বিদ্যমান অচলাবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে ব্যবহার করছে নিজ নিজ প্লাটফর্ম।

আফ্রিকান শিল্প থিম এবং মোটিফে সমৃদ্ধ, যেন খোদ মহাদেশের ব্যাপ্তি ও বৈচিত্র্যকেই প্রতিফলিত করে। সমসাময়িক আফ্রিকান শিল্পীরা ইতিহাস, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাসহ বিভিন্ন উৎস থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে এমন শিল্পকর্ম তৈরি করে চলছেন। আফ্রিকান শিল্পে একটি প্রচলিত থিম হলো আত্মপরিচয়ের অন্বেষণ। দ্রুত পরিবর্তনশীল দুনিয়ায় একজন আফ্রিকান হওয়ার অর্থ কী, তা পরীক্ষা করছেন সেখানকার শিল্পীরা। তাদের শিল্পকর্মের মাধ্যমে আফ্রিকান পরিচয়ের নানা দিক তুলে ধরে। আরেকটি পুনরাবৃত্তিমূলক মোটিফ হলো সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়াবলি। শিল্পীরা তাদের সৃজনশীল প্লাটফর্মগুলোকে লিঙ্গবৈষম্য, জাতিগত বৈষম্য ও পরিবেশগত অবক্ষয়ের মতো উদ্বেগকে মোকাবেলা করতে ব্যবহার করেন। শিল্পকর্মগুলো জনমনে সচেতনতা বৃদ্ধি, অনুপ্রেরণা ও সামাজিক পরিবর্তনকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করার জন্য শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। প্রকৃতি ও আধ্যাত্মিকতাও সমসাময়িক আফ্রিকান শিল্পকর্মে ঘুরেফিরে আসা থিম। শিল্পীরা শ্বাসরুদ্ধকর ল্যান্ডস্কেপ, বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ ও প্রাণিজগৎ এবং আফ্রিকা মহাদেশকে সংজ্ঞায়িত করে প্রাচীন আধ্যাত্মিক অনুশীলন থেকে অনুপ্রেরণা পান। শিল্পকর্মের মাধ্যমে তারা আফ্রিকান পরিবেশের সৌন্দর্য এবং স্থিতিস্থাপকতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মানুষ ও তাদের প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে আন্তঃসংযোগ অন্বেষণ করে।

আর্টের পৃষ্ঠপোষকতার স্বাক্ষর হিসেবেই আফ্রিকায় গড়ে উঠছে আর্ট গ্যালারি ও মিউজিয়াম। সেখানে আফ্রিকান শিল্পীদের কাজ প্রদর্শন এবং মহাদেশের শৈল্পিক ঐতিহ্য প্রচারের জন্য নিবেদিত। এমনই এক প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে জাইতজ মিউজিয়াম অব কনটেমপোরারি মডার্ন আর্ট (Zeitz MOCAA)। জাদুঘরটি আফ্রিকার মাটিতে সমসাময়িক শিল্পীদের সৃষ্টিকর্ম প্রদর্শনের জন্য নিবেদিত। বিস্তৃত সংগ্রহ এবং বিভিন্ন প্রদর্শনীর পাশাপাশি Zeitz জাদুঘরটি শিল্প উৎসাহী এবং সংগ্রাহকদের জন্য একটি কেন্দ্র হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে যারা আফ্রিকান শিল্পের সর্বশেষ প্রবণতা এবং প্রতিভাগুলো জানতে চান। কাছাকাছি আরেকটি উল্লেখযোগ্য আর্ট গ্যালারি হলো নাইজেরিয়ার ওমেনকা গ্যালারি। ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত আর্ট গ্যালারিটি নাইজেরিয়া ও আফ্রিকার শিল্পের প্রচারে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। মহাদেশের সৃজনশীলতা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে প্রতিবিম্বিত করে, এমন সব প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। উদীয়মান শিল্পীদের সমর্থন ও শৈল্পিক সংলাপকে উৎসাহিত করার জন্য ওমেনকা গ্যালারি আফ্রিকান শিল্পকলার চর্চায় একটি উল্লেখযোগ্য অনুঘটক হয়ে উঠেছে। এ দুটি মিউজিয়ামের পাশাপাশি সক্রিয়ভাবে আরো অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে, যারা সমসাময়িক আফ্রিকান শিল্পীদের কাজগুলো প্রদর্শনের জন্য প্লাটফর্ম প্রদান করছে। প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু সাংস্কৃতিক ল্যান্ডমার্ক হিসেবে কাজ করে না বরং স্থানীয় শিল্প দৃশ্যের অর্থনৈতিক বৃদ্ধিতেও অবদান রাখে, সারা বিশ্ব থেকে পর্যটক ও সংগ্রাহকদের আকর্ষণ করে।

সমসাময়িক আফ্রিকান শিল্পে সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা মোকাবেলা করার ক্ষমতা রয়েছে। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ সুদানের শিল্পী ইব্রাহিম এল-সালাহির কাজ। তার চিত্রকর্ম সেখানকার রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অভিজ্ঞতা এবং পর্যবেক্ষণকে প্রতিফলিত করে। এল-সালাহি সুদানের জনগণের মুখোমুখি সংগ্রাম সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ান। প্রতিকূলতার মুখেও প্রাসঙ্গিক করে তোলেন সাংস্কৃতিক সংরক্ষণের গুরুত্ব। আফ্রিকার আরেক শিল্পী কেনিয়ার ফটোগ্রাফার ও অ্যাক্টিভিস্ট জেমস মুরিউকি। শক্তিশালী ফটোগ্রাফির মাধ্যমে তিনি নগরায়ণ, বৈষম্য ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের ওপর বিশ্বায়নের প্রভাবের মতো সমস্যাগুলোকে তুলে আনছেন। তার কাজগুলো কেনিয়া এবং বৃহত্তর আফ্রিকা মহাদেশের মুখোমুখি সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যাগুলোর একটি চাক্ষুষ ভাষ্য হিসেবে কাজ করে। সমসাময়িক আফ্রিকান শিল্পকর্ম সংগ্রহ এবং বিনিয়োগও ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সংগ্রাহক ও বিনিয়োগকারীরা আফ্রিকান সমসাময়িক শিল্পীদের মূল্য এবং সম্ভাবনাকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। আফ্রিকান শিল্পী এনজিদেকা আকুনিলি ক্রসবির কাজ আন্তর্জাতিক নিলামে রেকর্ড-ব্রেকিং দাম পেয়েছে। ক্রসবির কাজে দেখা যায় নাইজেরিয়ান ও আমেরিকান প্রভাবের অনন্য সংমিশ্রণ। সমসাময়িক আফ্রিকান শিল্পকর্মগুলোয় বিনিয়োগ শুধু আর্থিক লাভের সম্ভাবনাই দেয় না; মহাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলছে। যেহেতু বিশ্ব সমসাময়িক আফ্রিকান শিল্পের সৌন্দর্য ও তাৎপর্যকে গ্রহণ করে চলছে, তাই সেখানে শিল্পের সামগ্রিক পরিস্থিতিও ক্রমবর্ধমান। যেন আধুনিকতাকে আলিঙ্গন করে আফ্রিকাও সমৃদ্ধ করেছে বৈচিত্র্যের ঝুলি।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫