জাতীয় নির্বাচনের আগে গণহারে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেছে ব্যাংকগুলো। এর প্রভাবে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমেছে। গত ডিসেম্বর শেষে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। যেখানে সেপ্টেম্বর শেষেও ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা ছিল। সে হিসাবে গত বছরের শেষ তিন মাসে ৯ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ কমেছে। তবে বার্ষিক হিসাবে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ-সংক্রান্ত হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে তা ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকে। সে হিসাবে পুনঃতফসিল সত্ত্বেও গত বছর ২৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বেড়েছে। ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে গড় খেলাপি ঋণের হার ছিল ৯ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কম দেখাতে চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য ঋণ পুনঃতফসিলের নীতিমালা উদার করা হয়েছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এখন চাইলে নিজেরাই যেকোনো ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারছে। নীতি ছাড়ের এ সুযোগে রেকর্ড গড়েছে ব্যাংকগুলো। কেবল ২০২২ সালেই ব্যাংকগুলোর পুনঃতফসিলকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ৬৩ হাজার ৭২০ কোটি টাকা। গত বছরজুড়েও গণহারে তা অব্যাহত ছিল। বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থীদের প্রায় সবাই ঋণ পুনঃতফসিল করে নিয়েছেন। এসব কারণে ২০২৩ সালের শেষ প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমেছে।
কত কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে গত বছর, সে হিসাব এখনো চূড়ান্ত করতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে ব্যাংকগুলো প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করেছিল বলে জানা গেছে। বছরের শেষ তিন মাসে তা ২০২২ সালকেও ছাড়িয়ে গেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
ঋণ পুনঃতফসিল বাড়ায় ব্যাংক খাতে ‘স্ট্রেসড’ বা ‘দুর্দশাগ্রস্ত’ ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে দেশের ব্যাংক খাতের পুনঃতফসিলকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত মোট ঋণের ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। খেলাপি ও পুনঃতফসিলকৃত ঋণকে ‘দুর্দশাগ্রস্ত’ হিসেবে দেখায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এ হিসাবে দেশের ব্যাংকগুলোর দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ লাখ ৫৮ হাজার ৪১৩ কোটি টাকায়। অন্যদিকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আদায় অযোগ্য হওয়ায় ব্যাংকগুলো প্রায় ৬৮ হাজার কোটি টাকার ঋণ অবলোপনও করেছে। সব মিলিয়ে দেশের ব্যাংক খাতের এক-চতুর্থাংশের বেশি ঋণ এখন দুর্দশাগ্রস্ত।
আগে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত এককালীন বা ডাউন পেমেন্ট জমা দিতে হতো। কিন্তু খেলাপিদের প্রতি নমনীয় হতে গিয়ে ২০১৯ সালে এ হার ২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। যদিও ব্যাংকের প্রভাবশালী গ্রাহকরা কোনো ডাউন পেমেন্ট না দিয়েও খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ। গ্রাহকের অনুকূলে ঋণসীমা বাড়িয়ে দিয়েও ব্যাংকগুলো খেলাপি হওয়ার যোগ্য ঋণকে নিয়মিত দেখাচ্ছে।
অন্যদিকে ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষমতাও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের হাতে ছেড়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অথচ আগে ব্যাংকগুলো নিজ পর্ষদে এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব পাস করে সেটি অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠাত। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যাচাই-বাছাইয়ের পর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করত। কিন্তু গত বছরের জুলাইয়ে সে ক্ষমতা ব্যাংকগুলোর হাতে ছেড়ে দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রজ্ঞাপনটি জারি হওয়ার পর ব্যাংকগুলো নিজেদের খেয়ালখুশিমতো ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ পায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ ‘উদারতাকেই’ খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলে উল্লম্ফনের প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে চেয়েছে। আইএমএফ থেকে ঋণপ্রাপ্তির শর্তের মধ্যেও খেলাপি ঋণ কমানোর বিষয়টি রয়েছে। আবার ব্যাংকগুলোও নিজেদের স্বার্থে খেলাপি ঋণ কমানোর চেষ্টা করেছে। তার পরও খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশের ব্যাংক খাতের সুশাসন অনেক আগেই ভেঙে পড়েছে। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে ঋণের নামে জনগণের অর্থ লুণ্ঠন হয়েছে। এ কারণে পুনঃতফসিল নীতিমালা সহজ করা সত্ত্বেও ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। দেশের ব্যাংকগুলোয় দৃশ্যমান খেলাপি ঋণের চেয়ে ধামাচাপা দেয়া খেলাপি ঋণ অনেক বেশি। ব্যাংক খাত ভঙ্গুর হয়ে পড়ার প্রভাব অর্থনীতির সব ক্ষেত্রে এখন দৃশ্যমান।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ১৭ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা ছিল খেলাপি। সে হিসাবে ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের হার ৯ শতাংশ। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৬৫ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ২০ দশমিক ৯৯ শতাংশ। আর বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ছিল ৭০ হাজার ৯৮১ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এছাড়া বিদেশী ব্যাংকগুলোর ৩ হাজার ২০০ কোটি ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ৫ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা ছিল খেলাপির খাতায়।
গত ডিসেম্বর শেষে দেশের নয়টি ব্যাংক প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। এ ব্যাংকগুলো হলো রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী, বেসিক, রূপালী, বেসরকারি খাতের বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ও বিশেষায়িত প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক। এর মধ্যে কেবল ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৬৯৭ কোটি টাকা।