বিখ্যাত ছবির মডেলরা

প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ০৭, ২০২৪

সাফকাত সায়েম

প্রতিটি সৃষ্টিকর্মের পেছনে স্রষ্টা থাকে। কিন্তু হুট করেই তো আর কিছু হয়ে যায় না। সৃষ্টিকর্মের দৃশ্যমান হওয়ার আগ অবধি জড়িত থাকে বিচিত্র সব আখ্যান। আর থাকে এমন কিছু চরিত্র, যাদের অনেককেই হয়তো এখন আর কেউ মনে রাখেনি। আধুনিক চিত্রকলার প্রধান নজিরগুলো ঘাঁটলে এমন কিছু চরিত্র পাওয়া যাবে, যারা সমকালীন চিত্রশিল্পীদের অনুপ্রাণিত করেছিলেন আঁকতে।

সুজানা ভালাদোন (১৮৬৫-১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দ)

শিল্পীর অনুপ্রেরণা হতে পারাটা অনেক ক্ষেত্রেই চমকপ্রদ। কিন্তু সুজানার জন্য গল্পটা ঠিক উল্টাে। সে সময়টিতে কেবল একা নারীরাই মডেলিংকে পেশা হিসেবে বেছে নিতেন। সমাজের নিচু শ্রেণীর যে নারীরা অন্য পেশায় যেতে পারত না, তারাই সাধারণত আসত এখানে। শিল্পীর প্রয়োজনে নানা অঙ্গভঙ্গি করার মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের পথ তৈরি হতো। বিনিময়ে চরিত্রে লাগত কালিমা। মানুষ মডেলকে দেখত দেহপসারিণী হিসেবে, যে কারো মা, বোন কিংবা স্ত্রী হওয়ার যোগ্য না। সুজানা ভালাদোন এসব দেখে বেড়ে উঠলেও তৈরি করেছিলেন নিজস্ব নীতি। কৈশোরের পর থেকেই নানা ধরনের পেশায় ঢুকেছেন, কাজ করেছেন সার্কাসেও। কিন্তু মডেলে আসার পর খ্যাতি ধরা দিল। একই চরিত্রে সৌন্দর্য ও বুদ্ধির সমাবেশ নিয়ে দ্রুত নজরে আসেন রেনোঁর মতো বিখ্যাত চিত্রশিল্পীদের। ভালাদোন কাজের সময় শিল্পীর হাতের প্রতিটি নাড়াচাড়া তিনি সচেতনভাবে দেখতেন। তারপর তা অনুসরণ করতেন নিজের স্টুডিওতে। পরবর্তী সময়ে তিনি নিজেই পেইন্টিংকে বেছে নেন পেশা হিসেবে। চিত্রশিল্পী হিসেবে তার ক্যারিয়ার ছিল যথেষ্ট সফল।

ডোরা মার (১৯০৭-১৯৯৭) 

পাবলো পিকাসোর উইপিং উইম্যানসহ অনেক চিত্রকর্মেই খুঁজে পাওয়া যায় ডোরা মারকে। ম্যান রের ফটোগ্রাফেও রয়েছেন তিনি। কিন্তু খুব সম্ভবত পিকাসোর আকাশচুম্বী প্রতিভার কারণে ডোরা মার অনেকটা ফিকে হয়ে গেছেন তার পাশে কিংবা প্রত্যাশিত প্রশংসা লাভ করতে পারেননি। ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে পিকাসোর চিত্রকর্মে অনুপ্রেরণা ছিলেন ডোরা। ১৯০৭ সালে জন্মগ্রহণ করা এ নারী পড়াশোনা করেছেন প্যারিসে। সে সময় কেবল পিকাসো না, অন্যান্য প্রধান চিত্রশিল্পীও তাকে তুলে এনেছেন নিজেদের কাজে। পিকাসোর সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে ১৯৩৬ সালে। তাদের মধ্যকার সম্পর্ক দুজনের ক্যারিয়ারেই প্রভাব ফেলেছে বিস্তর। ডোরা মার পিকাসোর স্টুডিওতে গিয়ে ছবি তুলেছেন এবং পিকাসোর জন্য মডেল হিসেবে কাজ করেছেন। পিকাসোর মনুমেন্ট আ অ্যাপোলিনেয়ারের জন্য মডেল ছিলেন তিনি। তিনিই পিকাসোর গুয়ের্নিকা আঁকার বিভিন্ন ধাপকে ছবিতে আবদ্ধ করেছেন। পিকাসো যখন ছবি আঁকছিলেন, তখন ডোরাই ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি, যিনি ছবি তোলার অনুমতি পান। পিকাসো একবার বলেছেন, ‘আমার জন্য ডোরা সবসময়ই ছিল একজন ক্রন্দনরত নারী। এটা ঠাহর করাও আমার জন্য জরুরি। কারণ নারীদের সাধারণত যন্ত্রণার যন্ত্রই মনে করা হয়।’ পিকাসোর সঙ্গে তার নয় বছরের সম্পর্ক ১৯৪৩ সালে সমাপ্ত হয়। ক্রমে ফটোগ্রাফির পেশা ছেড়ে দিয়ে পেইন্টিং শুরু করেন। ১৯৯৭ সালে প্যারিসে মৃত্যুবরণ করার আগে অনবদ্য কিছু সৃষ্টিকর্ম যুক্ত করে যান চিত্রকলার ইতিহাসে। 

আলমা মাহলার (১৮৭৯-১৯৬৪)

আলমা মাহলার পরিচিত ছিলেন ভিয়েনার সবচেয়ে সুন্দরী নারী হিসেবে। মূলত একজন সংগীতশিল্পী থাকলেও তার ব্যক্তিগত জীবনের খ্যাতি সংগীতকেও ছাপিয়ে গেছে। তার পিতা আলমা ছিলেন ভিয়েনার বিখ্যাত চিত্রশিল্পী, যার চারপাশ ঘিরে থাকত ভিয়েনার সবচেয়ে সৃষ্টিশীল মানুষ। স্বাভাবিকভাবেই আলমা তার কৈশোরেই বিখ্যাত চিত্রশিল্পী গুস্তাব ক্লিমটের সঙ্গে পরিচিত হন। বয়স চল্লিশের কোঠায় থাকায় ক্লিমট ততদিনে আকাশছোঁয়া খ্যাতি অর্জন করে ফেলেছেন। ক্লিমট তার প্রেমে বিহ্বল হন। শিল্পবোদ্ধারা মনে করেন, ক্লিমটের অনেক কাজেই আলমার ছায়া ছড়িয়ে আছে। বয়স বিশের কোঠায় থাকা অবস্থায়ই আলমা বিয়ে করেন গুস্তাভ মাহলারকে। তবে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আরেক চিত্রশিল্পী অস্কার কোকোস্কার জীবনে জড়িয়ে পড়েন। অস্কারের ওপর তার প্রভাব ছিল নাটকীয়। মাত্র দুই বছর কাছাকাছি থাকা জীবনে আলমার জন্য ডজন খানেক পেইন্টিং তৈরি করেন অস্কার। কিন্তু আলমা যেন ক্রমেই ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলেন সম্পর্কটিতে, যা আর টেকেনি। 

এলিস প্রিন (১৯০১-১৯৫৩)

এলিস প্রিন পরিচিত কিকি ডি মন্টপারনাসে নামেই। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মাননি তিনি। বেড়ে উঠেছেন দারিদ্র্যের মধ্যে। সে কঠিন কঠোর বাস্তবতা থেকে বের হওয়ার জন্য তার কাছে প্রধান অস্ত্র ছিল সৌন্দর্য। সুজানা ভালাদোনের মতো তিনিও মডেলিং থেকেই উপার্জন করা শুরু করেন প্রথমে। পরিণামে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাকে ত্যাগ করে পরিবার। গৃহহীন ও একাকিত্বের মধ্যে বসবাস করতে থাকেন তিনি। নিজেকে হাজির করেন সুন্দর, স্বাধীন ও ঐতিহ্য থেকে মুক্ত সত্তা হিসেবে। সে সময় অনেক চিত্রশিল্পী তার কাছে এসেছে, যাদের একজন ম্যান রে। তার চলচ্চিত্রেও দেখা যায় এলিসকে। পরবর্তী সময়ে এলিসের আত্মকথায় ভূমিকা লিখে দিয়েছেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপজুড়ে শিল্প-সাহিত্য ও মডেলিংয়ে বিপর্যয় নেমে আসে। বিধ্বস্ত ক্যারিয়ার নিয়ে অ্যালকোহল ও ড্রাগে আসক্ত হয়ে পড়েন এলিস। তার মৃত্যুর পর শেষকৃত্যের সময় চিত্রশিল্পী শুগুহারু ফুজিতা বলেন, ‘এলিসকে কবর দেয়ার মানে আমাদের গোটা একটা যুগকে কবর দেয়া, যার মধ্যে আমরা বসবাস করতাম।’

গালা দালি (১৮৯৪-১৯৮২) 

রক্ত ছাড়া যেমন শরীর নেই, গালা ছাড়া তেমন দালি নেই—এমন একটা কথা প্রচলিত আছে বোদ্ধামহলে। ৫৩ বছর একসঙ্গে ছিলেন সালভাদর দালি ও গালা। এ দীর্ঘ জীবনে দালিকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছেন গালা। ১৯২৯ সালের গ্রীষ্মে প্রথম দেখা করেন তারা। গালা আগে বিবাহিত ছিলেন পল এলুয়ারের সঙ্গে। কিন্তু দালির সঙ্গে পরিচিত হওয়াটা সবকিছু বদলে দিল। ভালোবাসার জন্য গালা স্বামীকে ত্যাগ করেন। দালি খুঁজে পেলেন তার সৃষ্টিকর্মের অনুপ্রেরণা। প্রকৃতপক্ষে গালা যেন দালির জীবনে সৃষ্টির আশীর্বাদ হয়ে এসেছিলেন। ১৯২৯ সাল থেকেই তারা আর্টের ইতিহাসে কিংবদন্তি জুটি হিসেবে পরিগণিত। তাদের সম্পর্কও ছিল স্থিতিশীল। কেউ কারো ভেতর অবিশ্বাস জন্ম দেননি। দালির দাবি অনুসারে, তাদের ভালোবাসা ছিল প্লেটোনিক। টানাপড়েন যে ছিল না, তা না। তবে দালি গালাকে সুখী রাখতে চাইতেন। গালা অনুপ্রেরণা দিতেন তাকে। তার ছাপও দেখা যায় বিভিন্ন সৃষ্টিকর্মে। ১৯৮২ সালে মৃত্যুবরণ করেন গালা। বিচ্ছেদ দীর্ঘ হয়নি। তার মাত্র সাত বছর পরই ইহজগৎ ত্যাগ করেন দালি।

সুজি সোলিদার (১৯০০-১৯৮৩)

খুব সম্ভবত আধুনিক চিত্রকলায় সবচেয়ে বেশি পেইন্টিং আঁকা হয়েছে সুজি সোলিদারকে নিয়ে। সাধারণ পরিবারে জন্ম নেয়া সোলিদার ক্রমে একটা নাইট ক্লাবের মালিক বনে যান। পরিণত হন সমকালের শিল্পামোদীদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে। তার ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছিল তিন ডজন চিত্রকর্ম। কেউ কেউ মনে করেন, দুই শতাধিক চিত্রকর্ম আছে, যা কোনো না কোনোভাবে সোলিদারের থেকে প্রভাবিত। পিকাসো, ফুজিতা ও ব্রাকোর মতো ডজন খানেক চিত্রশিল্পীর অঙ্কন প্রভাবিত হয়েছে তার মুখাবয়বে। তবে তার সর্বশেষ পেইন্টিং অঙ্কন করেছেন ফ্রান্সিস বেকন। ১৯৫৭ সালে সোলিদার বেকনকে কাজটিতে নিযুক্ত করেন। জুয়ায় হেরে যাওয়া বেকন বাজির দেনা পরিশোধ করতেই কাজটি নেন। তবে উভয়ের জন্যই পরিণতি হয়েছিল তিক্ততা। বেকন সামনে বসিয়ে আঁকতে অপছন্দ করতেন। আঁকতেন মন ও স্মৃতি থেকে। এদিকে সোলিদার সেই পেইন্টিংও রেখে দেন অনেক দিন অবধি। সত্তরের দশকে ফ্রান্সিস বেকন এটি কিনে নেন এবং নষ্ট করে ফেলেন। 

কামিল ক্লদেল (১৮৬৪-১৯৪৩)

কামিল ক্লদেল যখন রঁদ্যার সঙ্গে দেখা করলেন তখন তার বয়স সবে ১৯। দুজনের বয়সের ব্যবধান ২৪ বছর। কামিল খুব দ্রুতই তার অনুসারীতে পরিণত হলেন। আলাদা করে তুললেন নিজের অবস্থান। পরিচিতি পরিণত হলো প্রেমে। কামিলের অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতায়ই রঁদ্যা তৈরি করেন কয়েকটি মাস্টারপিস। তাদের মধ্যে ‘দ্য বার্গার্স অব কালাইস’ ও ‘দ্য গেট অব হেল’ অন্যতম। কামিল নিজেও যে কত বড় আর্টিস্ট ছিলেন তার প্রমাণ ‘দ্য ম্যাচিউর এইজ’ ও ‘শকুন্তলা’। পৃথিবীর অন্যতম মহান ভাস্কর রঁদ্যা। বিশ শতকের বিমূর্ত ও নিরীক্ষামূলক আর্টের রূপ দিয়েছেন তিনি, অথচ কামিলকে বুঝলেন না। ক্রমে জটিল হয়ে উঠল যেন সম্পর্ক। ভাস্কর্যের পেছনে কামিলকে কোনো কৃতিত্ব দিতে নারাজ রঁদ্যা। তবু কামিল মেনে নিলেন প্রিয়তমের ইচ্ছা ও পছন্দকেই। কামিল তাকে ত্যাগ করে স্বতন্ত্র আর্টিস্টে পরিণত হলেন। তবে মানসিকভাবে ক্রমেই ভেঙে পড়ছিলেন। জীবনের শেষ ৩০ বছর নিজেকে সরিয়ে রাখেন ভাস্কর্য ও রঁদ্যা থেকে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫