অভিমত

ভালো শিক্ষা ছাড়া কোনো দেশ ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ পায়নি

প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ০২, ২০২৪

সাবিদিন ইব্রাহিম

ভুল নীতি, ভুল পলিসি ও ভুল পথে অনেক সম্ভাবনাময় জাতিও কানাগলিতে হামাগুড়ি দেয়। বাংলাদেশ সেদিকে এগোবে কিনা তা নির্ধারণ করবে কোন নীতি গ্রহণ করছে, কোন অভিমুখে যাত্রা করছে তার ওপর। ভৌগোলিক অবস্থান থেকে শুরু করে কর্মক্ষম বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠীর সমাবেশের কারণে বাংলাদেশ অনেক সম্ভাবনাময়, এটা বারবার উচ্চারিত ও উৎসারিত কথা। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতিক লভ্যাংশের কথা কয়েক দশক ধরেই আলোচিত হচ্ছে। কিন্তু আদতে আমরা কতটুকু সুবিধা ঘরে তুলতে পেরেছি তা অনুসন্ধানের সময় এসেছে।

আমাদের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের আলাপটা বেশ হতাশাজনক। এ আলাপের শুরুতে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হচ্ছে মানুষ এবং তাদের সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। উন্নয়নশীল দেশ থেকে মধ্যম আয় ও উন্নত দেশ হতে গেলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে মনোযোগ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। 

আমরা জাপান, সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো এশিয়ার উন্নত দেশগুলোর কথা যদি বলি তাহলে দেখব, তারা শিক্ষায় সর্বোত্তম বিনিয়োগের মাধ্যমেই এ জায়গায় এসেছে। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়া এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি ও পরাশক্তি হওয়ার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় প্রভাবক ছিল শিক্ষা। ১৭৭৬ সাল থেকে ১৮৬১-এর গৃহযুদ্ধ অবধি উত্থানকালে শিক্ষায় গুরুত্ব দিয়েছিলেন ফাউন্ডিং ফাদাররা। বর্ণবাদ যুক্তরাষ্ট্রের নেতিবাচক দিক হলেও ১৮৫০-এর দশকে প্রায় শতভাগ শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে পেরেছিল তারা। বলা হয়, স্বাধীনতার এক শতকে প্রাথমিকের ভিত্তি দাঁড় করিয়েছে এবং পরবর্তী অর্ধশতকে মাধ্যমিকের ভিত মজবুত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রশ্ন আসতে পারে, আমাদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের জন্য তো তাহলে ১০০ বছর সামনে আছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে আগে ১০০ কিংবা ৫০০ বছরে যে পরিবর্তন আসত এখন তা দুই বা পাঁচ বছরেই আসে। এক দশকেই এখন যে পরিবর্তন আসে তা আগে ৫০০ বা হাজার বছর লেগে যেত। অল্প সময়ের ব্যবধানে অনেক পেশা, অনেক কোম্পানি, অনেক সেবা হারিয়ে যায়। আবার নতুন পেশা, নতুন কোম্পানি ও নতুন পরিষেবা সৃষ্টি হয়। এখন এক যুগ কিংবা এক দশকের মধ্যেই কোনো একটি দেশকে বড় ধরনের উল্লম্ফন করতে হবে। আরেকটি কথা হচ্ছে, আমরা যে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের কথা বলছি তা সামনের ২০-৩০ বছরের পর সম্পদ না হয়ে বোঝা হয়ে যাবে। আমরা চাইলেও সে ডিভিডেন্ড নিতে পারব কি?

১৯১৩ সালে এশীয়দের মধ্যে প্রথম নোবেল জয়ের পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরবর্তী দুই দশকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। তার লেখায় বিশেষ জায়গা দখল করে রেখেছে রাশিয়া ও জাপান। দেশ দুটোর উত্থানকালের শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবার মান তাকে মুগ্ধ করেছে। ‘রাশিয়ার চিঠি’তে জোসেফ স্টালিনের সোভিয়েত রাশিয়ার সর্বজনীন শিক্ষার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। আবার একই সময়ে জাপানেও তার ভালো-মন্দ অভিজ্ঞতা রয়েছে। 

যুক্তরাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা থেকে উপকরণ নিয়ে নিজেদের শিক্ষা কাঠামো ঢেলে সাজানোর কাজ জাপান শুরু করেছিল উনিশ শতকের শেষের দিকে। ১৮৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়েছিলেন মেইজি রাজবংশের পাঠানো এক কূটনীতিক। ২৫ বছর বয়সী ওই কূটনীতিকের নাম ছিল আরিনরি মোরি। জাপানের স্কুল শিক্ষাকে উন্নত করার জন্য তৎকালীন শীর্ষ মার্কিন শিক্ষাবিদদের পরামর্শ চেয়েছিলেন তিনি। অনেক মার্কিন শিক্ষাবিদই তার আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলেন। এর মধ্যে ছিলেন রুটগার্স ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ডেভিড মারি, যিনি পরবর্তী সময়ে জাপানের শিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টাও হয়েছিলেন। পশ্চিমা অভিজ্ঞতা নিয়ে জাপানের শীর্ষ শিক্ষা সংস্কারক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন আরিনরি মোরি। যুক্তরাষ্ট্র থেকে তিনি যে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা নিয়ে এসেছিলেন তা হচ্ছে, শিল্পোন্নত দেশের তালিকায় নাম লেখাতে হলে প্রাথমিক শিক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে। 

১৮৮৫ সালে দেয়া এক ভাষণে আরিনরি মোরি বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশকে তৃতীয় শ্রেণীর তালিকা থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উঠতে হবে; দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে প্রথম শ্রেণীতে। সবশেষে বিশ্বের সব দেশের মধ্যে শীর্ষ আসনে আসীন হতে হবে। এটা করার সর্বোচ্চ উপায় হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষার ভিত মজবুতকরণ।’ পরবর্তী কয়েক দশকের মধ্যে জাপানের অর্জন বিশ্বের সবার সামনে স্পষ্ট হতে শুরু করে। বিশ শতাব্দীর শুরুর দিকে শুধু প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে সাফল্য দেখাতে পেরেছে জাপান। তবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সুযোগের সমতা নিশ্চিতে তার ভূমিকা ছিল প্রশ্নাতীত। ১৯১৬ থেকে ১৯২৯ সালের মধ্যে জাপানে ছয়বার সফর করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জাপানের শিল্পভিত্তিক আধুনিক অর্থনীতি হয়ে ওঠা এবং অসমতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রসঙ্গ তুলে এনেছেন তিনি। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে ঘুরে রবীন্দ্রনাথের মনে এই প্রতীতি জন্মেছিল শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি উন্নতি করতে পারে না। এজন্য বিশ্বভারতী ও শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। ওই সময় ভারতবর্ষে নিরক্ষতার হার ৯০ শতাংশেরও বেশি ছিল।  

মেইজি শাসনামলকে জাপানের ভিক্টোরীয় যুগ হিসেবে অভিহিত করেন অনেক ঐতিহাসিক। আধুনিক জাপান নির্মাণে পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোর অনুসরণে সরকার ব্যবস্থা, অর্থনীতি, শিক্ষা ও সমাজ সংস্কার করেছিলেন সম্রাট মেইজি (শাসনকাল: ১৮৬৮-১৯১২)। জাপানের সমাজ, সরকার ও রাজনীতি, অর্থনীতি ও শিক্ষা ব্যবস্থা একটি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়ায় এ শাসনামলে। 

বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে এসেছে, সেটা ভালো কথা। উন্নয়নশীল দেশের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে এসে মধ্যম আয় ও উচ্চ আয়ের দেশ হওয়ার যাত্রাটা সহজ নয়। আমাদের শিল্পোন্নত দেশ হতে হবে এবং প্রযুক্তির সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে আধুনিক অর্থনীতির কেন্দ্র হিসেবে জায়গা করে নিতে হবে। এজন্য দেশের জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তর করতে হবে। তার প্রাথমিক ভিত তৈরি করতে পারে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকেই একটি ছাত্রের ভিত এত মজবুত হওয়া চাই, যা দিয়ে সে ভবিষ্যতে বেশির ভাগ কাজ করার সক্ষমতা অর্জন করবে। কিন্তু আমাদের প্রাথমিকের ভিত দুর্বল হওয়ায় তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো শিক্ষা নিতে পারে না এবং কর্মক্ষেত্রেও ফিট হয় না। মৌলিক শিক্ষার পাশাপাশি আদব-কায়দা শিক্ষা, মানবীয় গুণাবলির বিকাশের সহায়ক পরিবেশ থাকা চাই প্রাথমিকে। দেশে ও বিদেশের বিশাল শ্রমবাজারের জন্য উপযুক্ত কর্মী তৈরিতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যাত্রা অনেক দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। এজন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিকেই প্রয়োজনীয় দক্ষতা শিক্ষা দেয়া চাই।

প্রাথমিকে ভালো শিক্ষা নিশ্চিতের জন্য কারিকুলামের পাশাপাশি যোগ্যতর শিক্ষক নিয়োগও জরুরি। প্রাথমিকে মেধাবী ও যোগ্য শিক্ষক আকর্ষণে অনেকেই বেতন বৃদ্ধির কথা বলছেন, এটা যৌক্তিক দাবি। একই সঙ্গে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রয়োজনীয় তদারকি দরকার। আবার তদারকি বলতে আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ সঠিক শিক্ষার পরিবেশ ব্যাহত করতে পারে। 

প্রাথমিক শিক্ষায় গলদ থাকলে সে জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার। বেতন ও সুবিধাদি বৃদ্ধির পাশাপাশি তাদের অব্যাহত প্রশিক্ষণের মধ্যে রাখতে হবে। খারাপ চিকিৎসকের কাছে সন্তানের চিকিৎসার দায়িত্ব দিয়ে যেমন নিরাপদ বোধ করা যায় না তেমনি খারাপ শিক্ষকের কাছেও শিশুদের শিক্ষার ভার দিয়ে নিরাপদ থাকা যায় না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের পর পিটিআই থেকে ১৮ মাসের ডিপ্লোমা ইন এডুকেশন সম্পন্ন করতে হয়। এটা ভালো উদ্যোগ। এর পরও প্রশিক্ষণের ধারাবাহিকতা থাকা উচিত এবং বছরে অন্তত ১০ দিন হলেও শিক্ষকদের আবাসিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত।

প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তি মজবুত করতে শুধু ইট-কাঠের অবকাঠামোতে বড় অংকের ব্যয় করে দায়িত্ব শেষ করা যাবে না। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর ওপর ব্যয় বাড়াতে হবে। আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হতে চাই, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড পেতে চাই অথচ চলতি বাজেটে শিক্ষায় ব্যয় জিডিপির ২ শতাংশেরও নিচে। জাপান, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া উন্নত দেশের কাতারে দাঁড়িয়েছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে জোর দিয়েই। আমাদের সামনে এর বিকল্প কোনো পথ নেই। 

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড একটা বিস্তৃত ধারণা। এটা এমনি এমনি পাব না আমরা। ডিভিডেন্ড পেতে হলে শ্রম দিতে হয়, বুদ্ধি দিতে হয়, কৌশল অবলম্বন করতে হয়। নীতিনির্ধারকরা যত তাড়াতাড়ি এটা বুঝবেন তা দেশের ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গল। বাংলাদেশে বর্তমানে তরুণ জনগোষ্ঠীর যে আধিক্য তা সবসময় থাকবে না। পরবর্তী পর্যায়ে তরুণদের চেয়ে বয়স্কদের সংখ্যা বাড়তে থাকবে। অনেক দেশের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সময়কাল বড় ছিল কিন্তু বাংলাদেশের হাতে আছে মাত্র একটি দশক। আগামী এক দশকে অনেক কাজ করার রয়েছে। এ দশকটি হওয়া চাই রূপান্তরের দশক, সুষম ও সমতাপূর্ণ উন্নয়নের দশক।

সাবিদিন ইব্রাহিম: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, বণিক বার্তা


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫